Select Page

ফাগুন হাওয়ায়- আরও আসুক এ রকম হাওয়া

ফাগুন হাওয়ায়- আরও আসুক এ রকম হাওয়া

যে সিনেমাটা ২০০৬, ০৭ বা ০৮ এর দিকে তৌকির আহমেদ বানানোর প্ল্যান করেছিলেন,সেই সিনেমাটা মুক্তি পেতে ২০১৯ হয়ে গেল। শুধু তাই না, অনুদানের জন্য আবেদন করেও তিনি এই দেশে ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি সিনেমার নির্মাণের জন্য অনুদান পাননি। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে, অনুদান না পেয়েই তৌকির নিজের স্বপ্নটাকে মেরে ফেলেননি। বরং দীর্ঘ সময় ধরে সেই গল্পকে লালন করে অবশেষে ভাষার মাসেই মুক্তি দিয়েছেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত সিনেমা ফাগুন হাওয়ায়

খুব আহামরি গল্প না ফাগুন হাওয়ার। পশ্চিম পাকিস্তানী এক পুলিশ অফিসার একটি মফস্বল শহরে এসে ঘোষণা করেন, এখানে কোন বাংলা চলবে না। সবাইকে উর্দুতে কথা বলতে হবে, এমনকি পশুপাখিকেও (মামা বাড়ির আবদার যেন!) এই অন্যায় আবদার বলা বাহুল্য সবাই মেনে নেয়নি।যদিও সময়টা এমন ছিল যে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করাটা অনেকটাই খাল কেটে কুমির ডেকে আনার মতো। তবে নীরবে প্রতিবাদ ঠিকই চলছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্য থেকে।

টিটো রহমানের ছোট গল্প বউ কথা কও থেকে দুই ঘণ্টার একটু বেশি দৈর্ঘের সিনেমাটি চমৎকার লাগে দেখতে তৌকির আহমেদের দারুণ চিত্রনাট্য আর পরিচালনার কারণে। তৌকির নিঃসন্দেহে চমৎকার একজন পরিচালক, তবে আমার কাছে তাকে এর চেয়েও চমৎকার লাগে একজন লেখক হিসেবে। পিরিয়ডিক ফিল্মের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেই সময়টাকে পর্দায় হাজির করা।বারবার মনে হচ্ছিল ১৯৫২ তেই ফিরে গেছি। সিনেমার সেটিং ঢাকা শহরে না করে পাইকগাছার এক প্রত্যন্ত গ্রামে করে তৌকির ও তার টিম বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন এক্ষেত্রে। কস্টিউম, গাড়ি ও আসবাবের ক্ষেত্রেও একই যত্নের ছাপ।

তৌকির আহমেদ অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবসময় দক্ষ মানুষদের নিয়ে কাজ করেন কারণ এতে সময় কম লাগে, এই কথাটা তিনি বারবারই বলেছেন।যশপাল শর্মাকে সিনেমাতে যতবার দেখানো হয়েছে, আমার মনে হয়েছে স্ক্রিনে একটা বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে! এত দারুণ অভিনয়। মনে হচ্ছিল পুরো সিনেমা তিনি একাই টানছেন।বাকিরাও যার যার মতো করে সুন্দর কাজ করেছেন।

সিয়ামের কথা আলাদা করে বলতে চাই, কারণ নিজের তৃতীয় সিনেমাতে এই ধরনের ক্যারেক্টার করতে গাটস লাগে আসলে।বারংবার হুঙ্কারের মুখেও কখনই উর্দু না বলার যে দৃঢ় প্রত্যয় যে তিনি তার চেহারা আর বডি ল্যাংগুয়েজে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।সাজু খাদেম অল্প সময়ে অনেক বিনোদন দিয়েছেন। এই মানুষটার প্রতিভার তেমন কিছুই আমরা ব্যবহার করতে পারিনি এখনও।

আলাদা করে বলতে চাই ঝুমুর ক্যারেক্টারে অভিনয় করা তন্বীর কথা। বোবা ক্যারেক্টারে খুবই ম্যচিউর পারফর্মেন্স ছিল তার। ছোট্ট একটা রোলে ছিলেন ফজলুর রহমান বাবু।মাতাল হয়ে যখন বাবু ভাই যশপাল শর্মার সামনে এসে তাকে গালিগালাজ করতে থাকেন, তখন ততটুকু সময়ে বাবু ভাইয়ের কাজ দেখে একটা কথাই মনে হচ্ছে- হ্যাঁ, আপনাদের বলিউডের অনেক অসাধারণ অভিনেতা থাকতে পারেন; তবে আমাদের ফজলুর রহমান বাবু আপনাদের কারো থেকে কম যাবেন না!

