Select Page

’৫২-র যে সিনেমাগুলো বানানো হয়নি

’৫২-র যে সিনেমাগুলো বানানো হয়নি

বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম এবং একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’। মুক্তি পায় ২০১৯ সালে, ভাষা আন্দোলনের ৬ দশক পেরিয়ে। অথচ ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার অন্যতম প্রেরণা ভাষা আন্দোলন। এর ফলেই বাংলাদেশের, তৎকালিন পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাজাত্যবোধের চেতনার উন্মেষ ঘটে। ঢাকার মূলধারার চলচ্চিত্র যে ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে শুরু, সেটাও বানানো হয়েছিল সেই সচেতনতা থেকেই। একই কারণে প্রতিরোধ করা হয় এফডিসির শুরুর বছরগুলোয় উর্দুতে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ। অথচ কী অবাক কাণ্ড, সেই ভাষা আন্দোলন নিয়েই তখন সিনেমা বানানো হয়নি।

জহির রায়হান পরিকল্পিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ এফডিসি থেকে নির্মাণের অনুমতি পায় হয়নি। এমনকি চিত্রনাট্যও ফেরত দেয়া হয়নি। তবে ১৯৭০ সালে মাসিক ‘সমীপেষু’ পত্রিকায় সে কাহিনি উপন্যাস আকারে ছাপা হয়।

হয়নি, সঙ্গে হতেও দেয়া হয়নি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা বানানোর অন্তত ছয়টি উদ্যোগের কথা জানা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি কোনোটিই। প্রথম উদ্যোগটি নেয়া হয়েছিল এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরপরই। তখন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই প্রাদেশিক পরিষদে তুলেছিলেন ইপিএফডিসি বিল। পাশ হয়েছিল সর্বসম্মতিক্রমে। তার পরপরই ফতেহ লোহানীকে অনুরোধ করেছিলেন, ভাষা আন্দোলনের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। ফতেহ লোহানী ‘পেপারওয়ার্ক’ও শুরু করেছিলেন। পরে আর সে ছবির কোনো খবর শোনা যায়নি।

১৯৬৩ সালে ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন জহির রায়হান। কিন্তু তার প্রথম তিনটি চলচ্চিত্রই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ালেও ব্যবসা করতে পারেনি। তাই পাননি প্রযোজকদের সাড়া। তখনকার মতো সে পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বানান ‘সঙ্গম’ আর ‘বাহানা’। উর্দু ভাষার ছবি দুটি দিয়ে পান তুমুল ব্যবসায়িক সাফল্য। তারপর, ১৯৬৫ সালের মে মাসে ঘোষণা দেন, তার ভাষা আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ থেকে বানাবেন সিনেমা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। পরে জানা যায়, সিনেমার জন্য ভেবেছিলেন সম্পূর্ণ নতুন একটি গল্প। সেটাকে চিত্রনাট্যে রূপ দেয়ার দায়িত্ব দেন শিল্পী মূর্তজা বশীর। চার শ্রেণির চার পরিবারের গল্প। যাদের কাহিনি এক সুতোয় বাঁধা পরবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে। পরের বছর জুন মাসে আসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। জানানো হয় শিল্পী-কলাকুশলীদের তালিকাও। প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের কথা ছিল সুলতানা জামান, রহমান, সুমিতা, আনিস (খান আতাউর রহমান), সুচন্দা, সৈয়দ হাসান ইমাম, রেশমা, খলিল প্রমুখের।

কিন্তু এফডিসি থেকে ছবিটা নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়নি। এমনকি চিত্রনাট্যও ফেরত দেয়া হয়নি। তবে ১৯৭০ সালে মাসিক ‘সমীপেষু’ পত্রিকায় সে কাহিনি উপন্যাস আকারে ছাপা হয়। সেসময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন শাহরিয়ার কবির। তখনকার তারকা পরিচালক জহির রায়হান তাকে গল্পটা বলেছিলেন, তিনি শুনে শুনে লিখেছিলেন। ছাপা হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যায়। সে বছরও জহির রায়হান বলেছিলেন, সুযোগ পেলেই ছবিটা বানাবেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিও এক সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে, এক সামরিক অভিযানে অংশ নিয়ে জহির রায়হান মৃত্যুবরণ করলে, ছবিটা অনির্মিতই থেকে যায়।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমার দৃশ্য

ওদিকে ১৯৬৭ সালে ‘যে ফুল না ফুটিতে…’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেন চিত্র-সাংবাদিক নীরদ আহমেদ। সে খবর প্রকাশিত হয় মাসিক ঝিনুক পত্রিকায়। ছবিটি সম্পর্কে লেখা হয়, ‘একুশে ফেব্রুয়ারীর ছোট্ট একটি ঘটনাকে ভিত্তি করে পৌনে এক ঘণ্টার একটি ছবি’। যুক্ত ছিলেন ফখরুল আলম। পরের বছর ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। তিনি তখন সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। ছবির নাম ঠিক করেন ‘পলাশের লাল’। কিন্তু প্রযোজক পাননি। ১৯৬৯ সালে শহিদ দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ করেন জহির রায়হান। সে খবর ছাপিয়ে চিত্রালী পত্রিকায় লেখা হয়, এগুলো তার পরের ছবিতে ব্যবহার করবেন। বানাবেন ‘আরেক ফাল্গুন’ অবলম্বনে। একই বছর ‘অমর একুশে’ নামে আরেকটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা আসে। জানানো হয়, মহরতে আসবেন ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ও সমকালীন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা। উদ্বোধন করবেন শেখ মুজিবুর রহমান। থাকবেন তাজউদ্দিন আহমদ। চলচ্চিত্রটি থেকে আয় করা অর্থ ভাষাশহীদদের ও পরবর্তী গণআন্দোলনগুলোর শহীদদের পরিবারকে দান করা হবে।

ছবিগুলোর কোনোটিই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আর মুক্তিযুদ্ধের পরে সমস্ত মনোযোগ চলে যায় মহান যুদ্ধটির প্রতি। ভাষা আন্দোলন পরে যায় আড়ালে। পরে ১৯৯৬ সালে মীর শামছুল আলম বাবু ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারী’ এবং শাহীন মাহমুদ ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে দুটো ছবির পরিকল্পনা করেন। দুজনেই আবেদন করেছিলেন সরকারি অনুদানের জন্য। কিন্তু পাননি। এমনি করেই ভাষা আন্দোলনের প্রতি উপেক্ষায় পেরিয়ে যাচ্ছিল দশকের পর দশক। অবশেষে তৌকীর আহমেদের কল্যাণে মিলেছে খানিকটা স্বস্তি। এখন অন্তত ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি ছবি আছে!

  • আমাদের চলচ্চিত্রে ৫২-র উপস্থাপন : অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থের অংশবিশেষ হতে সংক্ষেপিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাবীল অনুসূর্য

চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক

মন্তব্য করুন