নূর জাহান : অগভীর ও পরিচিত গল্পের উপভোগ্য উপস্থাপন
প্রণয়ধর্মী সাহিত্য পড়তে গিয়ে বা চলচ্চিত্রগুলো দেখতে গিয়ে একটা বিষয় সকলেই অনুভব করেন যে তারা নিজেরাই এই চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রী। কাউকে কাউকে আবার সে রকমভাবে প্রেম নিবেদন করতে বা আবেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এই ধরনের গল্পগুলো ঠিক কখন থেকে লেখা হচ্ছে তা জানা না গেলেও ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ বা ‘লাইলি মজনু’ এই ধরনের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এগুলোতে প্রণয়ের পাশাপাশি বিয়োগান্ত বিষয়ও জড়িত ছিল। যাই হোক, ‘নূর জাহান’ ছবিতেও সেরকম গল্প বলার প্রয়াস ছিল।
নূর জাহান ছবিটি নূর ও জাহান নামে দুই যুবক-যুবতীর (কিশোর-কিশোরী বলাই উত্তম) গল্প। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের ঐতিহ্য বজায় রেখে এই গল্পেও নূর দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র আর জাহান তারই সহপাঠী ও প্রভাবশালী পরিবারের কন্যা। কলেজের প্রথম দিনেই জাহান নূরকে বুলিংয়ের হাত থেকে বাঁচায়। নূরের মেধা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে জাহান তাকে প্রেম নিবেদন করে। নূরও সাড়া দেয়। কিন্তু জাহানের মা আমেনা বেগম তাদের এই প্রণয় মেনে না নিলে তার পালিয়ে যায়। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন, আসে মর্মান্তিক পরিণতি।
চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পূর্বে শোনা গিয়েছিল এটি নাগরাজ মানজুলের মারাঠি ভাষার ‘সৈরাট’ চলচ্চিত্রের অফিসিয়াল পুনর্নির্মাণ। কিন্তু এটি সৈরাটের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত বা সৈরাট থেকে অনুপ্রাণিত বলেই মনে হল। সৈরাটের শুধু চরিত্রগুলোই গ্রহণ করা হয়েছে, তাও পরিবর্তিতভাবে এবং ভিন্ন চিত্রনাট্যে। এক্ষেত্রে নবাগত পরিচালক অভিমন্যু মুখার্জীকে সাধুবাদ জানাতে হয় পরিবর্তিত চিত্রনাট্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে সুন্দরভাবে তার কাজ সম্পন্নের জন্য।
নাম ভূমিকায় অভিনয় করা আদৃত (নূর) ও পূজা (জাহান) দুজনেরও এটি প্রথম চলচ্চিত্র। দুজনের অভিনয় দেখে মনে হয়নি এটা তাদের অভিষেক চলচ্চিত্র। বিশেষ করে পূজাকে। যখন এই ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পূজা আলোচনায় আসে, তখন ভেবেছিলাম সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের ভার তাকে নিতে হবে এবং সে পারবে কিনা। কারণ, সৈরাটে অভিনেত্রী রিংকু রাজগুরু অভিনেতা আকাশ তোশারের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। এই দিক থেকে পূজা তার চরিত্রের মান রেখেছে এবং নবাগতা হিসেবে তো আরও ভালো। সাম্প্রতিক সময়ে নবাগত হিসেবে আসা অভিনেত্রীদের মধ্যে ‘গহীন বালুচর’ চলচ্চিত্রের মুনের কাজ ভালো লেগেছিল। পূজার কাজও মুগ্ধ করেছে। তবে দ্রুত সংলাপ বলার কারণে তার কথা কিছু জড়িয়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে নবাগত আদৃত ভালো করলেও পূজার তুলনায় তাকে কিছু ক্ষেত্রে তাকে আড়ষ্ট লেগেছে। অবশ্য তার চরিত্রটাই এমন ছিল। তাকে খুবই ভদ্র ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে, যে সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখে। আদৃত ও জাহানের রসায়ন পাকাপোক্ত লেগেছে। জাহানের মা চরিত্রে অপরাজিতা আঢ্যের খল চরিত্রে তার স্বামী (নাদের চৌধুরী), মেয়ে ও তার দলের লোকজনের উপর কর্তৃত্বের বিষয়টি যেমন উপভোগ্য ছিল, তেমনি সবসময় তার একই রকম মুখভঙ্গির জন্য তা বিরক্তির উদ্রেক ছিল। অন্যান্য চরিত্রে সুপ্রিয় দত্ত, নাদের চৌধুরী, ওমর আয়াজ অনি, এমনকি কৌতুক চরিত্রে অভিনেতা চিকন আলীও (একটু মোটা হয়েছে 😛 ) ভালো কাজ উপহার দিয়েছেন।
ছবিতে তিনটি গান রয়েছে, গান তিনটিই শ্রুতিমধুর। গল্পের প্রয়োজনে আবদুল গফুর ঢালীর ‘সোনা বন্ধু’ গানটির নতুনভাবে সঙ্গীতায়োজন করা হয়েছে এবং দৃশ্যায়নেও সৌন্দর্য ছিল। শিরোনাম গানের নাচের তাল যেন কিছুটা মিলছিল না।
দুই বাংলায় একসাথে কাজ করলে একটা সমস্যা দেখা যায়, সেটা হল দুই সংস্কৃতিকে ধারণ করতে গিয়ে একটা গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা থাকে। ছবিতে দেখানো হয়েছে, আমেনা বেগম নবাবগঞ্জের প্রভাবশালী নেত্রী, যিনি মাঝে মাঝে ঢাকাইয়া টানে কথা বলেন। কিন্তু তার মেয়েকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় কথা বলতে দেখা যায়। এমনকি নূরকে একই রকমভাবে কথা বলতে দেখা যায়। একই রকমভাবে সাম্প্রতিক যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রগুলোতেও এই বিষয়টি দেখা গেছে। এর সমাধান হিসেবে দুই বাংলার জন্য দুই রকমভাবে ডাবিং করা যায়। তাহলে হয়ত এই ধরনের সমস্যা দেখা দিবে না। ক্রস-কালচারাল মিক্স খারাপ কিছু নয়, তবে তা যৌক্তিক হওয়া প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, নূর জাহান একটি অগভীর ও পরিচিত গল্পের চলচ্চিত্র। অভিনয় ও পরিচালনা এই ছবিটিকে বিনোদনের উৎস হতে সাহায্য করেছে। বিনোদন পেতে চাইলে ও অভিনয়সমৃদ্ধ কাজ দেখতে চাইলে ছবিটি দেখতে পারেন।
চলচ্চিত্র : নূর জাহান
পরিচালনা : অভিমন্যু মুখার্জী ও আবদুল আজিজ
চিত্রনাট্য ও সংলাপ : অভিমন্যু মুখার্জী
শ্রেষ্ঠাংশে : পূজা চেরি রায়, আদৃত, অপরাজিতা আঢ্য, নাদের চৌধুরী, সুপ্রিয় দত্ত
রেটিং : ৩/৫