Select Page

সিনপাট: ‌মোমবাতি-মোমবাতি, শান্তি নাই একরতি!

সিনপাট: ‌মোমবাতি-মোমবাতি, শান্তি নাই একরতি!

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের মুনশিয়ানা আমরা দেখেছিলাম ‘শাটিকাপ’-এ। কাজটা এতই দারুণ ছিলো তাওকীর এখনো অবধি একটি কাজ দিয়েই প্রাসঙ্গিক। ‘সিনপাট’-এর পোস্টার-ট্রেলার রিলিজের পর থেকেই তার টিমওয়ার্কের ওপর চোখ রাখছিলাম। বিশেষ করে সাক্ষাৎকারে। সেখানে তাওকীর একটা কমন ব্যাপারই সামনে এনেছেন। স্থানীয় আর্টিস্ট আর স্থানীয় লজিস্টিকস এর ব্যবহারের প্রস অ্যান্ড কনস। তাওকীর মেধাবী অভিনেতা বলেই বোধহয় তার জন্য এই ব্যাপারটা কাজেরই হয়েছে। তা শাটিকাপ হোক বা সিন পাট।

‘সিন পাট’ এমন এক প্যারালাল জগতের কথা বলে যে জগত বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়-উপজেলায় ফাংশন করে। আমাদের করপোরেট গল্প আর ভায়োলেন্সের ভিড়ে এই প্যারালাল জগতগুলোর কথাও স্ক্রিনে উঠে আসা জরুরি। যেমন জরুরি রোমান্টিক আর সাধারণ জীবনযাপনের গল্প বলা। ‘সিন পাট’ টিম তাই সাধুবাদ পাবেই।

ডার্ক হিউমারে ভরা সব সংলাপ, সোহেল-ফাজুর ডায়ালগ ডেলিভারির ভেতর পাবেন স্যাটায়ারিক্যাল সব কথা; ক্যারেক্টারগুলো ইন্টারেস্টিং। লোকেশানের সঙ্গে গল্পের খাপে খাপ একটা প্রেজেন্টেশন। আর তার সঙ্গে একটা আনস্টেবল সিনেমাটোগ্রাফি।

মফস্বলের জীবনাচারের সঙ্গে মিশে থাকে আঞ্চলিক গান-হিন্দি বাজনা। এখানকার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই সংগীতগুলো। এমন না যে শিক্ষিত সমাজ এই গান শুনে থাকেন, নিম্নবিত্তরা গান শোনার নির্দিষ্ট উপলক্ষ-ধরন-ভলিউম ঠিক করে উঠতে পারেনি বলেই হরহামেশা আমাদের কানে এই গানগুলো আসে, বিশেষ উপভোগ্য না হয়ে। ‘সিন পাট’ এ সেই গানই দেখা গেছে, সেই মিউজিকই দাঁড় করানো হয়েছে। সময়ের সঙ্গে মিউজিকের এমবিয়েন্সে যে চেইঞ্জ এসেছে সেটা খেয়াল করার মতো। ওমর মাসুমের মিউজিকের কর্মযজ্ঞের প্রশংসা করতেই হয়।

২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে বাংলাদেশের চিত্র কী ছিলো তা কেবল সে রাতে বাইরে খেলা দেখা মানুষেরাই বলতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন উপভোগ্য রাত্রি খুব কমই এসেছিলো, সে রাতের উন্মাদনাকে হয়তোবা লেখালেখি আর সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিওতে দেখা গেছে। কিন্তু একটা ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিংয়ে এই রাত এভাবে চলে আসতে পারে তা ‘সিনপাট’ দেখার আগে মাথায় আসছিলো না।

সবকিছুতেই মেপে মেপে কাজ হওয়া ‘সিন পাট’ এ চোখে কিছুটা ধাক্কা লাগার মতো ব্যাপার তার গল্পটাই আসলে। এই গল্পের বিশেষ উত্থান-পতন নেই, ফ্লো নেই, অনেকটা ডকু ফিকশন হয়ে উঠার মতোই হলো। সোহেলের জীবনের বিশেষ আশা নেই; সোহেল-ফাজু বাঁচতে চাইছে; টাকা কামাতে চাইছে, তার জন্য একের পর এক ঝুঁকি নিচ্ছে; কিন্তু এই ঝুঁকির ব্যাপারটা বা এই যে বাঁচতে চাওয়া সেটা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। শেষমেশ ‘সিন পাট’ হয়ে গেছে সংলাপনির্ভর একটা কাজ। অবশ্য বর্তমান সময়টায় আমাদের কার জীবনেরই বা বিশেষ এক পরিণতি এসে উপস্থিত হচ্ছে? ভাসমানই তো বটে আমরা। এই আলোচনা লিখতে লিখতে সোহেল আর ফাজু বাংলাদেশের ওটিটির দর্শকদের কাছে পরিচিত নাম। সোহেল শেখ এবং রিফাত বিন মানিকের এই জুটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘তাকদীর’-এর গল্প। তাদের দুজনের অভিনয়ে যে একটা ‘র’ সমীকরণ ছিলো সেটা আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু চিত্রনাট্য এবং ভাষাশৈলীর বিশেষ এডভান্টেজও তাদের সঙ্গে ছিলো।

ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২৩ এ বেস্ট ক্রিটিক চয়েজে এবারের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন শেফালী শাহ। ‘থ্রি অব আস’ এ শৈলাজ চরিত্রের জন্য আলোচিত এই অভিনেত্রী বলেছিলেন তিনি দেখতে সুন্দর নন, তারপরও তার কাছে অভিনয় করে যাওয়াটাই মুখ্য। আমরা সেই ছায়াই দেখতে পাই দুরু আপা তথা জিন্নাত আরার ক্যারেক্টারে। দেখতে বেশ মোটাসোটা, আকর্ষণীয় লুক না থাকা এই অভিনেত্রী ইমোশন-ডায়ালগ আর বডি মুভমেন্ট দিয়ে যেভাবে দর্শক মানসে স্থান করে নিতে পেরেছেন সাম্প্রতিক আলোচনায় সেটা কমই এসেছে। বাকীদের অভিনয়ে বারবার মনে হয়েছে তারা মেইনস্ট্রিম অভিনেতা নন। তাইই নিজেদের সেরাটা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চোখে পড়েছে। হ্যাঁ, এই প্রাণান্তকর চেষ্টার ভালো-খারাপ দুটো দিকের কথা তো পরিচালকই বলেছেন।

আমরা সোহেল-ফাজুর সেই জীবনের কথা নিয়ে যখন ভাবছি তখন ‘সিন পাট’ গান হাজির করাচ্ছে মোমবাতি! মোমবাতি! শান্তি নাই একরতি! রাজশাহীর ওই অঞ্চলের নেশাখোর মানুষদের জীবনের গল্পে ঢুকতে গিয়ে এমন আরবান টোনে গানের শব্দ শান্তিটুকুও উধাও করে নিলো যেন।

ওয়েব সিরিজের এপিসোডের নামগুলো ইউনিক, কিন্তু এপিসোড শেষ হচ্ছিলো কন্টিনিউটি ভঙ্গ করে; যার কারণে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছিলো বেশি। আগের পর্বের কন্টিনিউটি আর স্টোরির সিনক্রোনাইজেশন না হওয়াতে তাই এই নামের নান্দনিকতা স্থায়িত্ব পাচ্ছিলো না বেশি।

‘সিন পাট’ শেষ হওয়ার কিছু আগে দুরুর এক অন্য পরিচয় এসে হাজির হয়। তার ছেলে শামীম যে মুহূর্তে বলে উঠে, ‘এটাই নানাবাড়ি?’ ঠিক সে সময়ে তাওকীর গল্পের যে মোড়টা নিয়েছেন সেটা ‘সিনপাট’-এর একটা বিশেষত্ব এনে দিয়েছে। আমরা জানি আরবান প্রেমগুলোয় দুরুর মতো হতভাগ্য হয়ে উঠার বিশেষ ঘটনা এখন আর ঘটে না। এই যে ঘটনার পুরনো হয়ে যাওয়া সেটাই দর্শককে দুরুর কাছাকাছি নিয়ে যাবে আরো।

তাওকীরের এমন কাজের প্রশংসা পাওয়া উচিত মফস্বলী কায়দায় গল্প বলতে পারার জন্য। তাওকীর বেশ কিছুদিন সময় নিয়েই আমাদের যে গল্প উপহার দিতে পারেন তা থেকেই আঁচ পাওয়া যায় একমুখী বাংলাদেশী ভিজ্যুয়াল ইন্ডাস্ট্রিতে ঢাকার বাইরে থেকে সিনেমা/ওয়েব সিরিজ বানানো কতটা কঠিন। তাওকীর এ সময়ে ঢাকাই না হয়েও ফিল্মমেকার হয়ে উঠার কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ মানুষগুলোর কাছে কিছুটা হলেও শান্তির পরশ বুলাতে পারেন, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ভাষায় নির্মিত ভিজ্যুয়াল কাজগুলো যখন কৌতুক হয়ে উঠছে ঠিক সে সময়ে তাওকীর হয়ে উঠেন উদাহরণ।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

সাইদ খান সাগর

সিনেমাকর্মী

মন্তব্য করুন