Select Page

নেপথ্য কাহিনি: সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’

নেপথ্য কাহিনি: সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র। বিহারিদের নিয়ে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে গেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল। তখন সেখানেই ছিল সুভাষ দত্তের বাড়ি। তিনি অবশ্য বাড়ি ছিলেন না। তবে ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলে বিহারিরা। তাকে বলা হয় দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতে। মারার আগে রুটিনমাফিক জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কেয়া নাম?’

‘সুভাষ দত্ত’। নাম শুনেই সেনাদলের একজন ক্যাপ্টেন চিনে ফেলেন তাকে। ততদিনে সিনেমা করে দুই পাকিস্তানেই বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন সুভাষ দত্ত। কিছু উর্দু ছবিতেও করেছিলেন অভিনয়। পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। সেই পরিচিতিই তাকে সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়।

তবে পুরোপুরি নিস্তার পাননি। তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গভর্নর হাউজে। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কাজেই আগে হোক বা পরে, মৃত্যুই ছিল অমোঘ নিয়তি। কিন্তু আবারও সেই ক্যাপ্টেন এগিয়ে আসেন। ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। নিজে গাড়িতে করে দিয়ে যান বাসায়।

পরদিনই হামলা চালায় বিহারিরা। বাড়ি লুট করে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন সেই ক্যাপ্টেন। আশপাশের লোকজনদের শাসিয়ে যান। সুভাষ দত্তের কিছু হলে সবাইকে মেরে ফেলবেন।

এভাবে মাস কয়েকের জন্য জানের নিরাপত্তা পান তিনি। তবে বন্ধ করে দেন বাড়ি থেকে বের হওয়া। ১৫ মে সে আশ্রয়ও ফুরায়। খবর আসে, ক্যাপ্টেন বদলি হয়ে যাচ্ছেন। এবার বরং ভারত পালিয়ে যান।

সেটা ছিল ঈদে মিলাদুন্নবীর রাত। বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেন সুভাষ দত্ত। চুল-গোঁফ কামিয়ে ফেলেন। নেন ছদ্মবেশ। বেরিয়ে পরেন ভারতের উদ্দেশ্যে। একাই। তবু পথে এক ছেলে চিনে ফেলে তাকে। দশ-পনের বছর বয়সের। বাড়ি নিয়ে যায়। যত্ন করে খাওয়ায়। পৌঁছে দেয় বর্ডারে। চৌদ্দগ্রামে। এমনকি সেই ছেলে খুঁজে-পেতে তার স্ত্রীকেও এনে বর্ডার পার করিয়ে দেয়।

ভারতে পৌঁছে প্রথমে শিলিগুড়ি যান সুভাষ দত্ত। এক আত্মীয়ের বাড়ি। স্ত্রীকে রেখে আসেন। নিজে যান কলকাতায়। যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতারে।

সেখানে থাকতেই একটা সিনেমার ভাবনা মাথায় আসে তার। দেশে থাকতে নিজের চোখে দেখেছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনির অত্যাচার। কলকাতাতেও নিয়মিত পেতেন খবর। চিন্তা করেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ের অরুণোদয় হবে বটে। তবে থেকে যাবে অগ্নিসাক্ষী। যুদ্ধশিশুরা। এই সমস্যা নিয়েই সিনেমা।

স্বাধীনতার পরপরই হাত দেন ছবির কাজে। নাম ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। পার্শ্বনায়কের চরিত্রটা বানান নিজের আদলে। তার ভারত যাত্রা মাথায় রেখে। ফুটিয়ে তোলেন যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে শিল্পীর অসহায়তা। সে কি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবে, নাকি শিল্পমাধ্যম ব্যবহার করে? চরিত্রটিতে অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন।

ছবিটির শুটিং হয়েছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। সেটার দায়িত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। অস্ত্র-গোলাবারুদ তো বটেই, শুটিংয়ের জন্য দিয়েছিলেন ট্যাঙ্ক, জেট, কামানও। এমনকি শুটিং করা হয়েছিল জীবন্ত বাঙ্কারে!

ছবিটা মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ৮ নভেম্বর। প্রিমিয়ার শো হয় জোনাকী সিনেমা হলে। কিন্তু মুক্তির পরেই নানা জায়গা থেকে বাধা আসে। অনেক জায়গায় নামিয়েও দেয়া হয়। সুভাষ দত্ত অবশ্য সেজন্য আঙুল তোলেন স্বাধীনতা-বিরোধী পক্ষের প্রতি। সব মিলিয়ে ব্যবসা খুব একটা ভালো করেনি। কোনো রকমে পুঁজিটা ওঠে। সমালোচকদের প্রশংসা অবশ্য জুটেছিল। তবে যতটা ছবির জন্য, তারচেয়ে বেশি উদ্দেশ্যের সাধুতার জন্য।

*লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকে পূর্ব প্রকাশিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাবীল অনুসূর্য

চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক

মন্তব্য করুন