নীরবতাই সব বলে দেয়
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর শেষ কিছু সিনেমা দেখে আশা প্রায় হারিয়েই বসেছিলাম বলে তার নাওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীকে নিয়ে আসন্ন মুভিটা নিয়ে একেবারেই প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু ওয়েব সিরিজ ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’-এ এসে তিনি আবারও তার যাদু দেখিয়ে দিলেন।
প্রথম ৪ এপিসোড মুগ্ধ হয়ে খেয়েছি, যার মূল কারণ— আমার কাছে তাসনিয়া ফারিণ। এই তরুণ অভিনেত্রীকে নাটকে হালকাপাতলা দেখেছি, তবে এটা দিয়ে সে সম্পূর্ণ আমার মন জয় করে নিয়েছে। তারপর কিংবদন্তি আফজাল হোসেন। বস লেভেলের মানুষ না হলে এমন একটা চরিত্র দিয়ে প্রত্যাবর্তনে রাজি হতেন না। সাধুবাদ কাস্টিংকে। এই দুইটা মূল চরিত্র ও তাদের বোঝাপড়া দুর্দান্ত। তারপর সেরা চরিত্র হাসান মাসুদ। এই ভদ্রলোকের চরিত্রায়ন ও তার অভিনয় একদম খাপে খাপ। একজন ক্লার্কের ভূমিকায় শুরুতে সামান্য মনে হলেও তার প্রতিটা দৃশ্য সিরিজের প্লাস পয়েন্ট।
সবকিছুর উর্ধ্বে ফারুকীর পরিচালনায় ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং এখানে প্রাণবন্ত লেগেছে। এর আগে তার বাহিরের কাজ থেকে অনুপ্রেরণালব্ধ প্রয়োগ কিছুটা গিমিকি লাগতো। এই প্রথম তাকে যেন পরিণত মনে হলো। এপিসোডগুলোর কয়েকটার নামেও তার প্রিয় পরিচালকের সিনেমার নাম। বাংলাদেশি কনটেন্টে সংলাপের দুর্বলতাও এখানে আর নেই। সবাই সংলাপ ডেলিভারিতে যত্নবান ছিলেন, তাই মূল ড্রামাটা খুবই বিশ্বাসযোগ্য।
হিউমারের ব্যবহারও পরিমিত। সাধুবাদ দিতে হয় চিরকুটের ড্রামার পাভেল আরিনকে। ‘ডুব’-এর পর এখানেও তার আবহসঙ্গীত অনন্য মনে হয়েছে। একজন ভালো মিউজিশিয়ানই এমন মিউজিক বানাতে পারেন। এটার ঘরানায় ক্রাইম থাকলেও মূলত এটা কিন্তু ড্রামা। সমাজে চলমান পুরুষতান্ত্রিকতা, পুরুষের অহমিকা, নারিবাদীতা – ব্যাপারগুলোর এমন সূক্ষ্ম ট্রিটমেন্টই আমার ভালো লাগে। ‘ড্রামা’ আমার পছন্দের জনরা, তাই এই স্লো-বার্ন সিরিজটা আমার মতো দর্শকদের জন্য। তবে এপিসোড ৫/৬ এ খানিকটা বিরক্ত হয়েছি Genre shift এর কারণে। সেখানে পার্থ বড়ুয়া, ইরেশ যাকের পর্দায় আসেন। হার্ড-হিটিং ড্রামা থেকে ক্রাইম সলভিং-এ ভরা একটা এপিসোড, যেন ফারুকী একের ভেতর দুই করতে চেয়েছেন। ন্যারেটিভ ঠিক ছিল, কিন্তু শিফটটা আরও যত্ন করে লেখা যেত। তাহলে এত sudden মনে হতো না। প্রায় আগ্রহ হারিয়েই ফেলেছিলাম, তারপর শেষের দিকে জোড়াটা ঠিকঠাকই লেগেছে। আবহসঙ্গীত, কালার প্যালেট, সিনেমাটোগ্রাফি মিলিয়ে বেশ জাতের একটা কাজ হয়েছে আমি মনে করি।
‘মহানগর’-এর পরপর আরেকটা ওয়েব সিরিজ ভালো লাগায় বলতে পারি, বাংলাদেশ থেকে ভালো কিছু এখনও আশা করাই যায়।
সবমিলিয়ে ক্রাইম অংশটুকু বাদ দিলে আমার কাছে পরিপূর্ণ একটা সিরিজই লেগেছে। খুব লম্বাও লাগেনি। কখনো ক্লান্ত হইনি হয়তো পাভেলের আরামদায়ক মিউজিক ও ফারুকীর ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং-এর কারণে। মারিয়া নূরের চরিত্রটাও অল্প সময়ে ছাপ ফেলে গেছে।
Her silence in that scene absolutely hints towards that realization I had after watching Never Rarely Sometimes Always (2020).
আর তাসনিয়া ফারিণ সম্ভবত আমার দেখা জয়া আহসানের পরে বাংলাদেশে সবচেয়ে সুন্দর অভিনেত্রী। সুন্দরী না বলে সুন্দর বললাম। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের সেই মধ্যবিত্ত ছিমছাম নায়িকার মতো, শান্ত ও শীতল, প্রাণোচ্ছল। কোন সিনেমার মূল দুই চরিত্র ভালো হলে জিনিসটা ভালো লাগতে বাধ্য। মোস্তফা মনোয়ারও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন। তবে তার চরিত্রটা হয়তো অতটা আকর্ষণ করবে না।
এখানে মনের কথা হড়বড় করে বলে দেয়া নেই, ডায়লগবাজি নেই। তারপরও ছোটখাটো যা আছে, তা ভেতরে ধাক্কা দেয়ার মত। Silence speaks larger than words.
ধন্যবাদ মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী, পাভেল আরিন ও তাসনিয়াকে ?ওয়েবের রাজ্যে স্বচ্ছ ও গোছানো একটা কাজ দেয়ার জন্য। জি ফাইভের তো এমন কনটেন্ট পেয়ে ধন্য বোধ করা উচিত, ওদের অরিজিনালে তো ভালো নির্মাণ পাওয়া যায় না।
৮ এপিসোড, ২৫-২৭ মিনিট করে। বিঞ্জ করার মতো করে বানানো। এবার শুরু ও শেষে পাঞ্চটাও পেয়েছি। Subtle ড্রামার ভক্ত হলে দেখুন। অন্তত প্রথম ৪ এপিসোড দেখে খুব আরাম পাবেন। মাঝে একটু গড়বড়ে লাগতে পারে, তারপর আবার শেষে একটা হাহাকার…!
১৩ টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের সাবস্ক্রিপশন কিনে দেখাটা সার্থক। আপনাদেরও সেটাই সাজেস্ট করবো। জি ফাইভের ফ্রি ভার্শন খুব বাজে, সাবিলা নূরের অ্যাড দেখতে দেখতে পাগল হয়ে যাবেন। ফোনে দেখলে হেডফোন লাগিয়ে দেখুন। সাউন্ড ডিজাইন অত ভালো না হলেও আবহসঙ্গীতে ডুবে থাকা যায়। আমি স্মার্ট টিভিতে কাস্ট করে দেখেছি।