পশ্চিমবঙ্গে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ হিট হওয়ায় খটকা লাগে মামুনুর রশীদের
সম্প্রতি হিরো আলমকে উদাহরণ হিসেবে এনে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বিষয়ক মন্তব্য করেছেন মামুনুর রশীদ। বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা তুলেছে। এই নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে নানা কথা উঠেছে। তবে এ বিষয়ে আলোচিত নাট্য ব্যক্তিত্বের মন্তব্য আরো পুরোনো, এবং রুচি বিষয়ক হতাশা অন্তত কয়েক দশক আগের।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যম দেশ রূপান্তরে ‘দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয় লেখেন। সেখানেও এসেছিল হিরো আলমের প্রসঙ্গটি। তখনও মুক্ত মিডিয়াকে দায়ী করেন মামুনুর রশীদ।
তবে রুচি বিষয়ে স্বদেশীদের একটু নিচু স্তরেই রাখতেন বলে বোঝা যায় তার একটি মন্তব্যে। ঢাকার ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নিয়ে তার অবস্থান তাচ্ছিল্যমূলক। বাংলাদেশে সাফল্য দেখে সম্ভবত তিনি হতাশ হননি, যতটা ‘খটকা’ লাগে পশ্চিমবঙ্গে অঞ্জু ঘোষ অভিনীত এ সিনেমার জনপ্রিয়তা দেখে।
মামুনুর রশীদ লেখেন, “আমরা সবসময়ই মনে করি পশ্চিমবঙ্গের দর্শক আমাদের চেয়ে ভালো। কিন্তু প্রথম খটকা লাগল যখন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ওখানকার সিনেমার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলল। এবং আমাদের একজন নায়িকা ওখানে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে অনেক বড় নায়িকার ধস নামিয়ে দিলেন।”
অবশ্য ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র এমন সাফল্যে অনেকে হতাশ হননি। অনেকেই এই সিনেমার জনপ্রিয়তা থেকে বাংলার গণমানুষকে আরো গভীরভাবে জানার আগ্রহ পেয়েছেন। তারা এই সিনেমার অন্তর্নিহিত বয়ানের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।
এ সিনেমা নিয়ে চিন্তক ফরহাদ মজহার তার বিখ্যাত রিভিউতে কয়েক দশক আগে যা লেখেন তা আজও শ্রেণীগত বিভাজন ও রুচি বিষয়ে উচ্চমন্যতার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, “কিন্তু ছবিটিকে যারা কুরুচিপূর্ণ বা ‘বিকৃত রুচি’র বলছেন তাদের সঙ্গে মোটেও একমত হওয়া যায় না। তাদের মত বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করা একটা কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এ কারণে যে, যারা বিকৃতির অভিযোগ তুলছেন তারা তাদের রুচিকেই অবিকৃত রুচির শাশ্বত আদর্শ ধরে নিয়েছেন, যা আসলে একটি বিশেষ শ্রেণীর রুচি কেবল। শ্রেণীগত কারণে সম্ভবত তারা মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখেননি। সাধারণত ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্তরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সিনেমাকেই ‘রিকশাওয়ালাদের ছবি’ মনে করে। ছবিগুলোর প্রতি তাদের শ্রেণীগত ঘৃণা এতো প্রবল যে, একে নিন্দা করবার জন্যই তারা জিহ্বা খোলে, নইলে নয়।”
তিনি আরো বলেন, “রুচির পার্থক্য বা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা শ্রেণীগত কারণে স্বাভাবিক। কিন্তু কখনো এটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কিংবা তাদের ভালো লাগাটাও, সচেতন ও প্রগতিশীল বলে নিজেদের যাঁরা দাবি করেন, তাঁদের কাছে ন্যূনতম কোনো অর্থ বহন করে না। সাধারণ জনগণের ভালোমন্দ লাগার প্রতি অহংকারী উপেক্ষার মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক ভাবনার অন্তঃসারশূন্যতাই প্রমাণিত হয়।”
