পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী: শাকিব ও জয়া এর আলোকিত আবির্ভাব
অবশেষে দেখলাম উদিয়মান পরিচালক ‘সাফিউদ্দিন সাফি’ পরিচালিত ও বহুল আলোচিত সিনেমা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’। এই সিনেমার ভাল মন্দ বিভিন্ন দিক নিয়ে আমার মতামতগুলি আপনাদের জানাচ্ছি।
একনজরে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’
কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্যঃ রুম্মান রশিদ খান।
চরিত্র রূপায়নেঃ শাকিব খান, জয়া আহসান, আরেফিন শুভ, রাজ্জাক, আনোয়ারা, মিমো ও অন্যান্য।
গানের কথাঃ কবির বকুল।
সুর ও সঙ্গীত পরিচালনাঃ শওকত আলী ইমন ও কৌসিক হোসেন তাপস।
কন্ঠঃ এস আই টুটুল, ন্যান্সি, চন্দন সিনহা, মুন্নী, পুলক, সোনিয়া, কিশোর, রন্টি, মুহিন, তাসিফ।
চিত্রগ্রহনঃ তপন আহমেদ।
কোরিওগ্রাফীঃ মাসুম বাবুল, সাইফ খান কালু ও জেমস এ্যান্থনী।
এ্যাকশনঃ ডি.এইচ.চুন্নু।
গ্রাফিক্সঃ জাফরিন সাদিয়া।
সম্পাদনাঃ তৌহিদ হোসেন চৌধুরী।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ সাফিউদ্দিন সাফি।
প্রযোজনাঃ ফ্রেন্ডস মুভিজ ইন্টারন্যাশনাল।
মুক্তির তারিখঃ ১৬/১০/১৩ ইং
কাহিনী সংক্ষেপঃ ঢাকা শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তি সামাদ শিকদার (রাজ্জাক) তার স্ত্রী (আনোয়ারা) ও নাতি জয় শিকদার (শাকিব) এবং নাতনী মিতু (মিমো) কে নিয়ে সুখেই দিনপাত করছেন। জয় ও মিতু সম্পর্কে এক অপরের মামাত ফুফাত ভাইবোন, যারা অনাথ অবস্থায় সামাদ শিকদারের কাছে বেড়ে উঠেছে। জয় ও মিতু দুইজনের অসম্মতিতে সামাদ শিকদার তাদের বিয়ে ঠিক করেন। কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট এর রাতেই সামাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জয় তার দাদীর কাছে জানতে পারে তার ফুফু নিষাদ (দিতি) কিভাবে তাদের বাড়ির লজিং মাষ্টার সামসুল হক (সুব্রত) কে ভালবাসার অপরাধে ঘর থেকে বিতারিত হয়েছেন এবং সেই গোপনব্যথা কিভাবে তার দাদাকে মৃত্যুপথযাত্রী করেছে। জয় তার ফুপুকে ঘরে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করে। শুরু হয় জয় এর খোঁজাখুজি। একপর্যায়ে জয় চলে আসে মালয়েশিয়া। সেখানে দেখা মেলে মোহনীয় বাঙালী ললনা জারা (জয়া আহসান) এর। চলতে থাকে জারা ও জয়ের খুনসুটি। জারা তার বন্ধু শাকিব আহমেদ (আরেফিন শুভ) সাথে জয়ের পরিচয় করিয়ে দেয় তার বাগদত্তা হিসেবে। যদিও আদতে তা সত্যি নয় এবং ব্যবসায়ী শাকিব আহমেদকে জারা তেমন পাত্তা দেয় না। হঠাৎ করে জয় এর রোড অ্যাকসিডেন্ড কাহিনীতে নতুন মোড় নিয়ে আসে। জয়ের ঠাঁই হয় জারার বাসায়। আর দ্বন্দ বাড়তে থাকে জয় ও শাকিব এর মাঝে। জয় কি পারবে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে? জারাকে পাওয়ার যুদ্ধে কে জয়ী হবে? জয় ? নাকি শাকিব আহমেদ? এর পরিনতি জানতে দেখুন ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ ।
শক্তিমত্তাঃ কাহিনীতে নতুনত্ব, তারকার সমাহার, মনোরম লোকেশন ও সুরেলা গান।
দুর্বলতাঃ চিত্রনাট্য ও সংলাপের দুর্বল বিন্যাস।
রেটিং: ৭/১০
সমালোচকের দৃষ্টিতে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’
কাহিনীঃ একটু ভিন্নধর্মী কাহিনী। লেখক বেশ সময় নিয়ে এটি লিখেছেন তা এই কাহিনীর টানটান উত্তেজনা ও মোচড় দেখলেই বোঝা যায়। একটা বিষয় খারাপ লেগেছে – কাহিনীর এক পর্যায়ে জয় ফেসবুকে তার ফুপুর সন্ধান পেয়েও শুধু শুধু ছবি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, যা হাস্যকর লেগেছে। কেননা, ইচ্ছে থাকলে সহজেই ফেসবুক থেকেই সব কিছু বের করা সম্ভব।
