প্রতিটি পলকে ভুলে যেতে চাই
পলকে পলকে তোমাকে চাই
পরিচালনা : শাহনেওয়াজ শানু
অভিনয়ে : বাপ্পী চৌধুরী, মাহিয়া মাহি, মিশা সওদাগর, সাদেক বাচ্চু, আহমেদ শরীফ, শিবা শানু, আরফান, আনন্দ খালেদ, জারা, সাগর।
রেটিং : ২/ ৫
‘স্বপ্নজাল’ ছবির নায়িকা পরী মনির অভিনয় জীবনের সবচাইতে সঠিক সিদ্ধান্ত, তিনি ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’ ছবিটিতে অভিনয় করেননি। সামান্য কিছু কাজ করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে মাহিয়া মাহি এই শূণ্যস্থান অলংকৃত করেছেন। বলা বাহুল্য, এ সিদ্ধান্তটি ছিল মাহির অভিনয় জীবনের সবচাইতে ভুল সিদ্ধান্ত।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সে কথা অকপটে স্বীকারও করেছেন মাহি। একটি ছবির নায়িকাই যেখানে তার নিজ অভিনীত ছবি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, সে ছবিটি আদতে কেমন হয়েছে, অনুমান করা যেতেই পারে। তারপরও বহুলশ্রুত সব ধরনের মন্তব্য/ বিবৃতি বাড়িতে রেখে নির্মল বিনোদন পাবার নিমিত্তে দেখতে গিয়েছিলাম ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’।
২ ঘন্টা ২৮ মিনিট ব্যাপ্তির এ ছবিটি নিয়ে খুব বেশি কিছু বলবার নেই। গল্প খুব চেনা-জানা। পরিচিত গল্পে আমার কখনোই আপত্তি নেই। তবে চিত্রনাট্যের বুনন যুৎসই হলে দেখতে মজা লাগে। ২ ঘন্টা ২৮ মিনিট এ ক্ষেত্রে খুব কম সময় মনে হয়। কিন্তু ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’ ছবির ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা। ১ ঘন্টা পার হবার আগেই ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙে গিয়েছিল।
এ গল্পে ড্রাইভার গাড়ি চালায়, কিন্তু গাড়ি চলে না (পুরোটাই অভিনয়)। শুটিং স্পট থেকে বাড়িতে ফিরতে ফিরতেই সুপার মডেল চরিত্রে অভিনয় করা নায়িকার চুলের স্টাইল পরিবর্তন হয়ে যায়। এ গল্পে অ্যাকশন দৃশ্যে ক্যামেরাসহ ক্যামেরার স্ট্যান্ডের ছায়াও দর্শক দেখতে পায়। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের খবরের ফুটেজ ব্যবহৃত হয়; যেখানে সংবাদ পাঠিকা বলেন একটা, দর্শক শোনেন আরেকটা। অর্থাৎ মূল খবরই কাট করে পেস্ট করে ডাবিংশিল্পীকে দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে সংলাপ পরিবেশন করা হয়েছে (তাও ক্লোজ শটে)। কষ্ট করে আর টেলিভিশন স্টেশনে গিয়ে কোনোকিছু ধারণ করতে হয়নি। এ গল্পে খল চরিত্র মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দের বাদ্য বেজে উঠে। নায়িকা জীবিত থাকার পরও ছবির শেষ দিকে নায়িকার মুখ থেকে নিঃসৃত হয় অন্য কোনো অশরীরীর কণ্ঠস্বর। অর্থাৎ মাহিয়া মাহি ছবির শেষ দিকে বেশ কিছু দৃশ্যের ডাবিংই করেননি। যিনি করেছেন তার সঙ্গে মাহির কণ্ঠস্বর একদমই বেমানান।
এ ছবির আবহ সংগীত যিনি করেছেন (সৈয়দ মুকলেসুর রহমান), তিনি তো হিন্দি ছবির মহাভক্ত। হাম দিল দে চুকে সানাম থেকে চোরি চোরি চুপকে চুপকে, আ আব লৌট চলে’র হাসি-কান্না-আনন্দ-বিরহ সব সিচুয়েশনের সুরই চেটেপুটে মেরে দিয়েছেন। এদিকে এ ছবির সংলাপ যিনি লিখেছেন, তার লেখনীতেও পাঠ্যপুস্তকের প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘আমার অন্তরে আজ প্রেমের আগুন প্রজ্বলিত হচ্ছে। মুক্ত বিহঙ্গের মত পুড়ছে আমার অন্তর’-এ ধরনের সংলাপ বইয়ের ভাষাকেও হার মানায়। মাহির মুখ থেকে অন্য ডাবিংশিল্পীর অপরিণত কণ্ঠে এ ধরনের বইয়ের ভাষার সংলাপ শোনা ছিল রীতিমত অত্যাচার।
আমি ভুল খুঁজতে প্রেক্ষাগৃহে যাই না। বরং ফুল খুঁজে সেটিই বড় করে দেখাতে চাই। ‘পলকে পলকে তোমাকে চাই’ ছবির সেরকম ফুল কিংবা ভালো লাগার মত বিষয় ছিল : মাহি ও বাপ্পী জুটির রসায়ন। ১ বছর ও ৩৬৩ দিন পর তাদের জুটির ছবি মুক্তি পেল। কিন্তু কী আফসোস! এ ধরনের গল্প ও নির্মাণে তাদের আমি কখনোই দেখতে চাই না। মাহিয়া মাহি একজন সুপার মডেল হয়েও কেন একটি হোটেলে আরো কিছু সখীকে নিয়ে ‘সস্তা’ভাবে নাচেন? সাধারণ মডেল আর সুপার মডেলের পার্থক্য কি জানেন গল্পকার কিংবা নির্মাতা? ‘বন্যা’ চরিত্রে মাহি তার সাধ্যমত সুঅভিনয় করার চেষ্টা করেছেন। অভিনয়ে এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে মাহি মন্দ নয়। তবে দুর্বল চরিত্রায়ণ ও নির্মাণের কারণে মাহির দিন শেষে প্রাপ্তির খাতায় যোগফল শূণ্য।
বাপ্পীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ মুহূর্তে চলচ্চিত্রের অন্যতম নির্ভরযোগ্য নায়ক বাপ্পী দেখতে ভালো। মাহির সাথে মানায়ও ভালো। অভিনয় করবার সময় তার দিক থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিকও থাকেন তিনি। তবে কুশলী নির্মাতার হাতে না পড়বার কারণে তার ‘তামিম’ চরিত্রটি মনে দাগ কাটতে পারেনি। বাপ্পীর ভয়েস মড্যুলেশন এবং কণ্ঠস্বর নিয়ে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া পাহাড়-নদী নালা-বন্দর সহ সব মনোরম লোকেশনে (গানের দৃশ্যে) নিয়মিতভাবে শেরওয়ানি পরার অভ্যাস ত্যাগ করলে খুব ভালো হয়।
মিশা সওদাগর এ ছবির মূল খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তার চরিত্রটি ছবিতে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে ঠিক। তবে দুর্বল লেখনীর কারণে মিশার অভিনয়ও খুব বেশি ভালো লাগা জন্ম দিতে পারেনি। যদিও মিশা তার নিজস্ব ক্যারিশমা দিয়ে বেশ কয়েকটি দৃশ্যে ‘বাড়তি’ কিছু সংযোজন করেছেন। শেষ অ্যাকশন দৃশ্যে ‘কানা মাছি ভোঁ ভোঁ’ কিংবা সংলাপ বলতে বলতে ক্যামেরার দিকে সাদা কাফন ছুঁড়ে মারা-এরকম আরো বেশ কিছু ম্যানারিজম মুগ্ধ হবার মতই। তবে নিজের বাবার গলায় জুতা দিয়ে পা রাখার মত দৃশ্য সিনেমায় না রাখলেই ভালো হয়। চরিত্রের নৃশংসতা বোঝাবার জন্য আরো অনেক উপায় আছে। এমন কিছু করা উচিত নয়, যা কোমলমতি দর্শকদের কাছে দৃষ্টিকটু মনে হবে।
অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কেউই চমক দেখাতে পারেননি। ছোট পর্দার তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা আরফানের এ ছবিতে অপব্যবহার হয়েছে। একটি মুহূর্তের জন্যও তিনি কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেননি। এর জন্য দায়ী চিত্রনাট্য ও সংলাপ। ছোট পর্দার আরেক মজার অভিনেতা আনন্দ খালেদও আছেন এ ছবিতে। কিন্তু গুটিকয়েক দৃশ্যে, শ্যোপিস হয়ে। তারও কিছু করবার ছিল না। সাদেক বাচ্চু, আহমেদ শরীফ, শিবা শানু কিংবা জারা ও সাগর-সবাই সংলাপ আওড়িয়ে গেছেন। দর্শকদের মুগ্ধ করতে পারেননি।
এ ছবির চিত্রগ্রহণ, আলোকসম্পাত, সম্পাদনা, শব্দগ্রহণ, রঙের বিন্যাস, রূপসজ্জা, পোশাক পরিকল্পনা, শিল্প নির্দেশনা ও গ্রাফিক্সের কাজ ছিল দায়সারা। পর্দায় দেখেই স্পষ্ট হয়েছে, সবাই তাদের কাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। নেশায় আসক্ত হতে পারেননি। অ্যাকশন ছিল চলনসই। কিছু দৃশ্যে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গি একঘেয়ে এবং কার্টুনের মত মনে হয়েছে। ‘পলকে পলকে ছবির গান’ ৫টি। গানগুলো শ্রতিমধুর। ৪টি গানই লিখেছেন সুদীপ কুমার দীপ। এ ৪টি গানই শোনা গিয়েছে ও স্বস্তি নিয়ে দেখা গিয়েছে। ইমন সাহার সুরে আঁখি আলমগীরের গাওয়া ‘তা তা থৈ থৈ’ বড়পর্দায় উপভোগ করেছি। আঁখি আলমগীরের প্লেব্যকে নিয়মিত হওয়া উচিত। ইমন সাহার সুরে কিশোর ও লেমিসের গাওয়া ‘উড়িয়ে দিয়েছি’ শুনতে ও দেখতে ভালো লাগে। ঝঙ্কার খন্দকারের সুরে কনকচাঁপা ও প্রতীক হাসানের গাওয়া শিরোনাম গান এবং আলী আকরাম শুভর সুরে কণা ও ইমরানের গান ‘নিভু নিভু’ মন্দ নয়। যদিও ‘খুব ভালো’-বলা যাবে না একটি গানকেও। এর কারণ-যথাযোগ্য যত্ন, আন্তরিকতা এবং আগ্রহ ছিল না ছবির নির্মাতা শাহনেওয়াজ শানু ও পরিচালকের। দর্শকদের বিনোদন পাবার মত খুব বেশি কিছু নেই এ ছবিতে। অর্থাৎ প্রতিটি পলকে প্রতিটি দর্শক এ ছবিটিকে ভুলে যেতেই চাইবেন। কিন্তু, আমরা কি এমন ছবিই চেয়েছিলাম?