ন ডরাই : ঢেউয়ের মতো ওঠানামা
আজকাল ছবির দর্শকদের মধ্যে বিভক্তি এসেছে নতুনভাবে। একটা শ্রেণির দর্শক ‘ছবি’-র থেকে নির্মাতাকে বড় করে দেখে বা দেখার প্র্যাকটিস চালু করেছেন। তাদের কাছে নাম বড় কাজ নয়। তাই অনেকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে অমুক নির্মাতা তাই ছবি সেরা হতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তব আসলেই কঠিন। আপনি যখন দর্শক আপনাকে অমৃতের বিপরীতে গরলও হজম করতে হবে। তানিম রহমান অংশু নামটিকে ওজনদার মনে হয় কিন্তু দর্শক হিসেবে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে তাঁর ছবি দেখার অভিজ্ঞতা আপনার কাছে সবসময় সুখকর নাও হতে পারে।
‘ন ডরাই‘ স্টার সিনেপ্লেক্স প্রযোজিত এবং তানিম রহমান অংশু পরিচালিত ছবি। যে কারণে ছবিটি গুরুত্ব রাখে তা হচ্ছে ‘সার্ফিং’ নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম ছবি। যে কোনো নতুন শুরু নিয়ে একটা আলাদা অবস্থান থাকে। এরপরে সার্ফিং নিয়ে যত ছবি হবে ‘ন ডরাই’ প্রথম হিসেবে দলিল হয়ে থাকবে। দলিল হয়ে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য ছবি কিছুটা হলেও আলোচনার দাবিদার। তাছাড়া দেশের প্রথম নারী সার্ফার নাসিমা আকতারের বাস্তব জীবন থেকে অনুপ্রাণিত।
ছবির ভালোমন্দের দিকে যাবার আগে ছোট্ট করে কিছু কথা বলা যাক। ‘সার্ফিং’-কে এক লাইনে বলা যায় ‘ঢেউয়ের সাথে লড়াই।’ সার্ফ বোর্ডের আঠালো পদার্থের সাথে দাঁড়িয়ে থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে লড়াই করা। সার্ফিং বাংলাদেশের জন্য বেশিদিন আগের ট্রেন্ড নয় তবে বিশ্বে সার্ফিং-এর ইতিহাস অনেকদিনের পুরনো। ১৭৬৭ সালে বিট্রিশদের মাধ্যমে শুরু হয় এবং জেমস কিং নামে এক ভদ্রলোক প্রথম সার্ফার ছিল। বাংলাদেশে প্রথম নারী সার্ফার নাসিমা আকতার বিদেশে পুরস্কারপ্রাপ্ত। তাঁর উপরে ‘নাসিমা’ নামে একটি ডকুমেন্টারিও হয়েছে জাপান-বাংলাদেশ অর্থায়নে। তাঁকে দেখে আরো মেয়েরা সার্ফিং-এ উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
‘ন ডরাই’ সার্ফিং নিয়ে দেশে নির্মিত ছবি তাই সমুদ্রের জন্য কক্সবাজারই এর পারফেক্ট লোকেশন হবে এটা জানা কথা।
দেশি-বিদেশি অভিনয়শিল্পীদের ব্যবহার হয়েছে প্রয়োজন মতেই।
আগেই বলা হয়েছে যেহেতু সার্ফিং নিয়ে প্রথম ছবি তাই অ্যাপ্রিশিয়েট থাকবে ছবির জন্য। কিন্তু ছবির স্টোরি টেলিং যাকে আমরা ছবির এগিয়ে যাবার চালিকাশক্তি বলতে পারি এখানে সীমাবদ্ধতা যথেষ্ট। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি ক্ষেত্রবিশেষে চমৎকার, গানের প্লেস যথার্থ। ‘সার্ফিং’ যেমন ঢেউ নিয়ে খেলা করা বোঝায় ছবির ভালোমন্দও যেন ঢেউয়ের মতো ওঠানামায় পরিণত হয়েছে। ছবির ফার্স্ট
হাফ গল্পকে ধরতে সাহায্য করলেও সেকেন্ড হাফ স্লো হয়ে গেছে। সীমাবদ্ধতাগুলো পয়েন্ট আউট করলে দাঁড়ায় –
* ‘ন ডরাই’ নামকরণের প্রকৃত সার্থকতা নেই।
* নারী চরিত্রের অনুপ্রেরণায় নির্মিত হলেও ছবির গল্পে ভিন্ন কিছু। women empowerment যেটা দাবি করে গল্পে কিন্তু তা নেই।
* সার্ফিং-এর প্রশিক্ষণ দৃশ্যের কমতি।
* বিদেশিদের মধ্যে একজন বাদে বাকিদের দুর্বল অভিনয়।
* চট্টগ্রামের ভাষার মিশ্র উপস্থাপন।
* ‘সার্ফিং-এর আন্তর্জাতিক পর্যায় না দেখানো।
* অহেতুক স্ল্যাং ব্যবহার।
* নায়ক-নায়িকার চরিত্রের দুর্বল পরিণতি।
* দুর্বল ক্লাইমেক্স।
সবচেয়ে বড় দুটি সীমাবদ্ধতা একদম চোখে লাগার মতো –
১. চট্টগ্রামের মতো দুর্বোধ্য আঞ্চলিক ভাষার ছবিতে সাব-টাইটেল ব্যবহার না করা। ‘হালদা’-তেও সাব-টাইটেল ছিল। পরিচালক তৌকির আহমেদ চট্টগ্রামের একেবারে ‘raw accent’ রাখেননি দর্শক বুঝতে পারবে না বলে। যেটুকু রেখেছেন সাব-টাইটেল দিয়েছেন সংলাপ বোঝার সুবিধার্থে। ‘ন ডরাই’-তে না রাখাটা অনেক বড় ভুল।
২. স্টার সিনেপ্লেক্সের ছবিতে বাজেটের অভাব হবার কথা না। অথচ ‘সার্ফিং’-কে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে দেখা গেল না ছবিতে। ছবির গল্পে একটা জায়গার কথা বলা হলেও দেশের বাইরের কোনো স্যুটিং করা হয়নি বিষয়টা বিস্মিত করেছে।
অভিনয়ের কথা বললে শরিফুল রাজ ও সুনেরাহ বিনতে কামাল দুজনই ডেডিকেটেড কিন্তু তাদেরকে স্ট্রং ক্যারেক্টরাইজেশনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সাঈদ বাবু অভিনয়টা করে গেছে কোনো বিশেষত্ব ছাড়া। বিদেশিদের মধ্যে রাজের বিপরীতে থাকা অভিনেত্রীর অভিনয় চলনসই তাছাড়া বাকিরা দুর্বল কারণ তাদের অভিনয় বলে দিয়েছে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। অন্যান্য চরিত্রগুলো গুরুত্ব রাখে না।
‘ন ডরাই’ সার্ফিং-কে এগিয়ে নিতে একটা ফিল্ম মুভমেন্ট, এর বেশি কিছু না।
রেটিং – ৫/১০