সংলাপঃ পুরো সিনেমার সংলাপে একটা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। যা প্রশংসার দাবীদার। তবে কিছু কিছু জায়গায় আমার আপত্তি আছে। যেমন সিনেমার শুরুর দিকে রাজ্জাক ও আনোয়ারা, শাকিব ও মিমোকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসে তর্ক করছেন – তাহলে জয় কি বসে বসে মুড়ি খাবে … এবং আনোয়ারা প্রতিউত্তরে সেই মুড়ি খাওয়ার বিষয়ে বলছেন। সকলেই হয়তো অবগত আছেন এই মুড়ি খাওয়া নিয়ে এটি বহুল প্রচলিত অশ্লীল বাক্য আছে। এরপর মালয়েশিয়ার দৃশ্যে শাকিব জয়ার কাছে জানতে চাচ্ছেন “S. Haque এর অ্যাব্রীভিএইশন (Abbreviation = সংক্ষিপ্তকরন) কি?” অবাক হয়ে গেলাম !! আদতে সংলাপটি হওয়া উচিৎ ছিল “S. Haque এক্সপ্যানডিশন (Expandition) কি?” [কেননা S. Haque নামটিই Abbreviate (সংক্ষিপ্ত করা) করা]। আবার বিরতির সময় সোহেলরানা ববিতাকে বলছেন এখন ইন্টাভেল [শুদ্ধ হবে ইনটার্ভল (Interval)] হবে !! মজার বিষয় হচ্ছে স্ক্রিনে বানানটিও লেখা ছিল INTERVEL. আমার জানতে ইচ্ছে করছে বিশ্বের দ্বিতীয় মধুর ভাষা বাংলা বাদ দিয়ে কেন শুধুশুধু ভুল ইংরেজী ব্যবহার করে সংলাপ লিখতে হবে? অন্যের ভাষা না জানলে তা পরিহার করুন।
চিত্রনাট্যঃ চিত্রনাট্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গতিময় ও সুন্দর ছিল। তবে যেহেতু এখানে অতিথীশিল্পী সোহেল রানা ও ববিতাকে তাদের স্বনামে দেখানো হয়েছে তাই তাদের আলাপের শুরুতে এক অপরকে জনসম্মুখে জড়িয়ে ধরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অশোভন মনে হয়েছে। আবার আরো একটা ব্যপারে খটকা লেগেছে। অফিসিয়াল পোষ্টার ও অন্যান্য প্রচারনায় চিত্রনাট্যকার হিসেবে দেখা গেছে রুম্মান রশীদ খান এর নাম কিন্তু টাইটল কার্ড (Title card) এ দেখলাম সাফিউদ্দিন সাফি এর নাম।
অভিনয়ঃ পুরো সিনেমার প্রাণ বলব জয়া আহসানকে। অভিনয় কিংবা গ্ল্যামার দুইদিকে তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। শীর্ষনায়ক শাকিব খান এর অভিনয়ে অভিজ্ঞতার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। অতিরিক্ত মেদবিহীন, পেশীবহুল শাকিবকে দেখতে পেলে ভাল লাগত। শাকিব ভক্তদের বলব, কোন দুইদিনের বৈরাগী হঠাৎ এসে এত সহজে তার অবস্থান নাড়াতে পারবেন না। নতুনরূপে শাকিবখানকে উপস্থাপনা ভাল লেগেছে। নবাগত আরেফিন শুভ ও মিমো যথেষ্ট ভাল করেছেন। তবে তারা আরেকটু সচেতন হলে ভাল হতো। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ নায়করাজ রাজ্জাক ও বর্ষীয়ান আনোয়ারা, অভিজ্ঞ দিতি এবং সুব্রত এর কাছে প্রত্যাশা আরো বেশী ছিল। অতিথীশিল্পী হিসেবে সোহেল রানা ও ববিতা কোনরকমে উৎরে গেছেন। সংক্ষিপ্ত সময়ে আলো ছড়িয়েছেন সাজু খাদেম।
গানঃ সিনেমার প্রতিটি গানই শ্রুতিমধুর হয়েছে। সুন্দর কথা ও সুরের জন্য গীতিকার ও সুরকার ধন্যবাদ পেতে পারেন (যদিও সুরগুলি মৌলিক কিনা তা জানিনা। সময়ই তা বলে দেবে।)। তবে ‘আকাশ হতে আমি চাই’ গানের সুরের সাথে সালমান খানের ‘জানেমন’ সিনেমার ‘শ দর্দ হ্যায়’ গানের কিছু অংশের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আফসোস আমাদের সুরকারদের স্বভাবই হয়ে গেছে ভীনদেশী কোননা কোন গানের সুর কিংবা এর কিছু সেটপিছ কপি করতেই হবে। তবে কুরুচীপূর্ণ আইটেম গানছাড়াও যে সুন্দর সিনেমা হতে পারে তা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ দেখলে বুঝা যায়।