পশ্চিমবঙ্গেও এ সিনেমার চিন্তকদের মাঝে কৌতুহল তৈরি হয়। ২০০৭ সালে মাহবুব মোর্শেদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের সিনেমা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র প্রসঙ্গ টানেন পণ্ডিত ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ। তিনি বলেন, “একাত্তরের যীশু’ সিনেমাটা দেখেছো। আমার বইয়ে একটা লেখা আছে ছোট বোবা মেয়ে বাঁশি বাজাতে শিখেছে। সেই ছোট মেয়ে আমার চোখে বাংলাদেশের প্রতীক। ঠিক তেমন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বাংলাদেশের প্রতীক। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ তিন পিতার কন্যা। তার তিনটা পরিচয় জন্মগত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক। এটা কি ভালো মুভি নয়? আরেকটা মুভি আছে। যেটার কথা বইতে দিতে পারিনি। তারেক মাসুদের ‘অন্তর্যাত্রা’। আমি এটা খুবই পছন্দ করেছি। তারেককে বলেছিলাম, অন্তর্যাত্রার শেষ নেই।”
‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নিয়ে গড়পরতা তাচ্ছিল্যের মাঝে সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য ছিল মজার।
কয়েক বছর আগে জি বাংলার ‘অপুর সংসার’ নামের চ্যাট শোতে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ও সত্যজিতের প্রসঙ্গটি আনেন কৌশিক ব্যানার্জি।
পশ্চিমবঙ্গে তখন রমরমিয়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলছে। এমনই একদিন সত্যজিতের বাড়ি যান কৌশিক। সত্যজিৎ বললেন, “তোমরা নাকি একটা ছবি করেছো লোকে খুব দেখছে, তা ছবিটার গল্পটা একটু বলো তো।”
এই কথায় কিছুক্ষণ চুপ থাকেন কৌশিক। ভাবছেন কী বলবেন। সত্যজিতের সঙ্গে সাঁপুড়ের বীণ বাজানো, ধরে জেলে বন্দি করা কখনো যায়? পরে আমতা আমতা করে বলেন, “না, ওসব আপনি কী শুনবেন। সেই রকম মানসম্মত কোন ছবি না। মানে…” সত্যজিৎ থামিয়ে দিয়ে বলেন, “না না না, তুমি এভাবে বলতে পারো না। ছবিটা লোকে দেখছে তার মানে এতে কিছু একটা আছে যেটা মানুষকে টানছে। সেইরকম স্পেশাল কী আছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।”
সম্প্রতি চন্দ্রিল ভট্টাচার্যকে নিয়ে এক আলোচনায় চিন্তক পারভেজ আলম ‘হিরক রাজার দেশে’ ও ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র তুমুলমূলক আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “গুপী গাইন বাঘা বাইন/ হিরক রাজার দেশে’র সাথে ‘বেদের মেয়ের জোসনা’র এমন বাইনারি কেন রচিত হইতে হইবে তা আমার মাথায় ঢোকে নাই। দুইটাই বাংলার ফ্যান্টাসি জনরার সিনেমা, তাই দুইটাই জনপ্রিয় হইছে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের কাছে পরিচিত যাত্রাপালার নন্দন ও বয়ান-কাঠামো ব্যবহার করছিল বলে তা জনপ্রিয়তায় সত্যজিতের সিনেমাকে ছাড়াইয়া গেছে, এইতো ঘটনা। তাই বইলা কি কৃষক সমাজের রুচি খুব খারাপ কিছু হয়ে গেছে? তাতো না। হিরক রাজার দেশে এবং বেদের মেয়ে জোসনা, দুইটা সিনেমাই কিন্তু বাঙলার আতরাফ ও অন্ত্যজদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীকে ধরার চেষ্টা করেছে।
আপনি ‘হিরক রাজার দেশে’ পছন্দ করেন বলে কি আপনার ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র নিন্দা করতে হবে? বা ভাইসভার্সা? কেনই বা করতে হবে?”
মূল ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ পরিচালনা করেন তোজাম্মেল হক বকুল। পরে কলকাতার জন্য রিমেক পরিচালনা করেন ঢাকার প্রযোজক মতিউর রহমান পানু। ঢাকায় ইলিয়াস কাঞ্চন থাকলেও কলকাতার সংস্করণে অভিনয় করেন চিরঞ্জিত, অঞ্জু ঘোষ ও কৌশিক ব্যানার্জি। সেখানে অনেক হলে মাসের পর মাস ছবিটা চলে। সে জনপ্রিয়তার সূত্রে পরে কলকাতায় থিতু হন অঞ্জু।