পরীমনির সঙ্গে ‘অমানবিক’ আচরণের প্রতিবাদ
৪ আগস্ট মাদকদ্রব্য রাখায় দায়ে পরীমনি আটক হলে কয়েকদিনের মাঝে তার শিল্পী সমিতির সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। কিন্তু এফডিসি কেন্দ্রিকে সিনেমার বাইরের লোকেরা এক-দুজন করে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। তারা পরীমনির জন্য ন্যায়বিচার দাবি করে।
পরিচালক সমিতির কর্তা ব্যক্তিরা নায়িকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও পরবর্তীতে মূলধারার অনেক নির্মাতা তার পক্ষে দাঁড়ান। ইতিমধ্যে একাধিক পক্ষ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে ও ঘোষণা দিয়েছে।
শনিবার (২১ আগস্ট) বিকেল ৪টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরীমনির ন্যায়বিচার দাবিতে ‘শিল্পীর পাশে ব্যানারে’ আয়োজিত হয় সমাবেশ।
সেখানে নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পরীমনির মুক্তি বা তার সুষ্ঠু বিচার দাবিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে অরাজকতা, লুটপাট, ধর্ষণ, বিচারহীনতা চলছে। এমন একজন লোককে পাওয়া গেছে, যাকে সব ধরনের নির্যাতন চালানো যায়।’
তিনি বলেন, ‘পরীমনি বলছেন, তিনি এভাবে থাকলে মরে যাবেন। আমি মনে করি, অলরেডি তার সাত বছর জেল হয়ে গেছে। যে অমানুষিক অত্যাচারের মাধ্যমে তিনি গিয়েছেন এবং এখনো যাচ্ছেন। এটি সাত বছরের জেলের চেয়েও বেশি।’
আটকের পর থেকে এ নিয়ে তিন দফায় সাতদিন পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বারবার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে।
আজাদ বলেন, ‘আপনারা তথ্য উদঘাটনের জন্য তাকে নিয়ে যাচ্ছেন না; রবং খুব কাছ থেকে তাকে দেখার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। না হলে তথ্য উদঘাটনের জন্য সাত আট দিন লাগতে পারে বলে বিশ্বাস করি না। এটা এক ধরনের নোংরামি।’
সমাবেশে অভিনয়শিল্পী ঝুনা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা পরীমণিকে উদ্দেশ করে এখানে দাঁড়িয়েছি। আমরা সব সময় যে জিনিসটার বিরুদ্ধে থাকি তা হলো নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন, পণ্য হিসেবে বিক্রয়। প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা নারীর প্রতি এই মনোভাব দেখতে পাচ্ছি। আমরা এর নিন্দা জানাই। গ্রেফতারকৃত শিল্পীদের আদালতের রায় দেওয়ার আগেই যারা তাদের নামে অশ্রাব্য কথা ছড়াচ্ছে তাদেরও নিন্দা জানাই। বাংলাদেশে হাজারো শিল্পী রয়েছে, যদি প্রয়োজন হয় আমরা একে অপরের হাত ধরে প্রতিবাদের মিছিল তুলতে পারবো।’
পরিমণির গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ভাবতেই অবাক লাগে, পরীমনি বিশ্বের কত বড় মাফিয়া যাকে ধরতে এলিট ফোর্সকে যেতে হয়েছিল। তাকে বললেই সে থানায় যেত, ডিবি অফিসে যেত।’
পরীমনিকে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে তিন–তিনবার রিমান্ডে নেওয়া এবং একই সঙ্গে ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ জন্য উসকে দেওয়া একটি বেআইনি কাজ বলে উল্লেখ করেন চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম। তিনি বলেন, ‘আইনের রক্ষকেরা আইন ভঙ্গ করেছেন। পরীমনি একজন অভিনয়শিল্পী এবং বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা পরীমনির জামিন চাই। আইন সবার জন্য সমান হোক।’
এ সময় নির্মাতা অপরাজিতা সংগীতার সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক কর্মী রুম্মান রশীদ খান, নাট্য পরিচালক শহীদুন্নবী, সেতু আরিফ; অভিনয় শিল্পী অনামিকা জুথি, রাজদীপা; চলচ্চিত্র নির্মাতা নোমান রবিন, রাকিবুল হাসান, গাজী মাহবুব, হাবিবুল ইসলাম হাবীবসহ আরও অনেকে।
সমাবেশ শেষে অরাজিতা সংগীতা রবিবার (২২ আগস্ট) বিকাল সাড়ে ৪টায় শাহবাগ আবারও পরীমনির মুক্তির দাবিতে সমাবেশের ঘোষণা দেন।
এ দিকে আইনি বা প্রশাসনিক কারণে কোনো শিল্পীকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন টেলিভিশনের শীর্ষ চার সংগঠনের নেতারা। শুক্রবার ‘শিল্পীর মর্যাদা এবং শিল্পের স্বাধীনতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই আহ্বান জানান তাঁরা। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ইস্যুতে খবরের আলোচনায় সংস্কৃতিকর্মীরা। এই ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলতেই শিল্পকলা একাডেমিতে জড়ো হন টেলিভিশন মিডিয়ার কলাকুশলী ও শীর্ষ নেতারা। বৈঠকটির আয়োজন করে টেলিপ্যাব, ডিরেক্টরস গিল্ড, অভিনয় শিল্পী সংঘ এবং টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ।
