পর্যালোচনা: ফাগুন হাওয়ায়
‘ফাগুন হাওয়ায়’-এর গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা ঝোঁকের ওপর; তেমন কোনো টুইস্টও নেই সারা ছবিতে। ১৯৫১-৫২ সালের দিকে, খুলনা অঞ্চলের কোনো একটা ছোট শহরের থানাতে পশ্চিম পাকিস্তানের যে থানাপ্রধান (ওসি) আসেন, তাঁর ধ্যানেজ্ঞানে উর্দু ভাষা। গোঁয়ার, রাগী, বাঙালিবিদ্বেষী এই অফিসার উর্দু প্রচলনের সকল ধরনের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক রাস্তা নিতে তৎপর হন, জবরদস্তি করেই।
থানার সাইনবোর্ডের বাংলা সরানো থেকে শুরু করে এলাকার নানান সাইনবোর্ড বদলানো, লোকজনের প্রাত্যহিক ভাষাতে উর্দু আনার জন্য তিনি তোড়জোর শুরু করেন। তাঁর ইচ্ছা, আন্দাজ করা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে তখনই দানা-বাঁধতে-থাকা ভাষানীতির আদলে তৈরি হয়েছিল। একটা ছোট শহরের থানাপ্রধান হিসেবে বরং প্রয়োগের হিংস্রতা আরো বেগবান। তাঁর এই প্রকল্পের অনুচর পেতেও সময় লাগল না, স্থানীয় অনুচর/তাবেদার।
তিনি থানার সামনে উর্দু শেখানোর ক্লাসেরও বন্দোবস্ত করলেন। তাঁর সমস্ত আয়োজনে বাধ সাধল একটা বউ-কথা-কও পাখি। স্থানীয় অনুচরদের একজন মারফত তিনি জানতে পারেন যে পাখিটি এই বুলিতে ডাকে; একটা খসড়া উর্দু তর্জমাও তিনি শুনে নিলেন। তিনি এরপর লাগাতার চেষ্টা করা সত্ত্বেও সেই পাখিটাকে দিয়ে উর্দু বলাতে পারেননি। একটা উদ্ভট গোঁয়ার লোকের এই আচরণের উপর পুরো গল্পটা দাঁড়াতে পারত, গল্পপ্রবাহ/ফিকশনালিটির দিক থেকে সেটা দারুণ ব্যাপার হতো, বিশেষত তাঁর নিষ্ঠুর, তথাকথিত (পাকিস্তান) রাষ্ট্রপ্রেমী ও যৌনহিংস্র আচরণের সঙ্গে চন্দরের মেয়ের আত্মহত্যা পর্যন্ত সম্পর্কিত করে ভাবলে। কিন্তু খুবই বোধগম্য কারণেই নির্মাতা অবধারিত জাতীয়তাবাদের অন্যান্য উপকরণের আশ্রয় নিয়েছেন, যার সঙ্গে বাংলার ভাষা আন্দোলন যুক্ত হয়েছে।
চলচ্চিত্রীয় প্রকল্প হিসেবে তাতে উপকার হোক না হোক বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে স্মারক হিসেবে রাখার ক্ষেত্রে ছবিটা অগ্রসর দাবিদার হয়ে উঠল। টিটো রহমানের গল্প (বউ কথা কও) আমার পঠিত নয়। ফলে আমি নিশ্চিত নই যে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের মধ্যে গল্পটাকে নিয়ে আসার দায়/কৃতিত্ব কেবল নির্মাতাই নেবেন/পাবেন কিনা।