এ্যাকশনঃ ফাইট ডিরেক্টরদের ডি.এইচ চুন্নু কিছুটা ভিন্ন ও বাস্তবসম্মত এ্যাকশন দৃশ্য পরিচালনা করেছেন, যা ভাল লেগেছে।
শিল্প নির্দেশনাঃ শিল্প নির্দেশনা মোটামুটি ভাল ছিল।
পোষাক, অঙ্গসজ্জা ও মেকাপঃ শাকিব খানকে একটু ভিন্ন কস্টিউমে ভাল লেগেছে। সেইসাথে জয়া ও শুভ এর কস্টিউম সুন্দর লেগেছে।
চিত্রগ্রহনঃ পুরো সিনেমার চিত্রগ্রহন ভাল লেগেছে। তবে কিছু কিছু শট দীর্ঘায়িত না করে আরো ভিন্ন কিছু শট নিলে ভাল লাগত। নিষাদকে তার বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার দৃশ্যে যে ফোর শট (Four Shot) নেয়া হয়েছে সেখানে এক্সিস অফ এ্যাকশন (Axis of Action) অতিক্রম করা হয়েছে যা ১৮০◦ ডিগ্রী রুল (180 degree rule) ভঙ্গ করে। শাকিবের অ্যাকসিডেন্ট দৃশ্যটিতে যে ট্রিকশট (Trick Shot) নেওয়া হয়েছে তা সর্বসাধারনের বোধগম্য ছিল।
আলোকসম্পাতঃ পুরো সিনেমাতে আলোকসম্পাত মোটামুটি ভাল হয়েছে। তবে গানের দৃশ্যগুলিতে আলোকসম্পাতের দিকে আরেকটু সচেতন হলে ভাল হতো।
সম্পদনাঃ কিছু কিছু জায়গায় জাম্পকাট (Jump Cut) দেখা গেছে। সম্পাদনায় আরো একটু সচেতন হলে আরো গতিময় সিনেমা দেখতে পেতাম।
কালার গ্রেডিং: কালার গ্রেডিং এ আরেকটু সচেতন হলে ভাল হতো। পুরো সিনেমার অধিকাংশ জায়গায় রঙের উজ্জলতা কম ছিল তাই বিবর্ন (Fade) লেগেছে। কিছু কিছু প্রচারনায় দেখেছি এই সিনেমার পোষ্টপ্রোডাকশনের কাজ হয়েছে চেন্নাই এ। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছেনা। কারন যেকোন ভাল কালার গ্রেডিং এডিটর স্বাভাবিকভাবেই জানেন কি করে কন্ট্রাস্ট কার্ভ (Contrast Curve) ব্যবহার করে রঙের উজ্জলতা ঠিক রাখতে হয়।
পরিচালনাঃ উদিয়মান পরিচালক সাফিউদ্দিন সাফি আশানুরুপ ভাল করেছেন। তবে ভবিষ্যতে আরো সচেতনভাবে কাজ করবেন সেই প্রত্যাশাই রইল।
পরিশিষ্টঃ স্বপরিবারে উপভোগ করার মতো সিনেমা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’। শাকিব খান ও জয়া আহসান এর আলোকিত আবির্ভাব আপনাকে অভিভুত করতে পারে।
দেওয়ান মাহবুবুল আলম
২২শে অক্টোবর, ২০১৩ ইং
অফিস পালিয়ে দেখতে যাওয়া পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনীটি নানা কারনে চিরায়ত পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি হয়ে উঠেছে। সাকিব খানের ছ্যাবলামির সাথে সাথে নির্মাতাদের অত্যন্ত পছন্দের মুখের রঙ, মাথার খুলির উপর পড়া কুৎসিত পরচুলা ছবিকে করেছে দর্শননিন্দিত। আলেয়া বুড়ি আনোয়ারার মাথায় কচি কচি বাল!!!!!!! শুভ যদি কোন কারনে চলচ্চিত্রে থিতু হতে পারে, তবে এই ছবি তার ক্যারিয়ারের কালো তালিকায় থাকবে, জয়াকে ভাল লেগেছে। হাতির ঝিল হয়ে গেল মালয়েশিয়া এতবড় গাজাখুরি করার আগে নির্মাতাদের চিন্তা করা উচিত দর্শকরা সচেতন হয়েছে। ছবিতে ব্যবহৃত মালয়েশিয়ার অফিসে শুভর ল্যাপটপটিতে যে জুম আল্ট্রা মডেম ব্যবহৃত হয় তাও নজর এড়ায় না। ভূল ধরলে ছবি দেখার স্বাদ নষ্ট হয় কিন্তু চিরায়ত বাংলা ছবির হার্ট এ্যাটাকের মত বেমানান দৃশ্যসহ অতি সাধারন ভুলগুলো এ ছবিতে থাকবে না এরকম একটা ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল। বিশেষ করে যখন এ ছবির কাহিনীকার যথাক্রমে বলিউড হাঙ্গামা, হিন্দুস্থান টাইমস, জিং টিভি ও ইন্টারনেট অবলম্বনে রুম্মান রশিদ খান…