Select Page

পরাধীনতা ও কর্তৃত্ববিরোধী ফাগুন হাওয়া

পরাধীনতা ও কর্তৃত্ববিরোধী ফাগুন হাওয়া

ফাগুন হাওয়ায়’, কেবল বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম প্রচেষ্টা। তৌকীর আহমেদ টিটো রহমানের ‘বউ কথা কও’ গল্প অবলম্বনে একজন পাকিস্তানি পুলিশ কর্মকর্তার বাংলা ভাষার প্রতি ঘৃণার স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। ছবির শুরু থেকেই এক ধরনের সিম্বোলিজমের মধ্য দিয়ে এক পাশ থেকে পরাধীনতার এবং অন্য পাশ থেকে কর্তৃত্ত্বের চিত্র দেখানো হয়েছে। যে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে ছবির পাত্র-পাত্রীরা বদ্ধপরিকর ছিল।

ছবির শুরুর দৃশ্যেই দেখা যায় একজন যুবক এক পাখি বিক্রেতাকে খাঁচায় বন্দী পাখিটি মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান। এখানে খাঁচায় বন্দী পাখিটি পরাধীনতার প্রতীক। খাঁচায় বন্দী এই পাখিকে আমরা কয়েকটি দৃশ্যের পর মুক্তি পেতে দেখলেও ততক্ষণে দেখতে পাই ছবির অন্য পাত্র-পাত্রীরা জামশেদ নামক এক খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে গেছে।

আমরা যখন থেকে ছবির প্রধান চরিত্র জামশেদের (যশপাল শর্মা) সাথে পরিচিত হই, তখন থেকেই দেখেতে পাই তিনি বাংলা ভাষাকে কতটা ঘৃণা করেন। জামশেদ পানিশমেন্টে খুলনায় বদলি হয়ে আসা পুলিশ অফিসার। চিত্রনাট্যের গুনে তার বদমেজাজী ও কর্তৃত্ব-পরায়ণ ভাব ফুটে ওঠেছে পুরো ছবি জুড়ে। শুরুতেই লঞ্চে তিনি বাংলা ভাষায় গান করার জন্য এক বাউলকে চড় দিয়ে বসেন। তার ঝাড়ুদারকে সে কোন ভাষায় কথা বলে জিজ্ঞেস করলে সে যখন উত্তর দেয় “মাতৃভাষা, মায়ের ভাষা”, তখন তিনি তাকে আদেশের সুরে বলেন, “মায়ের ভাষা কিছু না, উর্দু শিখো, উর্দু বলো”। থানার সকলকে বাধ্যতামূলক উর্দু শিখার ক্লাস করতে বসিয়ে দেন। তিনি এই পাড়াগাঁয়ে বসে প্রধানমন্ত্রী বরাবর সর্বস্তরে উর্দু ব্যবহারের আদেশ জারি করার অনুরোধ করে চিঠি লিখেন। পরবর্তীকালে খাজা নাজিমউদ্দীনের “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” এই ঘোষণা শুনে তিনি সকলের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেন।

কালক্রমে সেই ঘৃণা এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে তিনি পাখির কণ্ঠেও বাংলা বাদ দিয়ে উর্দু শোনতে চান। এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় এভাবে – তিনি উর্দু পাঠদানরত মৌলভীকে জিজ্ঞাসা করেন গাছে বসে থাকা পাখির নাম কি? মৌলভীর উত্তর ছিল “বউ কথা কও”, তিনি যার উর্দু অনুবাদ করেন “বিবি, বাত করো”। এরপর তিনি “এ পারিন্দা ভি বাংলা বোলতা হ্যায়? (এই পাখিটাও বাংলায় কথা বলে?)” বলে পাখির উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়েন এবং পাখিটি ধরে আনতে আদেশ করেন। এমনকি তিনি প্রধানমন্ত্রী বরাবর পুনরায় চিঠি লিখেন পাখিদেরও উর্দু ভাষায় কথা বলার আইন জারি করতে।

অন্যদিকে, আমরা দেখতে পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র নাসিরকে (সিয়াম আহমেদ), যে পরীক্ষা শেষে ছুটি পেয়ে গ্রামে ফিরছে এবং শুরু থেকেই জামশেদের কর্মকাণ্ডে বাধা দিয়ে এসেছে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে। সে লঞ্চে জামশেদ বাউলকে চড় দিয়ে গান গাওয়া থামিয়ে দিলে নিজেই দোতারা নিয়ে গান ধরে। গ্রামে এসে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পন’ নাটকের মঞ্চায়নের জন্য মহড়া করে। ওসির আদেশ উপেক্ষা করে সে নাটক মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নেয়। তার সঙ্গী হয় ঢাকা থেকে ঠাকুরদাদার (আবুল হায়াত) সাথে আগত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী দীপ্তি (নুসরাত ইমরোজ তিশা)। জমে ওঠে তাদের রসায়ন ও জামশেদের বিরোধিতা। তাছাড়া জামশেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গোপন বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় তার অধঃস্তন দুই কর্মকর্তার তার লেখা চিঠি পুড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির জামশেদের মত সেসময়ে কেউ এমন পাগলামি করেছিল কিনা, অর্থাৎ এর ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই, কিংবা তা থাকলেই কি বা যায় আসে, ধরে নিই এটা নিছকই কল্পকাহিনি (ফিকশন)। তবে তৌকীর আহমেদ ভাষা আন্দোলনের সময়টাকে যথাযথভাবে তুলে এনেছেন তার ইমাজিন্যারি দক্ষতা দিয়ে। ছবির প্রধান বিষয় ভাষা আন্দোলন, যা ১৯৪৮ সালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ’র ঘোষণার পর থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে এবং ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের ঘোষণার পর তা প্রকট রূপ ধারণ করে।

