ফান দিয়েছে ‘ক্যাপ্টেন খান’, তবে…
ক্যাপ্টেন খান
পরিচালনা: ওয়াজেদ আলী সুমন
অভিনয়ে: শাকিব খান, শবনম বুবলি, মিশা সওদাগর, অমিত হাসান, সম্রাট, সাদেক বাচ্চু, ডন, শিবা শানু, ডিজে সোহেল, যাদু আজাদ, সুব্রত, কমল পাটেকার, ববি, সুমিত গাঙ্গুলি, রিফাত চৌধুরী ও আশীষ বিদ্যার্থী
রেটিং: ৩/ ৫
২০১৪ সালের আগষ্টে তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দেখেছিল সুরিয়া অভিনীত চলচ্চিত্র ‘আনজান’। ঠিক চার বছর পর এই আগষ্টেই বাংলাদেশে মুক্তি পেল একই কাহিনীর চলচ্চিত্র, শাকিব খান অভিনীত ‘ক্যাপ্টেন খান’। প্রযোজক শাপলা মিডিয়ার সেলিম খানের ভাষ্য মতে, তারা নাকি ‘আনজান’-এর স্বত্ব কিনে ‘ক্যাপ্টেন খান’ নির্মাণ করেছেন। তারা নাকি কপি করেননি, অনুকরণ করেছেন (দুটির মধ্যে পার্থক্য কি, জাতি জানতে চায়)। তামিল ভাষার গল্প বঙ্গানুবাদ করাকে নাকি কপি বলেনা, একই ভাষায় দুই ধরনের গল্প বলাকে কপি বলে! মজাদার এসব বিনোদনমূলক উদ্বুতি নিয়ে বাক্য ব্যয় করা মানে সময়ের অপচয়। ওসব এড়িয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের আগে ভাবতে বসেছিলাম, যে ছবি মুক্তির পর পরিচালক লিঙ্গুসামী এবং নায়ক সুরিয়া টুইটারে হাসির পাত্র বনে গিয়েছিলেন, ট্রল বন্যায় ভেসে গিয়েছিলেন, যে ছবির সমালোচনা করতে গিয়ে সমালোচকরা ০.৫ থেকে সর্বোচ্চ ২ রেটিং দিয়েছিলেন, যে ছবি ৬৫ কোটি রূপীতে নির্মাণ করে ভারত থেকে মাত্র ৪৬ কোটি রূপী ঘরে তুলে ‘ফ্লপ’ ছবির তকমা পেয়েছিল, সে ছবি কেন আমাদের কিনে আনতে হবে কিংবা বাংলায় নির্মাণ করতে হবে? মূল ছবি ‘আনজান’-ও অবশ্য রিমেকের অভিযোগ থেকে মুক্ত ছিল না। ঐ ছবির ‘রাজু ভাই’ চরিত্রটি অনেকটা ‘বাশা’ ছবির মত, দুই চরিত্রের রূপান্তরের প্লট অনেকটা ‘বিশ্বরূপম’-এর মত, কিছু স্টান্ট দৃশ্য ‘পোকিরি’র মত এবং স্যুট-বুট পড়া মাফিয়া সম্রাটদের প্লট ‘বিল্লা’র মত। এমনকি লিঙ্গুসামির নিজের পরিচালিত ছবি ‘রান’-এর সাথেও ‘আনজান’-এর অনেকাংশেই মিল রয়েছে।
এমনিতেই প্রযোজক শাপলা মিডিয়ার ‘আমি নেতা হবো’ এবং ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়া’ এ বছরের অন্যতম ‘স্বাদহীন’ চলচ্চিত্র হিসেবে আমার তালিকায় সবার ওপরে আছে। তাছাড়া ‘ক্যাপ্টেন খান’ এর টিজার দেখেও আতংকিত হয়েছিরাম; অযথাই অদ্ভুতভাবে ‘এ লিজেন্ড’, ‘এ মিথ’ শব্দগুলোর ব্যবহার দেখে। প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, আরেকটি রুচিহীন চলচ্চিত্র অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। প্রত্যাশার পারদ এক প্রকার শূণ্যের কোঠায় রেখেই ‘ক্যাপ্টেন খান’ দেখা শুরু করলাম এবং শুরুতেই ধাক্কা। অবশ্য এই ধাক্কার কারণ ভিন্ন।
