পদ্মাপুরাণ: নদী ও নারী
নদী হইল মাইয়া মাইনশের মতোন তারে চান্দে চান্দে বইয়া যাইতে দিতে হয়..♥
সংলাপটি নদীর বহমানতার কথা বলেছে। আধুনিক সভ্যতার এ সময়ে নদী বিলীন হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘পদ্মাপুরাণ’ (২০২১) নদীর আবহমান গুরুত্ব তুলে ধরেছে। শুধু নদীর গুরুত্বই নয় নারীর গল্পও হয়ে উঠেছে।
নদীকেন্দ্রিক ছবি অনেক হয়েছে আমাদের চলচ্চিত্রে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম, চিত্রা নদীর পারে, নদীর নাম মধুমতী, মধুমতী, হালদা’ সহ আরো অনেক। এত ছবির ভিড়ে ‘পদ্মাপুরাণ’ কেন মন রাখবে দর্শক বা এ ছবিতে নতুন কী দেখানো হলো এটাই ছবিটির আলোচনার বিষয় এ মুহূর্তে।
‘পদ্মাপুরাণ’ নতুন কিছু দেখানোর চেষ্টা করেছে নদীকেন্দ্রিক জীবনের গল্পে। নদীর তীরেই পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতার গড়ে ওঠা তাই নদীতীরে জনজীবন থাকে। তাদের গল্পে রচিত হয় জীবনগাঁথা। সেই জীবনগাঁথাই ছবির গল্প। ‘পুরাণ’ সম্পর্কে বললে তাত্ত্বিকতা চলে আসবে। এটি হচ্ছে মিশ্র শিল্প যেখানে সাহিত্য, ধর্ম, ঐতিহ্য, দার্শনিকতা অনেককিছু থাকে। ছবির নামে ‘পদ্মা’-র সাথে ‘পুরাণ’ যোগ করার মধ্যে এই মিশ্র বিষয়টির উপস্থাপনা আছে। পরিচালক রাশিদ পলাশ ভালো একটি নিরীক্ষা করেছেন।
ছবির গল্পে একাধিক গল্প আছে। মানে গল্পের ভেতর গল্প। নদীতীরবর্তী নারীর গল্প। একজন নারীর জীবনে আসা পুরুষের গল্প এবং বাস্তবতারও। গল্পের চমৎকার দিকটি হচ্ছে একটা গল্প শেষ করে আরেকটিতে ঢুকে যাওয়া এবং দুটি গল্পকেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা। দর্শক ছবি দেখেই বরং জেনে নিক কি কি ছিল গল্পগুলো।
একটি বিশেষ শ্রেণি যাকে সমাজে অবহেলা করা হয় তার মানবিক উপস্থাপনায় ছবিতে মেসেজ দেয়া হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে নারীর নিজের জীবনযুদ্ধকে দেখাতে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রটি নীরবে প্রতিবাদ করেছে। এর জন্য তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে তার সৌন্দর্য মাথার চুল। এটি ছিল ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সৃষ্টিকর্তাকে তুলে ধরা হয়েছে যৌক্তিকভাবে। নদী তো নিজেই একটা সাহিত্য তাকে তুলে ধরতে মানুষ, প্রকৃতি, ধর্ম, দার্শনিকতাকে একখানে এনে ‘পদ্মাপুরাণ’ হার না মানা নদীর গল্পই হয়ে উঠেছে।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র সাদিয়া মাহি তার চরিত্রের জন্য মাথার চুল বিসর্জন দিয়েছে এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। নদীর সাথে তার কথোপকথন তার চরিত্রটির বিশেষ দিক ছিল। তার অভিনয় ন্যাচারাল এবং ভবিষ্যত ভালো। সুমিত সেনগুপ্তকে প্রথমবারের মতো ব্যতিক্রমী লুকে দেখা গেল এবং তার অভিনয়ও ভালো ছিল। প্রসূন আজাদ আফসোসের নামই বটে। চরিত্র যাই দিক ফুটিয়ে তোলার সক্ষমতা আছে, এ ছবিতেও তাই। তাকে প্রধান চরিত্রে সুযোগ দেয়া উচিত। জয়রাজ তো ভালো অভিনেতাই। শম্পা রেজা ছবির দুর্বল পার্ট ছিল কারণ তাকে যে চরিত্রটি দেয়া হয়েছে তিনি সেটা ঠিকমতো ক্যারি করতে পারেননি, বলতে গেলে তিনি চরিত্রটিকে প্রাণ দিতে পারেননি, অ্যাকসেন্টেও সমস্যা ছিল। সিনেমাটোগ্রাফি নদীর কারণে বাড়তি প্লাসপয়েন্ট ছিল, বেশ ভালো। ছবির গানের মধ্যে ‘শোনাতে এসেছি আজ পদ্মাপুরাণ’ এবং ‘নোনা’ চমৎকার। ছবিতে একাধিক ভালো সংলাপ ছিল। প্রসূন আজাদের মুখে-’মাইয়া মাইনশের মাংস সব শালায় খায়’ খুবই অর্থবহ ছিল।
রাশিদ পলাশ একটি পরিচ্ছন্ন ভালো ছবি নির্মাণ করেছেন এবং ‘পদ্মা’-র মতো দেশের প্রধান একটি নদীকে নিয়ে ছবিটি ডকুমেন্ট হয়ে গেল যা ছবিটির জন্য নদীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রে অবশ্যই রেফারেন্স হিসেবে থাকবে।
রেটিং – ৮/১০