পঞ্চাশের দশকের শুরুর সময়কালকে ধরতে তৌকীর আহমেদ খুলনায় গ্রামের পটভূমিতে ছবির দৃশ্য ধারণ করেছেন। গ্রামের মেঠো পথ, বাঁশের সাঁকো, সেট ডিজাইন, পুরনো দিনের অভিজাত বাড়ি নেওয়া হয়েছে দৃশ্যধারণের স্বার্থে। ভাষা আন্দোলনের থমথমে পরিস্থিতি দেখা যায় দেয়াল লিখন এবং রাতে দেয়াল লিখন বিরোধী পুলিশি টহল এবং ফেস্টুন হাতে মিছিল হতে। মিছিলের টপ শটগুলোতে ছিল নান্দনিকতার ছাপ।

এই ছবির সেরা কাজ উপহার দিয়েছেন যশপাল শর্মা। তার চরিত্রের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি তার ঘৃণা এবং সর্বস্তরে উর্দুর ব্যবহারের আদেশ যেন জিন্নাহ কিংবা নাজিমউদ্দীনের ঘোষণার রূপক বলে মনে হয়। পাশাপাশি উর্দু সংস্কৃতির ব্যবহার দেখা যায় তার কলের গানের রেকর্ডে। তবে ছবিটিতে ব্যবহৃত ভাষাটিতে উর্দুর চেয়ে হিন্দিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কয়েক বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘গেরিলা’ ছবিতে শতাব্দী ওয়াদুদের মুখে আমরা যেমন প্রাসঙ্গিক ও সঠিক উর্দুর ব্যবহার পেয়েছিলাম, এই ছবিতে ঠিক তেমনটা পাইনি। ছবির অন্য দুই প্রধান চরিত্র সিয়াম ও তিশার কাছ থেকে সাবলীল অভিনয় পেয়েছি এবং তাদের রসায়ন জমে ওঠলেও যশপাল শর্মার অভিনয়ের কাছে তা ম্লান হয়ে যায়। তবে বাংলা ভাষী চরিত্রের মধ্যে সেরা কাজ দেখিয়েছেন বর্ষীয়ান আবুল হায়াত। সম্ভ্রান্ত হিন্দু ডাক্তার চরিত্রে তার কাজ দেখে বোধ জন্মে যে তিনি এই চরিত্রটি বিলং করেন। ফজলুর রহমান বাবুর স্ক্রিনটাইম ও চরিত্রের গভীরতা অল্প ছিল, কিন্তু তিনি তার সহজাত অভিনয় করেছেন। তবে তার বোবা মেয়ের চরিত্রে তন্বীর স্ক্রিনটাইম অল্প হলেও তা যথেষ্ট অর্থবহ ছিল। মুসলিম লীগের পান্ডা চরিত্রে রওনক হাসানের চরিত্র শেষভাগে ভয়ানক খল আকার ধারণ করে। শহীদুল আলম সাচ্চুর ভাঙা ভাঙা উর্দু পীড়া দিয়েছে। অন্যদিকে, ফারুক আহমেদ ও সাজু খাদেমের চরিত্র কমিক রিলিফ দিয়েছে।

তৌকীর আহমেদ টিটো রহমানের গল্পের যথাযথ চলচ্চিত্রায়ন ঘটিয়েছেন। ছবির শুরুটা পরাধীনতা দিয়ে শুরু হলেও এই পরাধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রাম ছিল চলচ্চিত্র জুড়ে। এমনকি দুটি ভিন্ন ধর্মের দুই যুবক-যুবতীর প্রণয়ের সম্পর্ককেও টিকিয়ে রাখা হয়েছে। শেষভাগে এসে জামশেদের কর্তৃত্ব-পরায়ণতা থেকে মুক্তি পেতে দেখা যায়, যখন ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আগমনরত মিছিলের ভয়ে তিনি বাংলা ভাষায় তার অধঃস্তনদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। সর্বোপরি, ছবিটিতে বাংলা ভাষার প্রতি বাঙ্গালির মমত্ববোধ ও যে কোন মূল্যে ভাষার মান রাখতে সংকল্প ও সংঘবদ্ধতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।


Leave a reply