ইদানিংকালে সেন্সর বোর্ডে যারা আছেন, তারা চলচ্চিত্রের প্রিভিউ করতে গিয়ে আসলে কি কি দেখেন, খুব জানতে ইচ্ছে হয়। কারণ প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রের শুরুতেই অসংখ্য ভুল বানান দিনের পর দিন দেখে আসছি। এ ছবিতেও: ‘শিল্পী’ লিখতে গিয়ে ‘শিল্পি’, ‘স্থির চিত্র’ লিখতে গিয়ে ‘স্থীর চিত্র’, ‘ক্যাশিয়ার’ লিখতে গিয়ে ‘ক্যাসিয়ার’, ‘ট্রান্সপোর্ট’ লিখতে গিয়ে ‘টানসপোর্ট, ‘আশীষ বিদ্যার্থী’ লিখতে গিয়ে ‘আশীষ বির্দ্যার্থী’, ‘তত্বাবধায়ক’ লিখতে গিয়ে ‘তত্বাবদান’-এরকম অগণিত ভুলে ভরা বানান শুরুতেই গলধঃকরণ করতে হয়েছে। খুব আফসোস হচ্ছিলো। এর শেষ কোথায়? নির্মাতারা কবে এসব ব্যাপারে আরো আন্তরিক হবেন? এমনকি সবশেষে ‘এন্ড’ না লিখে নির্মাতা ‘দ্য এন্ড’ লিখলেও পারতেন। আমি ভুল ধরতে প্রেক্ষাগৃহে যাই না। বিনোদিত হতে যাই। কিন্তু কতদিন আর এসব ভুল এড়িয়ে যাবো আমরা? কতদিন আর সবকিছুকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবো? কেন দেখবো? এর উত্তর কার কাছে আছে?
‘ক্যাপ্টেন খান’ এর গল্প যেহেতু আগে থেকেই জানা ছিল, তাই ওয়াজেদ আলী সুমনের নির্মাণ ও কারিগরী দিকে মন দেয়ার চেষ্টা করি। তামিলের ‘রাজু ভাই’ কতটা বাংলার ‘ক্যাপ্টেন খান’ হয়ে উঠতে পারেন, সেটিই দেখতে চাইছিলাম। সত্যি বলতে ‘আনজান’ আমার ভালো লাগেনি বিধায় মূল ছবির অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছিলাম। হয়তো সে কারণেই ‘ক্যাপ্টেন খান’-এর প্রথম দৃশ্য থেকেই গল্পে ঢুকে গেলাম। সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, সুপারস্টার শাকিব খান (ক্যাপ্টেন খান) এবং সু অভিনেতা শাকিব খান (আসিফ খান) এর রূপান্তরটা বেশ লাগছিল। চশমা পড়া সাদাসিধে শাকিব খানকে পরিমিত অভিনয় করতে দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের আগে যতটা নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে গিয়েছিলাম, ধীরে ধীরে সেটি বদলে যেতে শুরু করেছিল। যদিও দুই বন্ধুকে নিয়ে মূল গল্প, তারপরও এ ছবির নামকরণ ‘ক্যাপ্টেন খান’ যথার্থ হয়েছে। শুনেছি ৬৫ কোটি রূপীর ‘আনজান’ নির্মাণ করতে গিয়ে পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন ৪ কোটি টাকা পেয়েছেন। তবে তিনি যে পুরো টাকাটা জলে না ফেলে সদ্ব্যবহার করেছেন, তা আমরা পর্দায় দেখতে পেয়েছি। নিঃসন্দেহে শাপলা মিডিয়ার আগের ছবিগুলোর তুলনায় ‘ক্যাপ্টেন খান’ অনেক দিক দিয়েই এগিয়ে। এর অন্যতম কারণ পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন ও তার স্মার্ট নির্মাণ।
ধার করা, চেনা-জানা কাহিনীর বাংলায় চিত্রায়ণ করতে গিয়ে পরিচালক সুমন কোনো পান্ডিত্য দেখাতে চাননি। পরিচালক লিঙ্গুসামির মত একই রাস্তায় হেঁটেছেন। একই ভাবে সব কিছু দেখতে চেয়েছেন। সেই কবুতর, সেই কৃত্রিম বৃষ্টির পানি, সেই ট্যাক্সি ক্যাব স্টেশন, ছাতা, বোরকা, প্রেক্ষাগৃহে পেপসি’র গ্লাস, চশমা, ক্রাচ-সবকিছুই। এটি ঠিক, অনুকরণ করতেও মেধা লাগে। ‘ক্যাপ্টেন খান’ দেখে আবারো বুঝেছি পরিচালক সুমনের সে মেধা রয়েছে। যখন যেখানে যা দরকার, তিনি তা করেছেন। মসজিদে চিত্রধারণ থেকে শুরু করে ফোনে কথা বলতে বলতে নায়ক সম্রাটের বার-বি-কিউ করা, বিয়ের দৃশ্য, মধুমিতা সিনেমা হলে কথোপকথন, বিএফডিসিতে মাজারের সেট তৈরি করে ধরপাকড়ের দৃশ্য ধারণ, শিবা শানু-ক্যাপ্টেন খানের অ্যাকশন দৃশ্যে পুরো অফিসের সেটআপ, ট্যাক্সি ক্যাব স্টেশনে পুরো দৃশ্য এবং সামগ্রিকভাবে ঢাকাকে দেখানো-সব মিলিয়ে পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন চেষ্টার কোনো কার্পণ্য করেননি। এমনকি কক্সবাজারের সি-গাল হোটেলের বাইরে মাউন্ট রয়েল ইউনিভার্সিটি তৈরি করে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই সবকিছু দেখাতে চেয়েছেন তিনি। ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ধারণ করা দৃশ্যও বাস্তবিক লেগেছে। ভিএফএক্স-এর কাজ কৃত্রিম মনে হয়নি।
তবে মূল ছবিই যেহেতু নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে ভরপুর ছিল, পরিচালক পারতেন দেলোয়ার হোসেন দিলকে নিয়ে ছবির কাহিনী ও সংলাপে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে, যুক্তির জায়গাগুলো আরো পোক্ত করতে, বিশ্বাসযোগ্য করতে। তিনি তা করেননি। পুলিশ কমিশনার আব্দুর রহমান (আশীষ বিদ্যার্থী) হাতে গোনা ক’টি দৃশ্যে অভিনয় করে পরবর্তীতে হাওয়ায় মিলিয়ে যান। কেন? তার পরিণতি দেখালে কাহিনী পূর্ণতা পেতো। অবশ্য তার মেয়ে রিয়া/ মুসকান-এর (বুবলি) চরিত্রটিই যেখানে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন, বাবার খবর