ফাগুন হাওয়ায় ভাষার মর্যাদা আর ভাষাকে রক্ষা করতে শহীদদের আত্মত্যাগের কথা বলার ছাড়াও আরেকটা ব্যাপারেও ইঙ্গিত করে। কোন কিছুর বাড়াবাড়ি যে মানুষের হিতাহিত জ্ঞানকে লোপ করে দেয়, সেটা এই সিনেমাতে খুবই সূক্ষ্মভাবে দেখানো হয়েছে। পাকিস্তানী অফিসারের প্রতি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিশ্বাসের কারণে জমাদার নিজের মেয়েকে তার ঘরদোর পরিস্কারের কাজে নিয়োগ দেয়, আর দিনশেষে তার এই অতিরিক্ত বিশ্বাসই তাকে এক ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি করে। আর অন্যদিকে, উর্দু ভাষার প্রতি অন্ধ ভক্তি একজন অফিসারের মস্তিষ্ক থেকে এই বোধটাও লোপ করে দেয় যে, পশুপাখিরও নিজস্ব ভাষা বলে কিছু আছে, কেউ বললেই বা গুলি করলেই সে উর্দু বলা শুরু করবে না!

দুটো প্রচণ্ড পছন্দের দৃশ্য বলি এই সিনেমার- পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা যশপাল শর্মার চিঠি ডাকে পোস্ট করার আগে সেই চিঠি পুড়িয়ে সেই আগুন দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছেন কনস্টেবল- গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এই সিনে!

সবাইকে মিছিলে যেতে দেখে তিশা আবুল হায়াতের হাত ধরে আকুতি করেন- ঠাকুরদা, আমিও মিছিলে যেতে চাই। এরপরের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর টপ শটে তিশার দৌড়ে যাওয়া- বারবার যেন অনুভব করছিলাম বাংলা ভাষাকে কত কষ্টের মাঝ দিয়ে আসতে হয়েছে!

ফাগুন হাওয়ায় সিনেমার প্রচার হয়ত কিছুটা কম হতে পারে, তবে একেবারেই হয়নি সেটা বলা যাবে না।তৌকির আহমেদ এমনিতেই প্রচারবিমুখ মানুষ, তবে পরিচালনার কাজে তিনি নিজের সেরাটা দেন। দর্শক হিসেবে আপনার আমার দায়িত্ব এই সিনেমাটা হলে গিয়ে দেখা। সবচেয়ে ভাল হবে যদি যেকোনো সিনেপ্লেক্সের চকচকে পর্দায় আপনি এই সিনেমাটা দেখেন। তানাহলে অন্যান্য হলে সিনেমাটি দেখলে রাতের দৃশ্য বেশিরভাগই আপনি বুঝবেন না।নিজের ভাষাকে আরেকবার স্মরণ করার জন্য হলেও এই সিনেমাটি আপনার দেখা উচিত। ভাষার ব্যাপারে আপনার ভালোবাসা যদি ভাসা ভাসা হয়, তাহলে আপনার অস্তিত্ব একদিন কোথায় ভেসে যাবে, সেটা হয়ত আপনি নিজেই টের পাবেন না!

পুনশ্চ- ফেনীর কানন সিনেমা হলে বাইরে ফাগুন হাওয়ায় এর পোস্টার টানানো থাকলেও ভেতরে চলছে অশ্লীল সিনেমা “কাল্লু মামা”। মানুষের কী পরিমাণ নিচ হতে পারে, এই ধরনের কাজ দেখলে টের পাই। তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এদের পূর্বপুরুষই কি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল?
১৯৫২ সালের একটি রেডিও সিনেমাতে দেখানোর জন্য তৌকির আহমেদ ২০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। সিনেমা নির্মাণ আসলেই এই দেশে একটা যুদ্ধ। তবে সেই যুদ্ধে তৌকির আহমেদকে দিনদিন আরও সফল যোদ্ধা বানানোর দায়িত্ব কিন্তু দর্শকেরই! আরও আসুক ফাগুন হাওয়ার মতো সিনেমা!


মন্তব্য করুন