তৌকীর আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে আমার স্বতন্ত্র আগ্রহ তৈরি হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। তাঁর আগেকার ছবিগুলো আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু ‘অজ্ঞা্তনামা’ আর ‘হালদা’তে তিনি সুস্পস্ট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মিশন অবলম্বন করেছেন। এই পুরানা ভ্যাদভ্যাদে তর্ক আমার জন্য নিরর্থক যে “শিল্পকলা”কে রাজনৈতিক হতে হবে কিনা। আমি নির্মাতা, শিল্পকলাকারের ভাবনাচিন্তা, জগৎবোধ, যুক্তিতর্ককে দেখতে উৎসুক দর্শক/পাঠক। এবং সেটা মোটাদাগের দেশপ্রেম বা ঝান্ডাবাহিতার ব্যাপার নয় আমার জন্য। ‘অজ্ঞাতনামা’ দুর্দান্ত এক বিষয়কে সামলেছে, অথচ সমূহ সূক্ষ্মতা সমেত। ‘হালদা’ নির্মাতার পরিবেশবোধ ও লিঙ্গসচেতনতার দলিল হিসেবে পাঠ করি আমি।
‘ফাগুন হাওয়ায়’ দেখতে যাবার তাগিদ তাই স্বতন্ত্র ছিল। হলে বসে ছবি দেখতে দেখতে যে মনে পড়ল আবার আগের দুটো ছবির কথা, মনে পড়ল যে সেগুলোতে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের চাপ ছিল না, সেটা দৈবাৎ মনে-পড়া নয়। আমার দর্শনসাথি ছিলেন ক্রিটিক্যাল ইতিহাসশাস্ত্রের এক অধ্যাপিকা। তৌকীরের আগের চলচ্চিত্রগুলোই কেবল নয়, তিনি বাংলা ছায়াছবি দেখেছেনই নগণ্য পরিমাণে। যদি ভুল না মনে করে থাকি, তাহলে প্রবাসে বড় হওয়া সেই ইতিহাসবিদের এটিই ছিল প্রথম বাংলাদেশি প্রেক্ষাগৃহ সেবন (সীমান্ত স্কয়ারের সিনেপ্লেক্সকে প্রেক্ষাগৃহ বলতে আমার আরাম লাগে না যদিও)। তাঁকেও আমার এই অনুভূতি বললাম।
গল্পটির একটা ঐতিহাসিক চুলচেরা পাঠ সম্ভব। আমি সেটার পক্ষপাতি নই। জরুরি না বলেই। এই ছবিতে এবং সে সূত্রে চিত্রগল্পে তৌকীরকে সাটলিটির যোগানদাতা হিসেবেই দেখতে চাই আমি। অনেকগুলো মজাদার মুহূর্ত, একাধিক ভারী মুহূর্ত তিনি সরবরাহ করেন মুডের ওপর কোনো অত্যাচার না করে। মুরগির মুখ চেপে ধরে রাতের বেলা ওসির মুরগি চুরি যদি আপনার মনে দাগ কাটে তো চন্দরের ঘরে তাঁর বোবা মেয়ের আত্মহত্যা আপনাকে স্তম্ভিত করে দেবে। বস্তুত, চন্দরের মেয়ের মৃত্যু তথা চন্দর ও মেয়ের সম্পর্ক এই ছবিতে এত শক্তিশালী অন্তর্গল্প যে আমাকে ভাবিয়েছে এই জায়গাটাই ছবির কেন্দ্র হয়ে উঠল না কেন। নাসির আর দীপ্তি, দীপ্তি আর ঠাকুরদা, জামশেদ আর নাসির, আজমত আর ওবায়েদ যে কোনো জোড়া সম্পর্কের তুলনায় চন্দর আর চন্দরের মেয়ের সম্পর্কের ভার/উদ্ভাস অধিক। ভরকেন্দ্রটি নির্মাতা লক্ষ্য করেছেন হয়তো।