কে রাখবে? রিয়ার চরিত্রটি না থাকলে এ ছবির গল্পে কোনো হেরফের হতো না। প্রশ্ন জাগে, ক্যাপ্টেন খান হারিয়ে যাবার পর রিয়া কেন জামাল (সাদেক বাচ্চু)-এর বাড়িতে আশ্রয় নেন? তার তো বাবা বেঁচে ছিলেন। তাছাড়া বুকের মাঝখানে তিন-তিনটি বুলেট ঢুকে যাবার পরও কি করে কেন্দ্রীয় চরিত্র অক্ষত থাকেন, প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্তত এ বিষয়টি গল্পে খুলে বলা যেতো। ইব্রাহিম (মিশা সওদাগর) কে অবিশ্বাস্য স্টাইলে ক্যাপ্টেন খানের অপহরণ করার দৃশ্য কিংবা একই চেহারার দুজন মানুষকে খল চরিত্রদের আলাদা করতে না পারাটাও হজম করতে কষ্ট হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য অসঙ্গতিতে ঠাসা ‘আনজান’/ ‘ক্যাপ্টেন খান’-এর কাহিনী ও চিত্রনাট্য।
সংলাপ রচয়িতা দেলোয়ার হোসেন দিল এ ছবিতে তার ক্যারিশমা দেখাবার সুযোগ পাননি। তিনি মূলত মূল ছবির সংলাপ রচয়িতা বৃন্দা সারথী’র সংলাপের বঙ্গানুবাদ করেছেন। যেমন: ক্যাপ্টেনকে কেউ মারতে পারেনা। সে নিজেই নিজের মৃত্যু ডিসাইড করে/ যে তার মালিকের সাথে বেঈমানি করে, সে আমার বিশ্বাসী হবে কি করে?/ হীরা হীরাকে কাটে, লোহা লোহাকে আর বেঈমান কাটে বেঈমানকে/ আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন আন্ডারপার্কিংয়ে আন্ডারওয়্যার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?। নতুন লেখা কোনো সংলাপ পাইনি, যা মন ছুঁয়ে যেতে পারে। জানতে ইচ্ছে হয়, লিঙ্গুস্বামীর কাহিনীকে কিংবা বৃন্দা সারথীর বেশির ভাগ সংলাপকে কি করে দেলোয়ার হোসেন দিলের নামে চালিয়ে দেয়া হলো? যদি স্বত্ব কিনে আনাই হয়, মূল লেখকদের প্রতি কোথাও কোনোভাবে দায় স্বীকার করা যেতো না?
তবে সব অমানিশা এড়িয়ে এ ছবির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল নাম ভূমিকায় শাকিব খানের অভিনয়। বলতে দ্বিধা নেই, ক্যাপ্টেন খান ও আসিফ খান দুই চরিত্রেই শাকিব খান ছক্কা পিটিয়েছেন। সুপারস্টার ইমেজকে লালন করতে গিয়ে শাকিব খান সচরাচর সব ছবিতে তার অভিনয়ের নানা সত্তা মেলে ধরার সুযোগ পান না। এ ছবিতে আসিফ খান চরিত্রে কিছু সময়ের জন্য হলেও তিনি তা পেরেছেন। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর সালমান শাহের সঙ্গে যেমন ‘কায়ামাত সে কায়ামাত তাক’-এর আমির খানের তুলনা চলেনা, ঠিক তেমনি তামিলের সুরিয়ার সঙ্গে বাংলার শাকিব খানের তুলনা চলে না। দুজন দুজনের জায়গায় সেরা। তবে এটাও ঠিক, শাকিব খানের আরেকটু সুঠামদেহী শারীরিক গঠন হলে সবকিছু আরেকটু উপভোগ্য হতো। কারণ আসিফ খান হিসেবে শার্ট ‘ইন’ করে পড়ার কারণে কিংবা ‘ম্যাঁও ম্যাঁও’ গানে আর্মি জ্যাকেটের নিচে ছাই রংয়ের টিশার্টে তার মেদবহুল ‘পেট’ চোখ এড়ায়নি। পুরো ছবিতে ‘ক্যাপ্টেন খান’ চরিত্রে আরেকটু স্টাইলিশ, আরেকটু ফ্যাশনেবল পোশাকে শাকিব খানকে দেখতে চেয়েছিলাম। অনেকটা ‘ডন’ চলচ্চিত্রের শাহরুখ খানের মত। তবে সব আশা পূরণ না হলেও অভিনয় দিয়ে সব হতাশা দূরে ঠেলে দিয়েছেন শাকিব খান। অন্তত ‘ক্যাপ্টেন খান’ দেখবার সময় মনে হয়েছে শাকিব খানকে সরিয়ে দিলে এ ছবি অনেকটাই নিষ্প্রাণ মনে হতো। বিশেষ করে যে দৃশ্যে ডন শাকিব খানকে গুলি করেন, সে দৃশ্যে শাকিব খানের অভিনয় দেখে আমি ও আমার আশেপাশের দর্শকরা সজোরে হাত তালি দিয়েছি। কোনো সন্দেহ নেই, এ বছর এখন পর্যন্ত ‘ক্যাপ্টেন খান’-ই শাকিব খান অভিনীত শ্রেষ্ঠ ছবি।
সাম্প্রতিক কালে প্রতিটি ঈদের মত এবারও ঈদের ছবিতে শাকিব খানের নায়িকা শবনম বুবলি। রোজার ঈদে মুক্তি পাওয়া কিংবা গত বছরে মুক্তি পাওয়া ‘অহংকার’ চলচ্চিত্রে বুবলি অভিনীত চরিত্র শাকিব খান অভিনীত চরিত্রের চাইতেও কোনো অংশে কম ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে বেশিই ছিল। তবে এবার লিঙ্গুসামির ‘আনজান’-এর প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সামান্থা অভিনীত ‘শ্যো পিস’ চরিত্রকেই বাংলায় রূপ দিতে হয়েছে। আগেই বলেছি, বুবলি অভিনীত রিয়া/ মুসকান চরিত্র না থাকলে গল্পে কোনো ব্যত্যয় ঘটতো না। তবে এটাও ঠিক, বুবলি যতটুকু সময় পর্দায় ছিলেন, স্বাভাবিক ছিলেন, স্বত:স্ফূর্ত ছিলেন। স্পষ্ট উচ্চারণে বলা তার ডাবিং শ্রুতিমধুর লেগেছে। কনে সাজে বিয়ের দৃশ্যেও তাকে দেখতে বেশ লেগেছে। যদিও ছবির শেষ দিকে ‘মুসকান’ চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে পরিমিত অভিনয়ের কিছুটা খামতি দেখা গিয়েছে। অবশ্য তার অভিনীত চরিত্রটি দুই দেশেই লেখা হয়েছে বেশ দায়সারাভাবে। তবে সব মিলিয়ে বুবলি হতাশ করেনি। বরং ভালো লেগেছে। বিশেষ করে নাচের দৃশ্যে বুবলি আগের চেয়েও অনেক বেশ সাবলীল ছিলেন। তবে শাকিব খান-বুবলি জুটির কিছু সময়ের জন্য বিরতি নেয়া খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, দর্শক প্রতি নিয়ত নতুনত্ব চায়, ভিন্নতা চায়। শাকিব খানের সঙ্গে অন্য নায়িকা এবং বুবলির সঙ্গে অন্য নায়ককে দেখাটা এখন সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করি তারা দুজনই বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
