ন ডরাই : এ সিনেমার নিজস্ব ভাষা আছে
নাম: ন ডরাই – Dare To Surf (২০১৯)
ধরণ: স্পোর্টস ড্রামা
চিত্রনাট্য: শ্যামল সেনগুপ্ত
পরিচালনা: তানিম রহমান অংশু
প্রযোজনা ও পরিবেশনা: স্টার সিনেপ্লেক্স
অভিনয়: সুনেরাহ বিনতে কামাল (আয়েশা), শরীফুল রাজ (সোহেল), সাঈদ বাবু (আমির), জোসেফাইন লিন্ডগার্ড (এস্থার), ওয়াসিম সিতার (লিয়াকত), ঠাকুর প্রসাদ (আদিল), টমি হিন্ডলে (মার্ক), লেঙ্কা ম্যারি (আমিরের স্ত্রী), পেদ্রো প্রিন্সিপি (ক্যামেরাম্যান), হিন্দোল রয় (সোহেলের বাবা), নাসিরুদ্দিন খান প্রমুখ।
শুভমুক্তি: ২৯ নভেম্বর, ২০১৯
নামকরণ: ‘ন ডরাই’ মূলত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার দুটি শব্দ, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ভয় পাই না’। ছবিটি মূলত এদেশের অবহেলিত একটি পেশা সার্ফিং এর গল্প বলে। পায়ে ওয়্যাক্স পরিহিত থাকলেও উত্তাল সমুদ্রে সার্ফিং করতে হলে অকুতোভয় সাহসের অধিকারী হতে হয়। সাগর এবং সাগরের বিশালাকার ঢেউকে আপন করে নিতে হয়। তবেই কেউ একজন পরিপূর্ণ সার্ফার হয়ে উঠতে পারে।
তবে আমাদের দেশে এই ভয় না পাওয়ার গুরুত্ব আরো বেশি। সমুদ্রের ঢেউ মোকাবেলা করার সাথে সাথে আমাদের দেশের তথাকথিত ট্যাবুজর্জরিত সমাজের বিরুদ্ধেও একজন সার্ফারকে লড়াই করতে হয়। নিজ লক্ষ্যের প্রতি অটল থাকতে হয়। এখানে ভয় পেয়ে যাওয়া মানে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া থেকে দুরে সরে যাওয়া। তাই ‘ন ডরাই’ নামটি যথার্থ মনে হয়েছে।
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: একটা অবাক করার মতো বিষয় কি জানেন? আমাদের উপমহাদেশে সার্ফিং নিয়ে কাজ হয়েছে এরকম কোনো ছবির নাম নেট ঘেঁটে পাইনি। হয়তো কোনো সিনেমা থাকতে পারে যেটি ততটা দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। আপাতত বলা যায়, এটি উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত ইউনিক আইডিয়ার একটি ছবি! যেরকম আইডিয়ার ছবি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে এতো বড়বড় ইন্ডাস্ট্রি থাকা সত্ত্বেও তাদের কেউ করে দেখাতে পারেনি। আর এই আইডিয়াটি এসেছে স্টার সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার মাহবুব রহমানের মস্তিষ্ক থেকে। তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আমাদের এরকম ইউনিক আইডিয়ার সিনেমা দেখানোর জন্য।
সিনেমার প্রেক্ষাপট মূলত আমাদের দেশের শিশু ও তরুণ সার্ফারদের নিয়ে, যেখানে তাদের নিজ চেষ্টায় প্রশিক্ষণ নেওয়া থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজের বিরুদ্ধে তাদের যে জীবনযুদ্ধ চালাতে হয় সেই বাস্তব চিত্র দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সার্ফিং আমাদের দেশে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে এখনো বড্ড দূর্বল! এটি করে হয়তো কেউ দেশের বাইরে বেশ সুনাম ও পুরস্কার অর্জন করতে পারবে, কিন্তু শুধু পুরস্কার দিয়ে কি আর পেট চলে? যার ফলশ্রুতিতে কেউ আর এই সার্ফিংকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বাছাই করতে পারেনা, যথেষ্ট প্রতিভা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও।
