প্রতিযোগিতা সমস্যা না, সহযোগিতাও থাকতে হবে : রিয়াজুল রিজু
‘বাপজানের বায়স্কোপ’ রিয়াজুল রিজুর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। এ সিনেমা দিয়েই মনোযোগ কাড়লেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিদের। সেরা পরিচালক ও সিনেমাসহ ৯টি বিভাগে পুরস্কার বগলদাবা করছে সিনেমাটি। আর মান বিচারে সবাই বাহবা দিচ্ছেন। বাংলা মুভি ডেটাবেজের পক্ষ থকে রিজুর মুখোমুখি হয়েছেন জুবায়েদ দ্বীপ। আসুন জেনে নিই কী কথা হলো তাদের—
আনুষ্ঠানিক একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে ?
আসলে অনুভূতিটা ব্যক্ত করা খুব মুশকিল। এটা কিভাবে বলব। কারণ এত অপ্রাপ্তির মধে হঠাৎ করে অনেক বেশি প্রাপ্তি আসলে যেটা হয়।
প্রথম দিকে লোকজন ছবিটাকে এড়িয়ে গিয়েছিল-এখনতো আপনি যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন। কী মনে হয় ?
(হাসি) আসলে এইটার জন্য অনেক কিছু ছাড়তে হইছেতো আমাকে। চাকরি-বাকরি থেকে আরম্ভ করে প্রায় সবকিছুই। এসএ টিভিতে মোটামুটি আমাকে গ্যাড়াকলে ফালাইছিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে, বউ বাচ্চারে টাঙ্গাইলে পাঠিয়ে তারপরে আমাকে এই সিনেমা বানাতে হইছে। অনুভুতি ভালো-এখন ভালো। অবশ্যই ভালো- একটু বেশিই ভালো। দেখা যাক ভাগ্য কোথায় নিয়া যায়।
ভাগ্য আপনাকে নতুন সিনেমার কাছেই নিয়ে যাবে। নতুন সিনেমা নিয়ে কিছু ধারণা দেন ?
নতুন সিনেমা বলতে একটা হিট সিনেমা বানাচ্ছি আমি। এবং এটা হিট হবে, আমি আশাবাদী যদি কোন হল পলিটিক্স, বুকিং এজেন্টদের পলিটিক্সে না পড়ে ।
যেহেতু বাপজানের বায়স্কোপ দিয়ে এই বাধাটা পার হওয়া গেছে সেহেতু একই ব্যাপার দুইবার হবে বলেতো মনে হয় না ?
অভিজ্ঞতা বলতেছে যে হওয়ার কথা না কারণ আমি আগে লোকজন একদমই চিনতাম না। এখনতো অনেককেই চিনি। অনেকেই আদর করে। ছোটপর্দার, বড়পর্দার যাদেরই চিনি তারা খুবই আদর করে আমাকে। এই জায়গা থেকে আমার মনে হয় আমি আগের থেকে অনেক বেশি এপ্রিশিয়েট পাবো, সবাই অনেক বেশি হেল্প করবে।
আচ্ছা, হিট সিনেমা মানে কেমন সিনেমা? এফডিসি হিট নাকি আয়নাবাজি হিট…
আমি আমার মতো বানাব। আমি কারো মতো বানাতে চাই না। আমি আমার ধরনে- আমার স্টাইলে বানাবো।
নতুন সিনেমা কি আবারো নিজের টাকায় বানাবেন, না প্রযোজক আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন ?
হ্যাঁ হ্যাঁ। এইটা একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। নিজেরতো টাকাতো নাই এখন আর। জমানো টাকা সব বাপজানের বায়স্কোপেই শেষ করে ফেলছি। এখন কিছু প্রডিউসারের থেকে নেব, কিছু ফান্ডিং নেব।
এখন থেকে কি শুধু সিনেমাতেই দেখব নাকি মাঝে মাঝে টেলিভিশনেও (নাটক-টেলিফিল্ম) দেখব ?