মিশা সওদাগরকে যেমন প্রায় দুই বছর পর (পুরনো ছবি ‘পাংকু জামাই’ বাদে) শাকিব খানের সাথে একই ফ্রেমে অভিনয় যুদ্ধ করতে দেখে ভীষণভাবে পুলকিত হয়েছি। এ ছবিতে ‘ইব্রাহিম’ চরিত্রে মিশা সওদাগরের ‘এন্ট্রি সিকোয়েন্স’-এ দর্শকরা মুহূর্মুহু তালি দিয়েছেন। ‘পলিউশন’ নিয়ে তার সংলাপ বলার ধরণ, বিশেষ করে তিনি যেভাবে ‘ইব্-ড়া-হিম্’ বলেন, তা এক কথায় ‘অপূর্ব’। ‘আনজান’ থেকেও ‘ক্যাপ্টেন খান’ যে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে, তা হলো: নায়ক ও খল নায়কের শেয়ানে শেয়ানে অভিনয়ের লড়াইয়ের দৃশ্য। সাদা স্যুট, সাদা দাড়িতে মিশা সওদাগরকে আর দশটা চলচ্চিত্র থেকে আলাদা করা গেছে। কিছু দৃশ্যে উচ্চকিত অভিনয় করতে হলেও বাহুল্য মনে হয়নি। বরং তার চরিত্রে যতটুকু মসলা দরকার, তিনি তা দিয়েছেন। এ কারণেই হয়তো আফসোস বেড়ে গিয়েছে, আর দশটা ছবিতে মিশা সওদাগর এভাবে নিজের মেধা প্রদর্শনের সুযোগ পান না। খল চরিত্র ‘সিংহ’র মত হুংকার না দিলে যে নায়কের চরিত্রও ‘বাঘ’-এর মত গর্জন দিতে পারেনা বা দিলেও মানানসই মনে হয় না, তা অনেক কাহিনীকার ও নির্মাতাই খেয়াল রাখেন না। আশা করি সামনের দিনগুলোতে মিশা সওদাগরের মত অভিনেতারা তাদের সত্যিকারের মেধা প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন এবং নিয়মিতভাবে আমাদের চমকে দেবেন।
চিত্রনায়ক সম্রাটকে এ ছবিতে ‘জয়’ চরিত্রে পেয়েছি। অন্য ধরনের চরিত্র। অন্য ধরনের গেট আপ। আপাতদৃষ্টিতে এ চরিত্রের জন্য তাকে ‘ভুল নির্বাচন’ মনে হলেও শেষ পর্যন্ত সম্রাট হতাশ করেননি। বরং তার জন্য একটা মায়া কাজ করেছে শেষ পর্যন্ত। আশা করি ভিন্ন ধারার চরিত্রে সম্রাট চলচ্চিত্রে নিয়মিত হবেন।
অমিত হাসান এ ছবিতে ‘আর কে’ চরিত্রে বরাবরের মতই অভিনয় করেছেন। ভালো লাগার মত কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেননি। বিশেষ করে তার কৃত্রিম দাড়ি ছিল বেশ হাস্যকর। এ ক্ষেত্রে রূপসজ্জাকর শতভাগ দায়ী। প্রযোজক ৪ কোটি টাকা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন, আশীষ বিদ্যার্থী, সুমিত গাঙ্গুলি কিংবা ভারত থেকে কমেডিয়ান নিয়ে আসতে পারেন, ভারতীয়দের দিয়ে আইটেম গান তৈরি করতে পারেন, অথচ রূপসজ্জার ব্যাপারে এত উদাসীনতা কেন?
সাদেক বাচ্চু অন্য ছবিগুলোর তুলনায় এ ছবিতে অনেকটাই স্বাভাবিক ছিলেন। উচ্চকিত অভিনয় তাকে করতে হয়নি। এ কারণে তাকে বেশ ভালোও লেগেছে। শিবা শানু, ডন, আমিন সরকার তাদের চরিত্রে স্বাভাবিক ছিলেন। আশীষ বিদ্যার্থী অভিনয় করার কোনো ধরনের সুযোগই পাননি। বিশেষ করে তার ডাবিং যিনি করেছেন, ভালো করতে পারেননি। এত টাকা খরচ করে বিদেশী অভিনেতাকে দেশীয় ছবিতে এ ধরনের চরিত্রে কেন নিয়ে আসতে হবে, প্রশ্ন থেকেই যায়।
‘ক্যাপ্টেন খান’ ছবিতে গান রয়েছে চারটি। এর মধ্যে রাফাতের সুর করা, সুদীপ কুমার দীপের লেখা, রাফাত-আয়শা মৌসুমীর গাওয়া শিরোনাম গানটি যে হিন্দি ‘ডন’ ছবির ‘ম্যয় হু ডন’ গানের অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে, তা বোঝা যায়। তবে চিত্রায়ণের কারণে গানটি গল্পের গতির সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণই মনে হয়েছে। ভালো লেগেছে। একই কথা প্রযোজ্য একই গীতিকার ও সুরকারের ‘এমন করে বলো কেন তাকাও’ গানের ক্ষেত্রেও। রাফাত ও কোনালের গাওয়া এ গানটিতে কোনালের মিষ্টি কণ্ঠ মন ছুঁয়েছে। তবে রাফাতের কণ্ঠ ভালো লাগেনি। সুফিয়ানা ধাঁচে নির্মিত এ গানে শাকিব খান ও বুবলিকে দেখতে ভালো লেগেছে। তাদের কস্টিউম, মেকআপও ছিল দৃষ্টিনন্দন। তবে হারমোনিয়াম নিয়ে সুরের সাথে যথাযথভাবে শাকিব খানের রিড না বাজানো চোখে লেগেছে। তাছাড়া একটি বিশেষ স্টাইলে শাকিব খানের পাঁচবার পা ঝেড়ে ফেলার মুদ্রাও ভালো লাগেনি।
‘ম্যাঁও ম্যাঁও’ গানে সে তুলনায় শাকিব খান ও বুবলি দারুণ নেচেছেন। তবে প্রথম দুইটি গানের ব্যবহার কাহিনীকে বাড়তি গতি দিলেও ‘ম্যাঁও ম্যাঁও’-এর ব্যবহার যথার্থ হয়নি। দৃশ্যপট ছিল এরকম: বুবলি শাকিব খানকে অভিমান করে মারছেন, গ্যংস্টার শাকিব আহ্লাদিত হয়ে বন্ধু সম্রাটকে বলছেন-বুবলি তাকে মারছেন। সম্রাট প্রত্যুত্তরে বলেন: বিয়ের আগেই এমন, বিয়ের পর বুঝবে ঠ্যালা। এই সংলাপের সাথে ‘ম্যাঁও ম্যাঁও’ শব্দের কোনোভাবে সংযোগ করে মজা করা যেতো। সংলাপ শেষ হবার সাথে সাথে গান শুরু হলে গল্পের গতি বাধাগ্রস্ত হতো না। এখানে গানের আগে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ক্যামেরা ফ্রিজ হয়ে থাকাটা কিছু সময়ের জন্য গল্প ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ব্যংককে চিত্রায়িত এই গানের কথা নিয়েও আপত্তি আছে: ‘ঢাকাতে আইস্যা পাশেতে বইস্যা কি একখান গান বানাইছি/ মেঘলা দুপুরে তোর ঐ নুপূরে মনটারে বাধাই দিছি’! প্রশ্ন হলো, ব্যংককের মাঝে নায়ক-নায়িকা ঢাকা পেলেন কোথায়? তাছাড়া নায়িকার পায়ে তো কোনো নূপুর-ও নেই। গানের কথার সঙ্গে চিত্রায়ণের মিল থাকার বোধটুকু নৃত্য পরিচালকের থাকাটা জরুরী। তাছাড়া দক্ষিণ ভারতের মত গান করতে গিয়ে ‘ক্যাপ্টেন’ কে কেন ‘ম্যাঁও ম্যাঁও’ করতে হবে? Nonsense Rhyme থাকতেই পারে গানে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের চরিত্রের সাথে ‘ম্যাঁও ম্যাঁও’ শব্দদ্বয় ছিল একদমই বেমানান।
