পরাণ: বছরের সেরা প্রেমের গল্প!
কিছু অসংগতি বাদ দিলে ‘পরাণ’ অল্প বাজেটে, ভালো অভিনয় ও গল্পে বছরের সেরা প্রেমের সিনেমা হবে বলে মনে হচ্ছে
কোরবানির ঈদে এমনিতেই চাপ বেশি থাকে, ফুরসত মেলে না সময়ের। তবে যে নির্মাতার ওপর আস্থা রাখা যায়, তার সিনেমা দেখার জন্য সময় বের হয়ে যায় আপনাতেই। ‘পোড়ামন টু’র পর ‘দহন’, এরপর লম্বা বিরতি।
রায়হান রাফী সিনেমার বড়পর্দায় না আসলেও ওটিটিতে কাজ করছিলেন একের পর এক। তবে করোনার আগে শুট হওয়া ‘পরাণ’-এর জন্য অপেক্ষাটা একটু বেশিই দীর্ঘ হয়ে গেল। অপেক্ষার ফল নাকি মিষ্টি হয়। কিছু অসংগতি বাদ দিলে ‘পরাণ’ অল্প বাজেটে, ভালো অভিনয় ও গল্পে বছরের সেরা প্রেমের সিনেমা হবে বলে মনে হচ্ছে।
‘পরাণ’-এর গল্প ট্রেলার থেকে আপনি, আমি, আমরা যা ভেবেছি তার থেকে একেবারে আলাদা কিছু না। তাহলে সেটা সিনেমা হলে কেন দেখব! কারণ আমরা যা ভেবেছি গল্পটা হুবহু তাও না।
পত্রিকার ঘটনা বা সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল ভিডিও দেখে হুবহু সিনেমা বানালে পত্রিকা পড়লেই হতো, সিনেমা কেন দেখব! ‘পোড়ামন টু’, ‘দহন’ কিংবা ওয়েবে জনপ্রিয় ‘জানোয়ার’ এই সবক’টাই বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত বা অবলম্বনে নির্মিত। কিন্তু রাফী তার নির্মাণে নিজের মতো করে গল্পে চরিত্রের শেড, ক্লাইম্যাক্স টুইস্ট এবং সিনেমাটিক অ্যাঙ্গেল তৈরি করেছেন ড্রামা ব্যবহার করে।
‘অনন্যা’ পড়াশোনায় একেবারেই অমনোযোগী একটা মেয়ে। পরীক্ষায় নিয়মিত ফেল করা তার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার যেন। তাই বাবা বলে দেন, পরেরবার ফেল করলে বিয়ে দিয়ে দেবেন। অনন্যাকে বিরক্ত করে এলাকার বখাটে ‘রোমান’। ডেইজি সরকারের ছত্রছায়ায় রোমান হয়ে উঠেছে এলাকার ত্রাস, পুলিশও তার গায়ে হাত দেয় না। পাশ করে মুখ দেখাতে অনন্যা বাধ্য হয় পরীক্ষায় রোমানের সাহায্য নিয়ে পাশ করতে। পরীক্ষায় পাশ করে রোমানের সাথে প্রেমে মশগুল হওয়া অনন্যার জীবনে কয়েক বছরেই ঘটে কিছু অপ্রত্যাশিত, হৃদয় বিদারক ঘটনা। সিনেমার শুরুতে আত্মহত্যার চেষ্টা করা অনন্যা একসময় পুলিশকে বলতে থাকে রোমানের সাথে জটিল এক সম্পর্কের গল্প যেখানে আছে অন্য আরেকজন, ‘সিফাত’-এর উপস্থিতি।
একটি নিখাদ প্রেম, প্রেমের জটিলতা, স্বার্থরক্ষায় প্রেম কিংবা বিরহের অন্ধকার গলির গল্পই ‘পরাণ’। রাফী খুব কম বাজেটে সিনেমাটি বানিয়েছেন সেটা কাস্টিং, সেট ডিজাইন কিংবা পারিপার্শ্বিক আয়োজন দেখলে বোঝা যায়। তবে গল্প আর পারফরম্যান্স সব সীমাবদ্ধতাকে ভুলিয়ে রেখেছিল আড়াই ঘণ্টার বেশি সময়।
‘অনন্যা’, ‘রোমান’, ‘সিফাত’-এর প্রেমের জটিল সম্পর্ক আমাদের আশপাশেরই গল্প। ‘পরাণ’ একেবারেই দেশি সিনেমার অকৃত্রিম স্বাদ দিয়েছে এর ডায়ালগে, আয়োজনে। আর কাস্টিংয়ে বড় কোন সুপারস্টার না থাকলেও, দীর্ঘসময় ধরে মিডিয়ায় কাজ করা মিম আর অপেক্ষাকৃত জুনিয়র রাজ আর ইয়াশ যার যার জায়গায় খাপে খাপ মিলে গিয়ে অভিনয় করেছেন।
হল থেকে বের হয়ে আপনার মনে হতেই পারে, এই তিনজনের জায়গায় অন্য আর কেউ থাকলে এত ভালো হতো না! মিম অফট্র্যাক আর বাণিজ্যিক দুই ধারাতেই কাজ করেছেন। এখানেও তার অভিনয়ে বাচ্চামি, ঢং, দ্বিধাগ্রস্ততা উপভোগ করেছি এক্সপ্রেশনে। এ বছরের সিনেমার যে কোন পুরস্কারের মনোনয়নে রাজের নাম না থাকলে খুব অবাক হবো। ‘রোমান’ থেকে একটা মুহূর্তও রাজকে যেন আলাদা করা যাচ্ছিল না। বাস্তবে ইয়াশ রোহান যেমন, সিফাত হিসেবেও সে তাই হয়ে থেকেছে।
এবার যদি বলি, সিনেমায় চমকটা কী! শহীদুজ্জামান সেলিম, শিল্পী সরকার অপু, মিলি বাশার বা লুৎফর রহমান জর্জ না, পারফর্ম করে চমক দেখিয়েছেন রোজী সিদ্দিকী আর নাসির উদ্দিন খান। আইনি আর বেআইনি পথে এই দুটি চরিত্র ছিল মনে রাখবার মতো। রাশেদ মামুন অপু রোমানের বন্ধু হিসেবে তোতলামি আয়ত্ত করা ভাষায় হাসিয়েছেন পুরো হল।
ট্রেলারে যাদের ডায়ালগ ভালো লেগেছে, তারা পুরো সিনেমায় আরও অনেক মজা পাবেন একের পর এক কমেডি, হিউমার আর ডার্ক ডায়ালগে। ‘চলো নিরালায়’ আর ‘সাজিয়ে গুজিয়ে’ গান দুটি ভালো লেগেছে। ক্যামেরার কাজ আর সম্পাদনা ভালো হলেও কালার গ্রেডিং ছিল বেশ ডার্ক শেডে গ্রিন।
সিনেমায় বিজিএম অনেকখানে ব্যবহৃত হয়নি। ভালো লেগেছে নিজের শহর ময়মনসিংহকে সিনেমার বড়পর্দায় পুরোটা সময় দেখাটা। ঈদের সিনেমা হিসাবে ‘পরাণ’ এর আরও হল পাওয়া দরকার ছিল। কম বাজেটেও মানসম্মত সিনেমা যে দর্শকের মনের মতো করে বানানো যায়, সেই বার্তা দিল ‘পরাণ’!