চলতি ভাষায় যাকে কালকেন্দ্রিক বা পিরিয়ডিক ছায়াছবি বলা হয়, এটা সেই ঘরানায় পড়ে। কস্টু্ম, তৈজসপত্র, স্থাপত্য সবকিছুর ক্ষেত্রে একটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-অবকাঠামোর সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অসম্ভবই বলা চলে এ ধরনের ছবি। স্থাপত্য সামলাতে গল্পে কারিগরি করে দীর্ঘকাল ঢাকাবাসীদের ঢাকার বাইরে রাখতে হয়েছে। মোটের ওপর আসবাব, তৈজস, পোশাক যুক্তিগ্রাহ্য ও আরামদায়ক লেগেছে আমার। কিন্তু কৃপণের মতো আউটডোরের ব্যবহার (সঙ্গত কারণেই) ভিজুয়ালি চাপের ছিল। কিন্তু কখনো কখনো এসব ঝামেলা যে দারুণ শৈলীর জন্ম দিতে পারে, তৌকীরের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সেই প্রমাণও রেখেছে। চন্দর যখন সাইকেলে মেয়েকে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ চালান, খুবই অসরাচর একটা এঙ্গেল ব্যবহার করেছেন নির্মাতা— দৃষ্টিনন্দন ও মায়াময় সেই এঙ্গেল। ওসি জামশেদের বাসস্থান হিসেবে দুইটা বাড়ি ব্যবহার হয়েছিল কিনা জানি না; না হয়ে থাকলে বরং আরো অবাক হব। মোরগ এই ছবিতে এত মুখ্য, অথচ সকালবেলা দেয়ালে বাংলা শ্লোগান দেখে জামসেদ ক্রুদ্ধ হয়ে বের হলেন, সেই মোরগখাঁচা কোনো প্রান্তে অদৃষ্টই থাকল না কেবল, কল্পনা করেও কোথাও্ রাখা গেল না বাড়ির কোনো কোণায়।
সঙ্গীত এই ছবিতে মৃদুমন্দ, মেলোডিয়াস। মোটের ওপর খুব ভাল আবহসঙ্গীত। দীপ্তির গলায় ঠোঁটে যে গান বসেছে তা খুব মানিয়েছেও বটে। নায়ক-নায়িকার সম্পর্কোদ্ভাসী গান ‘তোমাকেই চাই’ সুন্দর, মিষ্টি। তবে অধিকাংশ ছবিতেও যেমন দুয়েকটা প্লেব্যাক ভোগায়, এখানেও তাই। যদ্দুর মনে পড়ে বাউলের গানখানি হঠাৎ বেখাপ্পাভাবে যন্ত্রানুষঙ্গে বেমানান কণ্ঠে শুরু হয়।
চরিত্রের নামগুলির জন্য আমি নেট ও উইকিপিডিয়ার আশ্রয় নিলাম, ভুলে গেছিলাম বলে। চন্দরের মেয়ের চরিত্রে অভিনয়কারীর নাম পেলাম না। তিনি অনবদ্য। অত্যন্ত ডিমান্ডিং অথচ স্বল্প আয়তনের এই চরিত্রে রূপবতী এই অভিনেত্রী দুর্দান্ত। তাঁর বাবা চন্দরের রূপদানকারী ফজলুর রহমান বাবুকে দর্শক এভাবে আশাই করেন। হৃদয়গ্রাহী তিনি।
সিয়ামকে চলতি ধারার চলচ্চিত্রে আমি দেখেছিলাম – ‘পোড়ামন ২’। সিয়াম জনপ্রিয় হবার সকল গুণ রাখেন। বরং তৌকীর আহমেদের চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করছেন বলে আমার বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তাঁর অনুচ্চকিত অভিনয় আমার ভাল লেগেছে। দীপ্তিরূপী তিশা, হালদা থেকেই এই পরিচালকের কাজে বিশিষ্ট। তাঁর অভিনয় মনোগ্রাহী। আমার বিবেচনায় নাসির ও দীপ্তি এত আন্দাজমতো/প্রেডিক্টেবল জুটিমূলক চরিত্র করেছেন যে এখানে অভিনয় করা কঠিনও বটে।