মেয়েদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো গুরুতর। আমাদের রক্ষণশীল সমাজে এটিকে বাঁকা চোখে দেখা হয়, আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের দেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই ধর্মানুসারে যেই নারী যত বেশি পর্দা করে চলবে, আখিরাতে তাকে সবথেকে কম শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু এই ধর্মের নিয়মাবলি আমাদের সমাজে যেভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাকে অপব্যবহার বলা-ই শ্রেয়। তো এরকম ভয়ানক জটিল একটি পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় সার্ফিং খেলাটি কীভাবে তরুণদের মাধ্যমে টিকে থাকে, সেই গল্পই এছবিতে দেখানো হয়েছে।
সাধারণত খেলাধুলা নিয়ে সারা দুনিয়াতে কোনো ফিল্ম হলে বেশিরভাগ সময় এরকম একটি গল্প দেখা যায়; কোনো একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকবে, তার উথানের কাহিনী দেখানো হবে, এরপর কোনো এক কারণে তার পতন হবে, কোনো এক কারণে আবার তিনি অনুপ্রাণিত হবে এবং পরিশেষে আবারও তিনি স্বমহীমায় নিজের ভালোলাগার জায়গায় ফিরে আসবে। দিনকে দিন এটাও যেনো খেলাধুলাভিক্তিক সিনেমার জন্য এক ধরনের ট্যাবু হয়ে দাড়িয়েছে। বস্তুত, ‘ন ডরাই’ সেই গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করেনি। এখানে তাদের গল্পই দেখানো হয়েছে যারা তাদের জীবনে নানারকম উথান-পতন পার করেও দিনশেষে নিজেদের লক্ষ্য পুরণে ব্যর্থ। এখানে এসে ছবিটির গল্প একটি সার্থক সিনেমা তৈরী করার জন্য উপযুক্ত হতে পারতো, কিন্তু…
মূল সমস্যাটি হয়েছে সিনেমার চিত্রনাট্যে, যেটি তৈরৗ করেছেন ভারতের শ্যামল সেনগুপ্ত। তিনি একজন অভিজ্ঞ বাঙালি চিত্রনাট্যকার। তার লেখা চিত্রনাট্যে তৈরী ছবি ‘অন্তহীন’ ভারতে বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে। কোলকাতার বড় দুই স্টার দেব ও শ্রাবন্তী দুজনেই মনে করেন তাদের জীবনে অভিনয় করা সেরা চরিত্র হলো ‘বুনোহাঁস’ এর চরিত্র দুটি, সেই চরিত্র দুটি সাজিয়েছেন এই শ্যামল সেনগুপ্ত। স্বাভাবিকভাবেই যারা তার কাজ আগে দেখেছেন, প্রত্যাশা বেশিই থাকার কথা। সিনেমার প্রথমার্ধ যখন দেখছিলাম তখন প্রত্যাশা অনুযায়ী তার প্রতিদানের ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু সিনেমা দ্বিতৗয়ার্ধে এসে কেমন অত্যন্ত ধীরগতিতে সামনে এগুলো। এমনিতে তো ট্রেইলার দেখার পর গল্প মোটামুটি ধারণা করার মতোই, এরপর দেখলাম যা ধারণা করে এসেছি তার প্রায় সবকিছুই প্রথমার্ধে দেখানো হলো। সেহিসেবে প্রত্যাশা করেছি এর বাইরে নতুন কিছু দ্বিতৗয়ার্ধে দেখতে পারবো, যা হয়তো কেউ আশা করে আসেনি। কিন্তু আফসোস, সেই প্রত্যাশায় গুড়েবালি! শেষ চল্লিশ মিনিটে এসে মনে হচ্ছিল সিনেমাকে চুইংগামের মতো টেনে লম্বা করা হচ্ছে, যখন হলে থাকা উৎসুক জনতা গল্পের পরিণতি দেখার জন্য একদম প্রস্তুত। ১৪৮ মিনিট এই গল্পের জন্য অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে গেছে, একটি সময় গিয়ে মনে হয়েছে গল্প তার নিজের লক্ষ্যবিন্দু থেকে দুরে সরে গিয়েছে। প্রথমার্ধে যেরকমভাবে এতো সুনিপুণহাতে দর্শকদের সাথে সিনেমাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, দ্বিতৗয়ার্ধে এসে দর্শক হিসেবে মনে হলো সেই জোড়া জবরদস্তি করে ছিড়ে ফেলা হয়েছে গল্পের গতি কমিয়ে দিয়ে। এক্ষেত্রে উচিত ছিল গল্পের গতি প্রথমার্ধের মতন রেখে সিনেমার দৈর্ঘ্য পনেরো মিনিট কমিয়ে ফেলা।
তবে সিনেমার শেষ সিক্যুয়েন্সটি গল্পের সুন্দর পরিসমাপ্তি টেনেছে, যেখানে সারাজীবন স্ট্রাগল করতে থাকা ও জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া দুজন সার্ফার এক হয়েছে তাদের অক্সিজেন, সমুদ্রে এসে।
পুরো সিনেমাটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি, এটিকে বাংলাদেশের সবথেকে দূর্বোধ্য আঞ্চলিক ভাষা ধরা হয়! মাঝে কিছু ইংরেজী সংলাপ আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে সিনেমাতে বাংলা সাবটাইটেল ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে বাংলা/ইংরেজী সাবটাইটেল দেওয়া হয়নি; যা চট্টগ্রামের বাইরের মানুষদের ক্ষেত্রে সিনেমার প্রতি মনোযোগ রাখতে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া সিনেমাতে প্রচুর স্ল্যাং ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার আছে, যেটা আমার কাছে যথাপযুক্তই মনে হয়েছে। বরং এটি না থাকলে চট্টগ্রামের ভাষা অপূর্ণ থেকে যেতো।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।
পরিচালনা ও অভিনয়: বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীগণ আগামী দশকে যে কয়জন তরুণ নির্মাতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন, তানিম রহমান অংশু তাদেরই একজন। এর আগে তার একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, ‘স্বপ্নের ঘর’ নামক সিনেমাটি আমাদের ঢালিউডের হরর জনরার জন্য একটি সুন্দর প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু ওখানে পরিচালক তানিম রহমান অংশু যে ভুলটি করেছিলেন, এখানে এসেও তিনি সেই একই ভুল করলেন। সিনেমার শুরু ভালো, মাঝে ডেভলপমেন্ট ভালো, কিন্তু ফিনিশিং দিলেন অত্যন্ত ম্যাঁড়মেড়ে; যা ‘ন ডরাই’ কে যেনো তার পূর্ববর্তী কাজের মতোই অপূর্ণ করে রাখলো।
এছবিতে প্রধান ও মূল পার্শ্বচরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই যে যার দিক থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাদের নিজ নিজ চরিত্র রূপদানের জন্য। শুনেছি মূল চরিত্রে অভিনয় করা সুনেরাহ বিনতে কামাল, শরীফুল রাজ, সাঈদ বাবু, ওয়াসিম সিতার সহ আরো অনেকে টানা তিন মাস সময় নিয়ে সার্ফ করা শিখেছেন। যারা বড়পর্দায় কাজ করেন কিন্তু পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেন না, তরুণদের এরকম ডেডিকেশন তাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা।
অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মধ্যে সবাইকে ছাপিয়ে শরীফুল রাজ আমায় সবথেকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। তাকে কেন আগামী দশকের সম্ভাবনাময় ধরা হয় তিনি যেনো এই ‘সোহেল’ চরিত্রটি দিয়ে সেটাই প্রমাণ করলেন। গতানুগতিক ডানপিটে স্বভাবের একটি চরিত্র হলেও সুঠাম দেহ ও সুবিশাল চুল-দাড়ি নিয়ে তিনি যেরকম স্ক্রিণপ্রেজেন্স দেখিয়েছেন, বিপুল করতালি দেওয়ার মতো! তার চরিত্রটি মূলত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি চরিত্র, সমাজ তাকে গ্রহন করতে চায় না বিধায় সে তার প্রতিভা জনসম্মুখে প্রকাশ করার সুযোগ পায়না। আর যখন সে সুযোগ পেলো তখন ভুল পথ বেছে নিয়ে বিপথে চলে গেলো। তবে সিনেমায় শরীফুল রাজের মুখে সাবলীল ইংরেজী কিছুটা অস্বস্তিকর অনুভুতি তৈরী করলো। সিনেমায় যেভাবে সোহেল চরিত্রটিকে গঠন করা হয়েছে, তাতে তার মুখে এতোটা সাবলীল ইংরেজী থাকার কথা না, আমতা-আমতা করে বলার কথা!