টেলিভিশনটা হচ্ছে আমার গ্রামের বাড়ির মতো। আর ফিল্মটা হচ্ছে আমার শহরের বাড়ির মতো। গ্রামকে তো কেউ কখনো অস্বীকার করতে পারে না। যেখান থেকে জন্ম তা অস্বীকার করা যায় না। টেলিভিশন দিয়েই তো আমার জন্ম। কিন্তু আমার শহরের বাসাটায় যেখানে আমি থাকি খাই ঘুমাই-সেইটাওতো আমার বাসাই। টেলিভিশন সিনেমা দুই জায়তেই থাকব।
আরেকটা ব্যাপার, বাপজানের বায়োস্কোপ আমি হলে দেখতে পারি নাই, পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা প্রদর্শনীতে দেখেছি। যেহেতু জাতীয় পুরস্কার পাওয়া গেছে, এবার কি আবার হলে আসার সম্ভাবনা আছে? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কিন্তু এরকম অনেক উদাহরণ আছে।
না, এখনতো অলরেডি পাইরেসি হয়ে গেছে। ইউটিউবে চলে গেছে। দুইটা চ্যানেলে (বিটিভি আর চ্যানেল নাইন) অন এয়ার হয়ে গেছে। এখন আর ওই বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই।
কিন্তু যেহেতু সিনেমাটা ভালো ট্রিট পায় নাই?
আসলে যে বানাইতে পারে সে সারাজীবনই বানাইতে পারে। যতদিন পর্যন্ত মাথা কাজ করে। স্টিফেন হকিং এর শরীর নাই শুধু মাথা কাজ করে। দোয়া কর, মাথাটা যেন কাজ করে। তাহলে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারব।
আরেকটা প্রশ্ন রিজু ভাই। আপনার প্রথমে ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত ছিল না- আপনি সাহস করে সিনেমা বানালেন এবং দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার জিতে নিলেন। এখন কিন্তু তরুণদের মধ্যে আপনাকে নিয়ে একরকমের আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।
আচ্ছা।
প্রশ্ন হল, যারা আগামীতে সিনেমা বানাতে চায়- তারা কী করবে? কী করা উচিত?
শুধু ফিল্ম মেকিং না, যেকোন প্রফেশনে- তার পেশার প্রতি কারো যদি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা থাকে তাহলে সেই পেশা তাকে ফিডব্যাক দেবেই। দিতে বাধ্য কারণ যে যে জায়গাটা ভালোবাসে সেটা সে জয় করতে পারে। এখানে একটা সায়েন্টিফিক ব্যাপারও আছে- দু’জন হাজব্যান্ড-ওয়াইফ যদি একে অপরকে ভালোবাসে তাহলে তাদের সন্তানটাও অনেক সুস্থ সবল হয়। এ বিষয়টাও এরকম, কেউ যদি তার প্রফেশনটাকে ভালোবাসে, কাজটাকে মন দিয়ে করে তাহলে অবশ্যই সে ফিডব্যাক পাবে।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান সমস্যা কী? সমাধান কী?
আসলে ব্যাপারটা হলো— সমস্যাহীন কোন ইন্ডাস্ট্রি নাই। সব ইন্ডাস্ট্রিতেই সমস্যা আছে।
যেমন অনেকে বলে দেশের শিক্ষিত লোকজন নাকি সিনেমা দেখে না, টেলিভিশন দেখে দেখে বড়পর্দায় আগ্রহ কমে গেছে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের আগ্রাসন এইসব সমস্যা? আমারতো ধারণা ভালো সিনেমা হলে মানুষ দেখবে- আপনার কী মনে হয়?
কম্পিটিশান থাকা তো ভালো।
হ্যাঁ।
কিন্তু সাম্যবাদিতা থাকতে হবে। প্রতিযোগিতা সমস্যা না তবে সহযোগিতাও থাকতে হবে। সাম্যের গান গাইতে হবে। টেলিভিশনে আমরা জুনিয়র ডিরেক্টররা পাই এক লাখ আশি হাজার টাকা। সিনিয়র ডিরেক্টররা পায় পাঁচ লাখ টাকা। ইন্ডিয়ান ডিরেক্টর হইলে দেখা যাবে একই কাজের জন্য সে পাবে সাপোজ দশ লাখ টাকা। কই এক লাখ আশি, কই পাঁচ লাখ আর কই বা দশ লাখ। উদাহরণ দেবার জন্য বললাম তবে মূল কথা হলো ইমব্যালেন্সটা খুব বেশি। আমাদের দেশি ডিরেক্টরকে বলা হয়, ‘তোমাকে একটা কাজ দিলাম’। এইটাই থাকে আমাদের চ্যানেলের আটিটিউড। আর একজন কলকাতার পরিচালক হলে তাকে বিরাট বাজেট দিচ্ছে- অনেক আদর দিচ্ছে, অথচ আমাদের দিচ্ছে না। আমাদের যে দিচ্ছে না, তারা কি কখনো চেষ্টা করছে আমাদের ডিরেক্টরদের সুযোগ দিতে?
দুই-একবার দিয়েছে হয়তো। তবে বিজনেসে যতটা রিস্ক নিতে হয় কোন এক অজানা কারণে আমাদের দেশে ততটা রিস্ক নেয়া হয় না। যাইহোক, যেহেতু দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার জেতা হয়ে গেল, এবার কি আন্তর্জাতিক মানের কোন কাজ করার ইচ্ছা আছে?
আন্তর্জাতিক মান মানে?
যেমন কান ফেস্টিভালে- ভারত বা এশিয়ার কোন ফেস্টিভালে দেখা যাবে এরকম কিছু?
ঐ জায়গাটা দ্বীপ একটু ডিফরেন্ট। রাজকুমার হিরানি যে সিনেমা বানায় সেটা কমার্শিয়াল হিটও হয় আবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়, তাই না? একেকজনের স্টাইল একেক রকম। আমি ফেস্টিভালে যাওয়ার সুযোগ পাইলে যাব না কেন! আবার সিনেমা হিট বানাতে কে না চায়। হিশাব হচ্ছে, এই জাজমেন্টের জায়গাটা দর্শকের। দর্শক আমাকে কীভাবে রিসিভ করছে সেটাই শেষ কথা। স্পিলবার্গ যেমন নিজে সেরাটাই বানাবার চেষ্টা করে, আবার বোকা ডিরেক্টররাও সেরাটা বানাবার চেষ্টা করে। কেউই, কোন পরিচালকই নিজেকে ছোট মনে করে না। সে মনে করে তারটাই সেরা। কিন্তু ভালো-খারাপের জাজমেন্ট করবে অডিয়েন্স। অডিয়েন্স সেটাকে কিভাবে নিচ্ছে সেটাই শেষ কথা। কিন্তু অডিয়েন্সের কাছে পৌছানোর যে রাস্তাটা- মাঝখানের রাস্তাটা ধোঁয়াশা- এটা ক্লিয়ার করতে হবে।
অর্থাৎ পরিচালক-প্রযোজক যে সরাসরি অডিয়ন্সের কাছে যেতে পারছে না- এটা ইন্ডাস্ট্রির একটা সমস্যা। আসলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? সমাধান কী?
সার্ভার সিস্টেমে। প্রত্যেকটা হলে সার্ভার সিস্টেম থাকবে। বাংলাদেশে কোন হলে সার্ভার সিস্টেম নাই।
আরো বলেন…
আমরা হাউজে বসে টেলিভিশনে যেমন একটা প্রডাকশনের অন এয়ার দেখি- এইভাবে প্রত্যেকটা হলে সার্ভার সিস্টেম চালু করতে হবে। এবং এখানে সরকারের হেল্প লাগবে। উইদাউট গভর্মেন্ট হেল্প- এইটা চালু করা সম্ভব না। এটা হলেই আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আলো দেখবে। সুদিন ফিরে পাব আমরা।
মানে সার্ভার সিস্টেম হলে, কতগুলো টিকিট কাটা হলো এটা হাউজে বসেই আমরা জানতে পারব?
রাইট। তখন দর্শক-পরিচালকের মধ্যে একদম ডিরেক্ট ইন্টারেকশন হবে ।
অর্থাৎ ঢাকায় বসে জানতে পারব কতবার হলে চলছে, কতজন দেখছে?
রাইট!
ফলে দর্শক থেকে হল মালিক থেকে প্রযোজক টাকার হিসাব থাকবে, মাঝখানের কেউ ব্লাক বা দুর্নীতি করতে পারবে না।
হ্যাঁ। কোন ভুয়া ব্যাপার থাকবে না। আমি যদি ধরাও খাই, আমি কোন জায়গাটায় ধরা খেলাম সেটা আমি নিজেই শিখতে পারব। অন্য কারও কাছ থেকে শেখা লাগবে না। যার বুঝ তার কাছে- আমার বুঝ আমার কাছে। আমাকে বুঝতে হবে, অডিয়েন্স আমার কাছে কি চায়? আর এটা বুঝতে গেলে অডিয়েন্সের সাথে সরাসরি কমিউনিকেশান লাগবে। কোন মিডল ম্যান নাই।
ধন্যবাদ রিজু ভাই
ওয়েলকাম ভাইয়া।