বৈঠকে শিল্পীর মর্যাদা রক্ষা এবং শিল্পীকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও সামাজিক সব সংগঠনের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তাঁরা। গণমাধ্যমে ‘চটুল সংবাদ’ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বহীন প্রচারের মাধ্যমে বিচারের আগেই শিল্পীদের মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, মিডিয়া ট্রায়াল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপপ্রচারের কারণে শিল্পীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সামাজিকভাবে তাঁরা অবমাননার শিকার হচ্ছেন।
বৈঠকে আরও বলা হয়, বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক বোধে উজ্জীবিত করতে, সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণকে সচেতন করতে শিল্পীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু শিল্পীর মানবাধিকার রক্ষায় সমাজের অন্যান্য শক্তিকে সব সময় সমানভাবে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। শিল্পী ও শিল্পের কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পীরা অনেক সময় পণ্য হিসেবে বিবেচিত হন। আর পণ্যের দোষগুণ বর্ণনার মতো শিল্পীর দোষগুণকেও অনেকে বস্তুগত দোষগুণ বিচারের মতো করে বিচার করার প্রয়াস নেন। তাঁদের এই প্রয়াসকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। এ প্রক্রিয়ায় সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন অনেক গুণী শিল্পী, ক্ষুণ্ন হয় তাঁদের সামাজিক মর্যাদা।
এই গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টেলিপ্যাবের সভাপতি ইরেশ যাকের ও সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসির, ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু ও সাধারণ সম্পাদক এস এম কামরুজ্জামান সাগর, অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব নাসিম এবং নাট্যকার সংঘের সভাপতি মাসুম রেজা। বৈঠকে শিল্পী ও কলাকুশলীদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
এ দিকে মাদক মামলায় পরীমনিকে এক দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজ শনিবার আদালতে হাজির করা হয়েছিল। শনিবার বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটে তাঁকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের হাজতে আনা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফা ফের রিমান্ড না চেয়ে পরীমনিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেছেন। অন্যদিকে আজ পরীমনির জামিন চেয়ে আবেদন করেননি তাঁর আইনজীবী। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন পরীমনি।
কী কারণে জামিন চাওয়া হয়নি আজ? এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয় তাঁর আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাতের সঙ্গে। প্রথম আলোকে পরীমনির আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত বললেন, ‘আমরা এই কোর্টে আর জামিন আবেদন করতে চাচ্ছি না। এখানে একাধিকবার জামিন চেয়েও পাইনি বলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত, পরীমনির জামিনের আবেদন এবার আমরা উচ্চ আদালতে করব। আমাদের আশাবাদ, উচ্চ আদালত পরীমনির জামিনের বিষয়টি আমলে নেবেন।’
পরীমনির আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত জানালেন, ‘মোট চারবার জামিনের আবেদন করা হয়। প্রতিবারই নামঞ্জুর করেন বিজ্ঞ আদালত। উচ্চ আদালতে পরীমনির জামিন আবেদনের বিষয়ে কাল রোববার বিস্তারিত জানাতে পারব।’
পরীমনি এজলাস থেকে বের হওয়ার পথে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, ‘কেন আমার জামিন আবেদন করলেন না। আমি তো পাগল হয়ে যাব। আপনারা জামিন চান, আপনারা আমার সঙ্গে কী কথা বলবেন? আপনারা বুঝতেছেন, আমার কী কষ্ট হচ্ছে?’
পরীমনির এমন কথার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত বলেন, ‘তিনি খুব অসহায় সময় পার করছেন। দেশের একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকাকে বারবার রিমান্ডে নেওয়ার ব্যাপারটি কঠিন ব্যাপার। শারীরিকভাবেও তিনি খুব অসুস্থ অনুভব করছেন। মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত আছেন। অনেক বিষয় বিবেচনায় আমরাও আশাবাদী ছিলাম, এই কোর্ট থেকে পরীমনির জামিন করাতে পারব। কিন্তু চারবার জামিন চেয়েও পাইলাম না দেখে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছি।’
পরীমনির প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য অভিনেত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার আজমেরী হক বাঁধন। এ ছাড়া বিবৃতি দিয়েছেন চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান।
সূত্র/ প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন