Select Page

সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে’ তিনজনের সাজা

সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে’ তিনজনের সাজা

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী এই রায় ঘোষণা করেন।

১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের সামনে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সেই খুনের মামলায় ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আবদুল আজিজ, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আদনান সিদ্দিকীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি তিন জনকে ২ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে ১ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাদের।

মামলাটি থেকে খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন, এজাহারনামীয় তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, ফারুক আব্বাসী, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী।

রায় ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে সোহেল চৌধুরীর মেয়ে লামিয়া চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘…আমার বাবা তো ফেরত আসবে না। উনারা (অপরাধীরা) যেটা করেছেন, সেটার জবাব উনাদেরই দিতে হবে। উনাদের যাবজ্জীবন হোক কিংবা যেটাই হোক—বাবার মৃত্যু আমার জীবনে যে প্রভাব ফেলেছে, সেটা কোনোভাবেই পরিবর্তন হবে না। রিয়েলিটি নিয়েই আমাকে থাকতে হবে। এখন তাঁদের বিচারে আমাদের কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি, হবেও না।’

ঢাকাই সিনেমার তারকা জুটি সোহেল চৌধুরী ও দিতির দুই সন্তানের মধ্যে লামিয়া চৌধুরী বড়। ছেলে শাফায়েত চৌধুরী কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে করে ইউরোপে থিতু হয়েছেন। কানাডার টরন্টো ফিল্ম স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসে নির্মাণে মনোযোগী হয়েছিলেন লামিয়া। আর পুত্র শাফায়েত চৌধুরী কানাডায় শিক্ষাপর্ব শেষে এখন থাকেন ইউরোপে।

লামিয়া ইতোপূর্বে জানিয়েছেন, তার প্রথম সিনেমা ‘মেয়েদের গল্প’। যেটার নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে থাকছেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। আগামী অক্টোবরেই ছবিটির শুটিংয়ে নামবেন তারা।

ক্লাব আর মসজিদের দ্বন্দ্ব

বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের পশ্চিম পাশে ছিল একটি জামে মসজিদ। ওই ক্লাবে নাচ-গানসহ অসামাজিক কার্যকলাপ চলত। ক্লাবের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে স্থানীয় মুসল্লিদের পক্ষে অবস্থান নেন সোহেল চৌধুরী। তিনি মসজিদ কমিটির লোকজন নিয়ে ক্লাব বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝামেলা হয়। ট্রাম্প ক্লাবের কাজ ব্যাহত হলে সোহেল চৌধুরীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন আসামিরা।

২৪ জুলাই রাত। সোহেল চৌধুরী ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু সেই ক্লাবে যান। সেখানে বিতর্কিত ধনকুবের আজিজ মোহাম্মদ ভাইও ছিলেন। সেদিন রাতে বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করতে বলেছিলেন সোহেল চৌধুরী ও তাঁর বন্ধুরা। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেলের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী আজিজের ওপর ক্ষেপে যান। তখন সোহেলের বন্ধু কালা নাসির গুলি করতে যান আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে। এ সময় ক্লাবের শৌচাগারে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এই ট্রাম্প ক্লাবের মালিকানা ছিল বান্টি ইসলাম ও আশীষ চৌধুরীর।

সোহেলের বন্ধু গোলাম মোহাম্মদ বলেছিলেন, খুন হওয়ার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝগড়া হয়। বিষয়টি তাঁর সামনে ঘটেছিল। এ ছাড়া ট্রাম্প ক্লাবের বান্টি ইসলামের সঙ্গে সোহেলের দুই থেকে তিনবার ঝগড়া হয়। পরে তা মিটেও যায়। তবে আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি এড়ানো যায়নি। আশীষ চৌধুরীই সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দেন। ভবিষ্যতে সোহেলকে ক্লাবে না আসার জন্য হুমকিও দেন।

হত্যার আগে হুমকি

সোহেল চৌধুরী হত্যা নিয়ে তাঁর মা নূরজাহান বেগম আদালতকে বলেন, সোহেল খুন হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।

যেভাবে হত্যা করা হয়

সোহেল চৌধুরীকে হত্যার বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরে সোহেল চৌধুরী ক্লাবে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁকে ক্লাবে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে রাত তিনটার দিকে সোহেল চৌধুরী আবার ক্লাবের সামনে আসেন। তখন পেশাদার খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মামলার সাক্ষী আবুল কালাম পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন সোহেলসহ সাত থেকে আটজন লোক ক্লাবের সামনে গেলে হঠাৎ গুলি করা হয়। সোহেল চৌধুরীর পেটে গুলি লাগে। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেদিন গুলিবিদ্ধ হন নীরব ও দাইয়ান নামে আরও দুইজন।

চার্জশিটে যা বলা হয়েছিল

১৯৯৯ সালে গোয়েন্দা পুলিশ এই মামলার চার্জশিট দেয়। মামলাটি তখন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। চার্জশিটে বলা হয়েছিল, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই ট্রাম্প ক্লাবে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর বিভিন্ন ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়।

এজন্য আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলাম সোহেল চৌধুরীকে ‘শিক্ষা দিতে’ চান। ২৪ জুলাই ছাড়াও কয়েকবারই সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে ট্রাম্পস ক্লাবের অতিথি এবং কর্মীদের গোলমাল হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। ক্লাবটিতে অসামাজিক কার্যকলাপ, নাচ গান, মদ্যপান করা হত বলে চার্জশিটে উল্লেখ আছে। চার্জশিটে বলা হয়, মোট নয়জন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাদিয়া আফরিন শিল্পী জানিয়েছেন, চার্জশিটের পর ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এই মামলার।

নথি গায়েব, মামলার দীর্ঘায়িত কার্যক্রম

মামলায় অভিযোগ গঠন হবার পর বিচারের জন্য মামলাটি পাঠানো হয় ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। তখন মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একজন আসামি ২০০৩ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৪ সালে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুলসহ আদেশ দেন।

কিন্তু ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট আদালত রুলটি খারিজ করে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার আদেশ দেন। এর ফলে মামলার বিচার কাজ চালাতে আইনি বাধা দূর হয়। কিন্তু সেই আদেশ আর নিম্ন আদালতে পৌঁছায়নি।

২০২২ সালের শুরুতে নতুন করে গায়েব নথি উদ্ধারে একটি রিট করা হয়, আর তারপরই নতুন করে শুরু হয় মামলার কার্যক্রম। তারই চূড়ান্ত পরিণতিতে অবশেষে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির রায় ঘোষিত হলো।


মন্তব্য করুন