প্রেম, তারুণ্য ও পরিবার মিলে ‘রং নাম্বার’
রং নাম্বার
পরিচালক – মতিন রহমান
শ্রেষ্ঠাংশে – রিয়াজ, শ্রাবন্তী, আব্দুল কাদের, তুষার খান, অমল বোস, ডলি জহুর, আমিন আজাদ, আদিত্য আলম, তানভীন সুইটি, রফিকউল্লাহ সেলিম, শিরিন বকুল প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – প্রেমে পড়েছে মন, আমি আমার ভেতর থেকে নামি, তুমি যদি চাও একবার ভালোবেসে, চিকন কোমর।
মুক্তি – ২০ জানুয়ারি ২০০৫
টাকার মধ্যে ফোন নাম্বার লিখে দেয়া এমন টাকা হাতে পেয়েছেন কি কখনো? নিশ্চয়ই অনেকেই পেয়েছেন। পেয়ে কি ফোন করেছেন ঐ নাম্বারে কখনো? ফোন করলে হয় ফোনের ওপারে কারো আওয়াজ এসেছে আর বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছে ‘রং নাম্বার।’ এমন কান্ড জোট বেঁধে করলে অনেক মানুষেরই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবার কথা। এ থিম থেকে একেবারে প্রেমের মতো কোমল বিষয়ে গড়িয়ে হলো ছবি ‘রং নাম্বার’। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’-র মতো শেষ দৃশ্যের সাসপেন্সের জন্য অপেক্ষা করাতে করাতে দর্শককে টান টান উত্তেজনায় রাখা ছবি।
তখন দেশে মোবাইল নতুন এসেছে। সবার হাতে হাতে পৌঁছাতে সময়ও লেগেছে। ডিজুস সেট, এন্টেনা টানা মটোরোলা সেটগুলো দিয়ে কথা বলা যেত। নায়ক রিয়াজ আর নায়িকা শ্রাবন্তীর হাতে এই সেটগুলো ছিল সিনেমার পর্দায়। আজ যদি ইউটিউবে বসে সিনেমাটা দেখতে বসেন তো আপনার মনে দোলা দেবে স্টুডেন্ট লাইফের সেইসব দিনগুলোর কথা। তারুণ্য তো থাকেই তার সাথে অজানা কারো সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে হতে মায়া জন্মানো তারপর মায়া থেকে মায়াবতী একটা মেয়ের হৃদয়ে জায়গা করে নিলে ‘রং নাম্বার’ থেকে ‘রাইট নাম্বার’ পর্যন্ত পৌঁছতে যতক্ষণ সময় লাগে লাভ বার্ডের লাভ জার্নি চলতেই থাকে।
শ্রাবন্তী তার দল মিলে অচেনা নাম্বারে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বিভিন্ন মানুষকে বিরক্ত করে। কেউ ভালো আচরণ করে কেউ বা বিরক্ত হয় বা দু’চারটা নীতিবাক্য শুনিয়ে দেয়। মাঝখান থেকে দলের মধ্যেই একজন বান্ধবী বলে বসে-‘কত মানুষ কত ইম্পর্টেন্ট কাজে ব্যস্ত থাকে। এভাবে বিরক্ত করলে তো মানুষ আমাদের বাজে মেয়ে ভাববে। ভাববে আমরা কল গার্ল।’ সে নীতিবাক্য শ্রাবন্তী সাপোর্ট করলেও বলে-‘যুক্তি দিয়ে তো আর মজা করতে পারব না।’ রং নাম্বারে ডায়াল করে রিয়াজ পর্যন্ত পৌঁছালে শ্রাবন্তীর গতি হয়। ঘন ঘন ফোন করাতে রিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলে দেয়-‘আপনার এ ব্যবহারে আমি মোটেই ইমপ্রেসড হই নি। বাঙালি নারীদের আমি এভাবে দেখে অভ্যস্ত নই।’ কড়া কথা শোনার পর বোধোদয় হলে তখন নড়েচড়ে বসে। ক্ষমাপ্রার্থী হয় শ্রাবন্তী। তারপর ফোন করা আর কথা বলা। সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে।
সম্পর্ক তৈরির পেছনে ‘সম্পর্কের ফাঁদ’ নামক একটা মানসিক সূত্র আবিষ্কার করে শ্রাবন্তী। রিয়াজকে জানতে জানতে একটু রহস্য রাখতে চায় সে। যুক্তিটা ছিল-‘প্রত্যেকটা সম্পর্কের স্থায়িত্বের পেছনে একটা মোহ কাজ করে। কাউকে জানার জন্য যে কৌতূহল সেটা যদি শেষ হয়ে যায় তবে সে মানুষটিকে পুরনো লাগে। থাক না কিছু কথা।’ রহস্যটাকে আরো বোঝাতে উদাহরণ আসে-‘স্বামী-স্ত্রী’-র। শ্রাবন্তী বলে-‘এই স্বামী-স্ত্রীর কথাই ধরুন না। এরা বছরের পর বছর একই ছাদের নিচে থাকে কি করে বলুন তো। ফাঁদ সম্পর্কের ফাঁদ।’ রিয়াজের উত্তর হয়-‘অদ্ভুত যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন তো। জীবন নিয়ে এত ভাবেন আপনি!’ অতঃপর উত্তর-‘এটা তো সিম্পল ব্যাপার।’ মানুষ যে যার জীবন নিজের মতো করে সাজাতে পারে এবং সেটা সম্ভব না হলেও খুব বেশি অসম্ভব না। এ কথাগুলো শুনতে শুনতে আর ভাবতে ভাবতে একজন দর্শক হয়ে আপনি আরো ভাবতে পারেন যারা ফোনে কথা বলে প্রেম করে তারা শুধুই রোমান্টিক আলাপচারিতা করে না, তারা জীবন নিয়েও দু’চারটা দর্শনমূলক কথা বলে। রোমান্স চলে যখন সেটার ভাষা থাকে আলাদা। শ্রাবন্তী যখন রিয়াজকে বুদ্ধদেব বসু-র ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ উপন্যাসের লাইন শোনায় কীভাবে শরীরের সাথে শরীর মিশে মন এক হয় সেটা শুনতে রিয়াজের ভালো লাগে। রিয়াজ বা শ্রাবন্তী তখন তারুণ্যের প্রতীক হয়ে যায় যেখানে ঐ বয়সটাতে সমবয়সী বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চিরন্তন আকর্ষণটা কাজ করে। প্রেমের গন্ধটা তখনই মেলে। এরপর দেখা করার চেষ্টায় নানা অঘটন এবং সাময়িক বিরহ পর্বের যাত্রা শুরু হয়।
ক্যাম্পাস লাইফের পর ফ্যামিলি টাইম শুরু হয়। এ পার্টটি সিনেমার কমেডি পার্ট। ‘love and comedy’-র প্যারালাল এন্টারটেইনিং সেগমেন্টটি সিনেমার জন্য পয়মন্ত হয়ে ওঠে অন্তত দর্শককে খুশি রাখতে। বাড়ি আসার পর স্টেশনে বাবা তুষার খানের এলাহী কারবার দেখে বিরক্ত হয় শ্রাবন্তী। নীলফামরীর আঞ্চলিক ভাষায় আদিত্য আলমের কথার মধ্যে কমেডি ছিল ভালো। দুই বন্ধু তুষার খান আর অমল বোস মিলে কমেডি জমিয়ে তোলে সাথে থাকে আব্দুল কাদের। স্পেশালি তার ‘ইসকা লানটিস বোকে বাদ’ সংলাপে জ্যোতিষী সাজার কমেডিটা দারুণ।
প্রেমের ছবিতে যুক্তি যতই থাক আবেগটা সেখানে মহৌষধ। তাই ছবির পরতে পরতে আবেগ। কিছু আবেগ চোখে আঙুল দিয়ে ঐ ‘সম্পর্কের ফাঁদ’ এর ব্যাপারটাই ঘুরেফিরে দেখায়-
* রিয়াজকে ভালোবাসার কথা বলে ফেলে শ্রাবন্তী। রিয়াজ তার সাহসের প্রশংসা করলে শ্রাবন্তী বলে-‘ভালোবাসলে বুঝি মানুষ এমনই সাহসী হয়।’
* ফোন হারাবার পরে রিয়াজের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় বিয়ের কথা যখন চলছিল ফুপু ডলি জহুরকে শ্রাবন্তী মনের কথাটা জানায়-‘একটা অচেনা অজানা মানুষের জন্য বুকের ভেতরটা কেন এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে, ফুপু? আমি ওকে ভালোবাসি, ওকে আমি চাই।’ ডলি জহুর জানায় শ্রাবন্তীকে সে বড্ড দেরি করে ফেলেছে।
* বিয়ের পর সংসারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় রিয়াজের বোন। সংসারের মায়াজালে শ্রাবন্তী আটকে যায় বিবেকের কাছে। রিয়াজ সোজা বলে দেয়-‘শৈশবের পুতুলখেলার কথা ভেবে সব ভুলে যান।’ শ্রাবন্তী বলে-‘পুতুলখেলা! ভালোই বলেছেন।’ নারী-পুরুষ সংসারের দর্শন আলাদা বোঝা যায় এ কথোপকথনে।
* বান্ধবীরা চলে যাবার সময় একজন পেছন ফিরে শ্রাবন্তীকে একটা মূল্যবান কথা বলে-‘জানি না বিষয়টা তুই কিভাবে নিবি তারপরেও বলি। জীবনে কিছু কিছু বাস্তবতাকে চাইলেও ওভারলুক করা যায় না। কি বলতে চাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পাচ্ছিস।’ পরামর্শটা জীবনমুখী।
* ট্রেনে রিয়াজ নেমে যাবার সময় আব্দুল কাদের শ্রাবন্তীকে বই উপহার দেয় এবং তার আগে একা একা মন খারাপ করে নিজে নিজে বলে রিয়াজ-শ্রাবন্তী সব ভুলে নিজেদের ভালোবাসতে পারে কিংবা সংসার করতে পারে। রিয়াজ যাবার সময় ‘যাই’ বললে শ্রাবন্তী বলে ‘বলুন আসি।’ তারপর শ্রাবন্তী পড়ে যেতে ধরলে হাত ধরে আটকায়। দুজনের এক্সপ্রেশন তখন অসাধারণ। রিয়াজ নামার আগে বলে-‘ভালোবাসার মানুষকে কখনো ঠকাবেন না।’
* রিয়াজ চলে গেলে লাগেজের ভেতর থেকে ফুপু ডলি জহুরের চিঠি পড়ে শ্রাবন্তী। মায়ের মতো ফুপু তাকে স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বলে এবং সেটাই তার আসল ঠিকানা।
এ আবেগী মুহূর্তগুলো সিনেমায় দর্শককে বুদ রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।
সবগুলো চরিত্র মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছে। রিয়াজ-শ্রাবন্তী জুটি পুরো হাইপ তুলেছিল ঐসময়। দর্শক আশা করেছিল তাদের আরো সিনেমা পাবে কিন্তু আর হয় নি সেটা। রিয়াজের মতো প্রফেশনাল অভিনেতার সাথে শ্রাবন্তীও ছিল প্রফেশনাল। শ্রাবন্তী নিজের মতো অসাধারণ পারফর্ম করেছে। সিরিয়াসনেস যেমন দারুণ ছিল ঢং করার অভিনয়ও দারুণ। যেমন- রফিকউল্লাহ সেলিমকে রং নাম্বারে জব্দ করার সময় তার স্ত্রী যখন পরিচয় দেয় শ্রাবন্তী বলে-‘তুষার ম্যারেড?আমার এখন কি হবে?’ বলে ঢং করতে থাকে। অসাধারণ ছিল। তানভীন সুইটির সাথে পার্কে রিয়াজের কথা এবং শ্রাবন্তীর খোদ পরিচালক মতিন রহমানের কথা বলা এ দুটো মজার ছিল। ডলি জহুর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল।
গানগুলোতে প্রথমেই শ্রাবন্তীর হাইপ তোলা গানটি আসে-
‘প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।’
গানটি ঐবছর রেডিও, টিভিতে ঝড় তুলেছিল। ভিসিআরে যখন বের হয়েছিল দোকানে দোকানে ছড়িয়ে গিয়েছিল। রিয়াজের ‘তুমি যদি চাও একবার’ গানটি নচিকেতার লিপে অদ্ভুত সুন্দর ছিল। গানের মাঝে ‘বুঝলে কন্যে’ বলার সময়টা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘চিকন কোমর’ গানটা ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। টাইটেল ট্র্যাকটা বেশ ভাবায়-
‘আমি আমার ভেতর থেকে নামি
নেমে যাকে খুঁজি
দেখা নাই তার
রং নাম্বার।’
কথাগুলো গভীর। নিজের ভেতর থেকে নিজের জেগে ওঠা তারপর প্রিয় মানুষকে খোঁজা। রং নাম্বারে ডায়াল করলে মিলেও যেতে পারে তার দেখা। মেহরিনের ব্যতিক্রমী কণ্ঠে দারুণ ছিল ট্র্যাকটি।
ছবি দেখতে দেখতে খেয়াল করতে হবে একজোড়া পাখি একটা গাছে দুই দিকে দুই ডালে বসে আছে। তারা পরস্পরকে খুঁজছে কাছে থেকেই কিন্তু পাচ্ছে না। সিনেমায় তারা আবির (রিয়াজ) আর অথই (শ্রাবন্তী)। ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসে জানিয়ে দেয়া হয়-‘এরা এত কাছে থেকেও দুজনকে খুঁজছে। রং নাম্বারে প্রেম হয়ে গেল নাকি?’ এই পাখিজোড়া সিনেমার থিম। পাখিরা কপোত-কপোতী হয়ে লাভ বার্ডের কথা বলে। আজকাল ফেসবুকে ব্যবহৃত ইমো ‘রং নাম্বার’ নামটিতে ‘অনুস্বার’-এ ব্যবহৃত হয়েছে। মতিন রহমান লোগো তৈরিতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
প্রণব ভট্টের স্ক্রিপ্টে আর মতিন রহমানের প্রেমদরদী নির্মাণে ‘রং নাম্বার’ শুধুই রসের কথা বলে দু’চারটা গান আর মারপিটের সাথে রোমান্স দেখানোর সিনেমা নয়। রুচিশীল নির্মাণে জীবনমুখী গল্পের ছবি যে গল্পে প্রেম, তারুণ্য, পরিবার জীবনের এ অবধারিত সত্য বিষয়গুলো আবেগী হয়ে উঠেছে। আজকের রোমান্টিক ছবির নির্মাতাদের জন্য এ গল্প ও ছবি উদাহরণ। দর্শককে গল্পকার ও নির্মাতা অপেক্ষা করাতে পেরেছেন শেষ দৃশ্য পর্যন্ত যখন রিয়াজ-শ্রাবন্তীর রেললাইন ধরে দৌড় দিয়ে দুজন দুজনের জন্য ছুটে আসে ‘কবি ও দেবী’ রহস্যজট খোলার পর। আব্দুল কাদেরের কথায় শুনি-‘দ্য রং নাম্বার ইজ নাউ দ্য রাইট নাম্বার।’ শ্রাবন্তী কিছু বলতে চাইলে রিয়াজ চুপ করিয়ে বলে-‘নিশীথে কইও কথা।’ ফিনিশিং ডায়লগে এটা তো অমৃত।