ক্রূর ও ষড়যন্ত্রী চরিত্রে শহীদুল আলম সাচ্চু তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। তাঁর ছোটভাই হিসেবে পর্দায় রওনক ছিলেন অধিক সময় জুড়ে; মুড ও ইন্টেন্টের দ্রুত বদলের কাজও ছিল বেশি তাঁর। আরো সূক্ষ্ম তিনি হতে পারেন, অন্যান্য কাজে আমার মনে হয়েছে। সাজু বেশ একটা মানানসই কাজ করেছেন, যদিও এই ছবিতে তিনি বিয়োগান্ত। আবুল হায়াত দিনকে দিন নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন। হাসিহীন প্রবীণ হিন্দু ডাক্তার হিসেবে তিনি অনবদ্য। আরো নজর কাড়েন যখন জামশেদের সঙ্গে দ্বৈরথে জড়ান – শীতল গৌরবময় দ্বৈরথ; কিংবা আকস্মিক সিদ্ধান্ত সংসারের একমাত্র সদস্য নাতনিকে জানান যে ইন্ডিয়া চলে যাবেন; কিংবা বাড়ির দাম হিসেবে আজমতের বেহুদা ঠকানোর মতো একটা অংক শুনে হতাশ হয়ে সংক্ষোভ চেপে রাখেন। চাপে-থাকা দোকানদার নরেশ ভূঁইয়া স্পষ্ট স্বাক্ষর রাখেন। রাখেন ফারুক আহমেদও। চিরচেনা হাস্যরসাত্মক চরিত্রের ঊর্ধ্ব এই ছবিতে তাঁর সাটলিটি ছিল। তিনি রস আর করুণে সাবলীল আসা যাওয়া করেছেন। যশপাল শর্মা বরং একটা হাইপিচ অভিনয় বজায় রাখতে গিয়ে কখনো কখনো নিজের মান ভেঙেছেন। কিন্তু তাঁর সামগ্রিক মুখাবয়ব বহুমাত্রিক ক্রূরতা ও খামখেয়ালিপনার ভাল ম্যানুয়েল ছিল।
আমার ধারণা ছবিটা মিনিট তিরিশ ছোট হওয়া দরকার ছিল। বাংলাদেশের যা চর্চা তাতে ১২০ মিনিটের নিচে গেলে তা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যাবার অনুমোদন জোগাড় করতেই হিমশিম খাবার দশা হয়। নির্মাতা হয়তো অন্য ভার্সন বানাবেন, অনেকেই আজকাল তা করেন বটে। সেই ভার্সনে কী কাটা পড়বে সেটা নিয়ে আমার অতি আগ্রহ থাকবে। তবে যতই “রাষ্ট্রীক ইতিহাস নির্মাণ” উপাদান বাদ পড়বে, ততই একটা সূক্ষ্ম গল্প হিসেবে ছবিটা অধিক আকর্ষণীয় হতে থাকবে বলে আমার মনে হয়।
একটা বিনীত টীকা দিয়েই শেষ করতে চাই। বাংলাদেশের মতো অত্যল্প ইতিহাসচর্চার দেশে, কথাসাহিত্য বা চলচ্চিত্র যেটাই ‘জাতীয় ইতিহাস’-এর কোনো না কোনো লক্ষণা/মোটিফ নির্দেশ করবে, সেটারই ভ্রান্তপঠন ভ্রান্তসেবনের সমূহ সম্ভাবনা। এখানে ইতিহাসচর্চার স্বল্পতা বলতে আমি অবশ্যই ইতিহাসের নিরহঙ্কার নানাবিধ পাঠ বোঝাচ্ছি, প্রপাগান্ডাধর্মী ‘আমরা মহৎ’-এর লাগাতার ঘোষণাপত্র নয়। বাংলাদেশের বিদ্যা ও শিল্পসাহিত্য জগতে শেষোক্তটা প্রকট বলেই বরং ইতিহাসের লক্ষণা আশ্রয় করে সার্বভৌম ‘আর্ট’ দুষ্কর।
আমি চলচ্চিত্রের মামুলি দর্শক। আমার ছবি দেখার পরিমাণ ও ছায়াছবির জগতে আমার স্বরের অনুপস্থিতি দুই-ই এই কথার প্রমাণ দেবে। কিন্তু নির্মাতা তৌকীর আহমেদ আমার রাডারে থাকবেনই। তিনি জনজীবন দেখতে ব্রতী হয়েছেন, দেখে চলেছেন। আমার তাই খুব আগ্রহ তাঁর কাজ নিয়ে।
ছবি দেখার স্থান-কাল: সীমান্ত স্কয়ার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
ফেসবুক স্ট্যাটাস: ২১ মার্চ ২০১৯