প্রিয়তমা: এ যেন আরেক ‘পাঠান’
শুরুতে অনুরোধ: প্রিয় হিমেল আশরাফ, হাতে সময় কম থাকলেও আগামীতে আর কখনো তাড়াহুড়া করে পরিচিত কেউ দুই মাসের শর্ট কোর্স শেষ করার সাথে সাথে তাকে ডেকে উদ্ধার পেতে সিনেমার এডিটিং করাবেন না। সিনেমার দৃশ্য পালস রেটে কাটতে হয়।
কোন প্রকার নোংরামি, এজেন্সি তান্ডব ছাড়াই জমিয়ে দিলো ঈদের সিনেমার ‘প্রিয়তমা’। এ যেন আরেক ‘পাঠান’। দুর্দান্ত মিল সিনেমা দুটোর মধ্যে। ইন্ডাস্ট্রির সবচে বড় তারকার রাজকীয় প্রত্যাবর্তন, সুপারহিট লুক, সুপারহিট গান, ভক্তদের উন্মাদনায় চারপাশ কেঁপে উঠা এবং এবং এবং সিনেমার আর্থিক ফলাফলের সাথে সিনেমার কোনো মিল না থাকা। অর্থাৎ গল্প-চিত্রনাট্য দুটোই খুব দূর্বল এবং মূল থিম এতটাই কমন যে, আমার মনে হয়, মূল গল্পে ৮/১০ টা নাটক গত বছর কয়েকে হয়ে গেছে।
শুরুতে ম্যাজিক দেখাতে একটা লম্বা ওয়ান টেক শটের ব্যবহার হয়েছে। জিমিজিব অপারেটর নাকি ক্যামেরাম্যান এই ব্যপারে অনভিজ্ঞ তা পরিচালক নিজে জানেন। তারা এই শট নেয়ার জন্য প্রস্তত নয়। বেশ কয়েকবার গিম্বেলে বা হ্যান্ড শট নিতে গিয়ে ক্যামেরা বা স্ক্রিন কাঁপাকাঁপি ছিল। এটা কি ক্যামেরাম্যানের দুর্বলতা নাকি সম্পাদনার টেবিলে এনজি শট বসানো হয়েছে, সেটাও পরিচালক জানে। আরেকটা উদাহরণ দেই। শাকিব যখন বরের সাজে নায়িকার বাড়িতে যায়, সেই দৃশ্যটাতে তার হাঁটার সময় দুইবার (বোধহয়) টুইস্ট দেখিয়ে দেয়া হয়েছে আগেই। দর্শককে হোঁচট খাওয়ানোর আগে সাসপেন্স এভাবে ফাঁস কেন হলো? দর্শককে বিশাল ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিলেন কেন? সম্পাদনার টেবিল নাকি চিত্রনাট্যের ভুল?
প্রাকৃতিক লোকেশনের ওয়াইড শটগুলো স্বাভাবিকভাবেই খুব ভালো ছিল। কিন্তু সিনেমাতে ক্লোজআপ ট্রিটমেন্ট খুবই কম ব্যবহার হওয়াটা আপত্তিজনক। শাকিব ছাড়া অন্য কারো সিনেমা হলে ক্যামেরাম্যান আর সম্পাদকই সিনেমাটিকে ডুবানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
ব্রেকআপের পর থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত শাকিবকে নতুনভাবে হাজির করা হয়েছে। আর এই নতুন শাকিবই সিনেমার জান-প্রাণ সব। এটুকুই সিনেমা। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত গত ১০/১২ বছর ধরে দেখা অতি কমন শাকিব।
তবে পরিচালক হিমেল আশরাফের একটি সাহসী পদক্ষেপকে আমি অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। তা হচ্ছে: সুপারস্টার হবার পর সব নির্মাতা স্ক্রিনে শাকিবের স্টারডমকে দেখিয়ে তালি নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। আমার ধারণা এই প্রথম কোন নির্মাতা শাকিবকে স্ক্রীনে সুপারস্টার শাকিব খান হতে না দিয়ে গল্পের মতো চালিয়েছে। এটা অনেক রিস্কি সিদ্ধান্ত অবশ্যই। কিন্তু পরিচালক তাতে উৎরে গেছেন।
বাংলাদেশের ছোট-বড় দুই পর্দারই সকল নায়িকা এবং যারা আগামীতে নায়িকা হতে চায়, সবার সিনেমাটি দেখা উচিত শুধুমাত্র ইধিকা পালের চোখ-মুখ এবং বডি ল্যাংগুয়েজের অভিনয় দেখতে। বাংলাদেশে বর্তমানে একজন নায়িকাও নাই, যে এভাবে এক্সপ্রেশন নিয়ে খেলতে পারে। তবে একটা আফসোস জানাই। এলিনা শাম্মী ভালো অভিনেত্রী। কিন্তু তাকে সাইড ক্যারেক্টারেও না রেখে এক প্রকার পাসিং রাখাটা হতাশার। সিনেমার প্রথম ক্রাইসিসের পর ২০/৩০ মিনিটের মতো যদি বাবা-ভাবি-দেবর-ভাগ্নি মিলিয়ে ফ্যামেলি বন্ডিংটা আরো ভালোভাবে বিল্ডআপ করা হতো, তাহলে সিনেমাটা অনেক ভালো হতো, ঝুলে যেত না। প্রথম দুই-তৃতীয়াংশ একদমই সহজ। ক্রাইসিস ও ইমোশনের কোনো বালাই নেই।
সিনেমার গান তো সুপারহিট। কাউকে জোর করে শুনাতে হবে না। অনেক অনেক বছর কিছু গান, গান হিসেবে টিকে থাকার সম্ভাবনা রাখে। গানগুলো শুনতেও বেশ আরামের। কিন্তু একটা গানও সিনেমার গানের সিগনেচার রাখেনি। মিউজিক ভিডিও হয়েছে মাত্র। বছর কয়েক ধরে কলকাতার আকাশ নামক ব্যক্তি নানান সিনেমায় একই গান দিয়ে যাচ্ছে, সব সিনেমায় ইমরানের গানের মতো রিপিট রিপিট রিপিট। সব গান এক রকম শুনতে ও দেখতে। প্রিয়তমাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটু ঊনিশ-বিশ। অন্যদিকে প্রিন্স ভাই তার সিগনেচার রেখেছেন। সবচেয়ে বড় যে উপকারটা করেছেন তা হচ্ছে, একদম ভিন্ন স্বাদের একটা কন্ঠ উপহার দেয়া। যা হয়ত প্রিন্স মাহমুদ বলেই সম্ভব হয়েছে।
সিনেমার মেকআপ, গেটআপ, লুক, লোকেশন, কস্টিউম সব উত্তম। কিন্তু শাকিব বরের বেশে যখন যায়, তখন যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটা বাজছিল তা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমায় বহুল ব্যবহৃত এবং সম্ভবত দেবের একটি সিনেমাতেও ব্যবহার করা মিউজিকের রিমিক্স ছিল। তাই বাদবাকি মিউজিক নিয়ে আলাপ বাদ।
যে ডেডিকেশন দিয়ে শাকিব ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাটা করেছে, তাতে একটা ব্যপার পরিস্কার যে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে সে পাগল হয়েছিল। এত কম সময়ে শেষ কবে শাকিব সিনেমা নামিয়ে দিয়েছে, সেটা হয়ত সে নিজেও মনে করতে পারবে না। এই বদলে যাওয়া শাকিব যদি আগামী বছর কয়েক পরিচালকের শাকিব হয়ে থাকার চেষ্টা করে, নিজেকে টাকা নিয়ে অভিনয় করতে আসা সুপারস্টার না ভেবে যদি আমিও সিনেমার অংশ ভেবে কাজ করে যায়, তাহলে এই শাকিবকে আমার মনে হয় না আর কোনদিন কেউ আটকে রাখতে পারবে।
নির্মাতা হিমেল আশরাফের প্রতি শুভকামনা। এই সিনেমার রেকর্ড রেসপন্স অনেক চাপে ফেলতে পারে আগামীতে। তাই পরের প্রজেক্ট শুরুর আগে এই সিনেমার কত কামালো, কত বড় হিট হলো সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবেন। সিনেমার খুব নিষ্ঠুর জায়গা। প্রতি ম্যাচে জয়ী হতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই সবাই ভুলে যায়। আপনার আগামী সিনেমাগুলোও জয়ের মুখ দেখুক। আরো ভালো সিনেমার হোক।
নিজের টাকায় টিকিট কেটে সিনেমার দেখি, অধিকার নিয়ে দেই তালি বা গালি