দ্বিতীয়ত ভালো লেগেছে আয়েশা চরিত্র রূপদান করা সুনেরাহ বিনতে কামাল কে। আয়েশা চরিত্রটি মূলত বাংলাদেশের প্রথম নারী সার্ফার নাসিমা আখতারের জীবনকাহিনী থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত। সুনেরাহ অত্যন্ত দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত এই চরিত্রটি সঠিক এক্সপ্রেশন ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখিয়ে বেশ ভালোভাবে রূপদান করতে পেরেছেন। তবে সিনেমার তার লুক ও মেকআপে কেমন একটা ভারসাম্যহীনতা নজরে পড়ছিল। এক সিনে শ্যামলাবর্ণ, অন্য সিনে এর থেকে কিছুটা কালো, এরকমটা মনে হলো।
তৃতীয়ত ভালো লেগেছে সিনেমার দুই গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র সাঈদ বাবু ও জোসেফাইন লিন্ডগার্ডের অভিনয়। সাঈদ বাবুর রূপদান করা আমির চরিত্রটি বাংলাদেশের প্রথম সার্ফার জাফর আলম থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত, যিনি বিদেশীদের সহায়তায় ও সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় সার্ফিং শিখে পরবর্তীতে কক্সবাজারে একটি সার্ফিং ক্লাব গঠন করেন। ক্লাবটি ছোট শিশুদের সার্ফিং প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এবং প্রতিভা অন্বেষণ করে। অন্যদিকে সোনালী চুলের সুন্দরী জোসেফাইন হলেন একজন ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার, যিনি তার বন্ধুর পরামর্শে বাংলাদেশে আসেন এদেশীয় সার্ফারদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরী করতে। আইএমডিবি ঘেঁটে পেলাম তিনি এর আগেও বেশকিছু আমেরিকান ছবিতে অভিনয় করেছেন, তাই তার কাছ থেকে সন্তোষজনক অভিনয় পেয়েছি।
এর বাইরে এছবির প্রধান নেগেটিভ চরিত্র লিয়াকত কে রূপদান করা ওয়াসিম সিতারের আক্রমণাত্মক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দারুণ লেগেছে। সিনেমায় একটি সিক্যুয়েন্স ছিল যেখানে দেখা যায়, ভাই বোনকে ঘরের দরজা-জানালা আটকে বেদম মার মারছে। সিনটি তিনি ও সুনেরাহ বিনতে কামাল খুবই লোমহর্ষকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, রিয়েলিস্টিক ফিল পাওয়া গেছে।
সাধারণত আমাদের সিনেমায় নায়কের বন্ধুর চরিত্রের কথা মনে করলেই আমাদের চোখের সামনে কি ভাসে? ভাসে নায়কের বন্ধুর চরিত্র হবে একজন মোটা-কালা-হাড্ডিসার-নির্বোধ মানুষ, যে পদে পদে মার খায়.. মাঝেমধ্যে নায়ক নিজেও তার সুবিধার জন্য তার সেই বন্ধুকে ফাঁসিয়ে দেয়! কিন্তু এখানে নায়কের বন্ধুর চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা, যেটি রূপদান করেছেন ঠাকুর প্রসাদ নামে একজন ভালো অভিনেতা। এখানে নায়কের বন্ধু নায়ককে বিপদ থেকে বাঁচায়, ভালোমন্দ বুদ্ধিপরামর্শ দেয়, যখন নায়কের সাহায্যের প্রয়োজন তখন তাকে সহযোগিতা করে, নায়ক যখন নতুন শহরে গিয়ে কতিপয় বিপদগামীর কবলে বন্দী তখন তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে, আবার এতোকিছু করার মাঝে টুকটাক ডায়লগবাজি করে হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টিও তিনি করেছেন। অভিনেতার পাশাপাশি এই চরিত্রের জন্য ক্রেডিট ছবির রাইটারদেরও প্রাপ্য।
সিনেমায় থাকা আয়েশার পিতামাতা ও সোহেলের বাবার অভিনয় মোটামুটি লেগেছে। মোটামুটি ভালো লেগেছে শুঁটকির আড়তের ব্যবসা করা নাসিরুদ্দিন খানের অভিনয়। তবে বাজে লেগেছে বাকি যারা বিদেশী ছিলেন তাদের অভিনয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল অভিনয় করার আগে এদের দিয়ে যথেষ্ট রিহার্সেল করা হয়নি। যার দরুণ অত্যন্ত মেকি লেগেছে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।
কারিগরি: সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকার এই ডিপার্টমেন্টের নায়ক! কি দারুণভাবেই না কক্সবাজারকে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন! এতো সুন্দর কক্সবাজার এর আগে কেউ সেল্যুলয়েডের পর্দায় দেখাতে পারেননি, যে কেউ সিনেমা দেখার পর নির্দ্বিধায় একথা স্বৗকার করে নিবেন।
ক্যামেরার কাজ যদি হয় চোখের শান্তি, তবে এসিনেমায় থাকা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হলো কানের শান্তি। অমিত চ্যাটার্জী ও ঈষাণ এছবির বিজিএমের কাজ করেছেন, টপ লেভেলের কাজ হয়েছে! এডিটিং এর কাজ সাধারণত তানিম রহমান অংশু নিজেই করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ঐ ধীরগতি নিয়ে কথা আবারও বলতে হয়। তার এবিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত ছিল। লোকেশন তো একদম পার্ফেক্ট! এছাড়া কস্টিউম মোটামুটি ভালো ছিল।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৯০।
বিনোদন ও সামাজিক বার্তা: ছবিতে মোট তিনটি গান আছে, যার সবকয়টিই দেখতে পাওয়া যায় সিনেমার দ্বিতৗয়ার্ধে। তিনটি গানই দারুণ, এবছর সেরা ফিল্ম মিউজিক এ্যালবামের লিস্ট করলে এসিনেমার নাম অবশ্যই আসবে! মোহন শরীফের কথা, গাওয়া ও সুর করা ‘যন্ত্রণা’ তো এখন চার্টবাস্টার। এছাড়া প্রীতমের গাওয়া ও সুর করা ‘সত্যি নাকি ভুল’ যেন একটি সুস্বপ্ন, যা বারবার শুনতে ও দেখতে মন চায়। গানটির কথা লিখেছেন রবিউল ইসলাম জীবন। সিনেমার একদম শেষে জেফারের গাওয়া গানটি যেকোনো ব্যর্থ মানুষের জন্য দারুণ অনুপ্রেরণা যোগাবে। মার্ক ডনের সুরে কিছুটা পশ্চিমা ঘরানার মিউজিক পাওয়া গেছে, সেইসাথে রাকিব হাসান রাহুল মোটামুটি ভালো কথা লিখেছেন। মজার বিষয় হলো, এই প্রথমবার আমি জেফারের কন্ঠে বাংলা গান শুনলাম! বাংলাদেশী হলেও তিনি মূলত ইংরেজী গান গাওয়ার জন্য বেশি জনপ্রিয়, তিনি এই ছবির সহকারী প্রযোজকও।
সিনেমাতে কমেডি, এ্যাকশন কিংবা অযাচিত রোম্যান্সের ওপর ততটা জোর দেওয়া হয়নি। এটা ওরকম ছবি না। এখানে শুনতে পাবেন ঢেউয়ের গর্জন, দেখতে পাবেন নীল সাদা জলরাশি! তবে কিছু জায়গায় সোহেল ও আদিলের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ গালাগাল শুনে অনেক হেসেছি… রাতে পাশাপাশি শুয়ে থাকাবস্থায় তাদের মধ্যকার কথোপকথন অনেক ইন্টারেস্টিং।
‘ন ডরাই’ ছবিটিতে বেশ কয়েকটি সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমত, সার্ফিং আর ৫/১০ টি গেমসের মতো সাধারণ একটি গেমস। এছাড়া আর ভিন্ন কিছু না। দ্বিতৗয়ত, আমাদের সার্ফিং অবকাঠামো দিক থেকে খুবই-খুবই দূর্বল। আমিরের মতো কিছু সার্ফিংপ্রেমী তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সার্ফিং ক্লাব গঠন করে সেখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এছাড়া আগে তেমন কিছুই ছিল না। বর্তমানে অবশ্য বাংলাদেশ সার্ফিং ফেডারেশন গঠন করা হয়েছে। তাদের এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে সার্ফিং নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে ভাবা। নাসিমাদের মতো আরো প্রতিভা লুকিয়ে আছে আনাচেকানাচে, যারা সঠিক প্ল্যাটফর্ম না পাওয়ার কারণে সামনে আসতে পারছে না। তৃতৗয়ত, সার্ফারদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে। একজন ক্রীড়াবিদ যদি সার্ফিং করে পেট না চালাতে পারে, তাহলে সার্ফিং এর ভবিষ্যত বলতে আসলে কিছুই টিকে থাকবে না। চতুর্থত, নিজের জীবনের লক্ষ্যের প্রতি সর্বদা ফোকাস রাখতে হয়, অন্যথায় সফল হওয়া সম্ভব না। সবশেষ, আমাদের সবার মধ্যে ফ্যামিলি ভ্যালু বাড়াতে হবে। যাদের ঘরে ছোট বোন আছে তারা আশাকরি লিয়াকতের মাঝে নিজেকে খুজেঁ পাবেন। খুজেঁ পেলে সেটা নিজের জন্যে হবে বড্ড লজ্জাজনক।
তবে এক্ষেত্রে নির্মাতা সবগুলোকে বড়পর্দায় গুরুত্বসহকারে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। এতোগুলো সমস্যা একটু আধটু করে দেখাতে গিয়ে কোনোটার ওপর জোর বেশি দিতে পারেননি। তাই সিনেমা শেষের দিকে এসে মনে হয় লক্ষ্যস্থল থেকে দুরে সরে যায়।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।
ব্যক্তিগত: ‘ন ডরাই’ ছিল এবছরের অন্যতম মুক্তিপ্রতিক্ষিত একটি ছবি। ছবিটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহের কমতি নেই। তবে সেন্সর সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ে সিনেমা মুক্তিতে বেশ খানিকটা ঝামেলায় পড়ে যায়, যার দরুণ ঢাকার বাইরে খুবই কম সংখ্যক হলে সিনেমাটি মুক্তি পেলো।
সবমিলিয়ে বলবো, একটা সিনেমাকে মাস্টারপিস আখ্যান দেওয়ার জন্য যা যা দরকার ‘ন ডরাই’ তার অলমোষ্ট সবকিছুই ছিল। কিন্তু ছবির চিত্রনাট্য ও এর ধীরগতির উপস্থাপনা একে আর পাঁচ-দশটি সাধারণ সিনেমার কাতারে ফেলে দিলো। দিনশেষে তানিম রহমান অংশু এর সবশেষ ছবি আমার যেমন লেগেছিল এটিও তেমনই লাগলো..
রেটিং: ৭/১০
তবে আমি খুব করে চাইবো আমাদের ৬৪ জেলার গল্প ৬৪ টি আলাদা সিনেমায় দেখতে। চাইবো সার্ফিং এর মতো অন্যান্য খেলা যেমনঃ দাবা, আর্চারি, শ্যুটিং ইত্যাদির গল্প বড়পর্দায় দেখতে। চাইবো কক্সবাজারের মতো সুন্দরবন, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর, সাজেক ভ্যালি, জাফলং, ভাসমান বাজার সহ অন্যান্য নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলি আমাদের বড়পর্দায় দেখতে।
ছবিটি কেন দেখবেন: প্রেম-ভালোবাসার সিনেমা তো অনেক দেখলেন, এবার একটু অন্যকিছু চেষ্টা করে আসুন। ভাষা কোনো ফ্যাক্ট না, কথা না বুঝলেও সিনেমার ভাষা আপনাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিবে। সিনেমাটোগ্রাফি, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আপনার চারপাশ মোহময় করে তুলবে। প্রত্যাশা কম নিয়ে যান, আশাকরি ভালো লাগবে।