এ ছবির শেষ গান ‘কাঞ্চা পিরিত’ আমজনতাকে তৃপ্ত করেছে। তাদের উল্লাসই সেটি বলে দিচ্ছিলো। আকাশের সুর করা, প্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আকাশ ও তৃষা চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া এ গানটির চিত্রায়ণে আধুনিকতার ছাপ ছিল। পাশাপাশি আইটেম কন্যাও ভালো নেচেছেন।
কারিগরী দিক দিয়ে শুরুতেই প্রশংসা করতে হয় চিত্রগ্রাহক সাইফুল শাহীনকে। বেশ কিছু এরিয়াল শট দেখতে বেশ লেগেছে। ওয়াইড স্ক্রিনে শ্যুট হওয়াতে সবকিছুই, বিশেষ করে ঢাকা’কে দেখতে ভালো লেগেছে। পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন এ ছবিতে লোকেশনের বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন। ‘ক্যাপ্টেন খান’ ছবির অন্যতম প্রধান প্লাস-ই বলবো এই বিষয়টিকে। এ ক্ষেত্রে পরিচালক ও প্রযোজক সাধুবাদ পাবেন। শিল্প নির্দেশক, নৃত্য পরিচালক এবং রূপসজ্জাকর তাদের দায়িত্বে সচেতন ছিলেন। সম্পাদক তৌহিদ হোসেন চৌধুরীর সম্পাদনা ভালো, তবে আরো ধারালো হতে পারতো। বিশেষ করে স্টান্টের সময় ব্যবহার করা দড়ি বাদ দেয়ার সম্পাদনা নিখুঁত ছিল না। ভিএফএক্সের কাজ অন্য দশটা চলচ্চিত্রের সাথে তুলনায় বেশ সন্তোষজনক ছিল। যদিও শাকিব খানকে গুলি করে পানিতে ফেলে দেয়ার দৃশ্য আরো বাস্তবিক হতে পারতো। আবহ সংগীতে ইমন সাহা তার নামের সাথে এ ছবিতে পুরোপুরি সুবিচার করতে পারেননি। ‘আনজান’ ছবির ৬০ ভাগ আবহ সংগীত এখানেও পেয়েছি। নতুন করে যা পেয়েছি, তা আরো ভালো হতে পারতো। অ্যাকশন দৃশ্যেও রাজেশ কান্নানের কোরিওগ্রাফি আরো ভালো হতে পারতো। তবে শব্দগ্রহণ, আলোক সম্পাত ও রং বিন্যাসের কাজ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে নির্মাণ করা সেটের আলোক সম্পাত বেশ ভালো ছিল।
সব মিলিয়ে ভালো-মন্দের মিশেলে ‘ক্যাপ্টেন খান’ আমাকে যেমন মুগ্ধ করেছে, সেই সঙ্গে হতাশও করেছে। তবে হতাশার তুলনায় মুগ্ধতার পাল্লাই ভারী। বিশেষ করে শাকিব খানের শক্তিশালী অভিনয়, তার সঙ্গে মিশা সওদাগরের পাল্লা দেয়া অভিনয়, পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমনের আধুনিক নির্মাণ, লোকেশনের বৈচিত্র্য, গানের সঠিক ব্যবহার-সব মিলিয়ে ‘ক্যাপ্টেন খান’ নিয়ে এতটুকু প্রত্যাশা না থাকলেও পর্দা নামার পর হাত তালিই দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে অন্য দর্শকদের উল্লাস, শিস আমাকে অনেক বেশি উস্কে দিয়েছে। তবে ধার করা কাহিনীতে বিনোদিত হয়ে কখনোই খুব বেশি তৃপ্তি বোধ করিনা। এ কারণেই আশা করি নির্মাতা ওয়াজেদ আলী সুমন ভবিষ্যতে অন্য দেশের কাহিনীতে আশ্রয় না নিয়ে তার মেধা মৌলিক কাহিনীর ছবিতে ব্যবহার করবেন। ‘ক্যাপ্টেন খান’ আনন্দ দিয়েছে সত্যি, তবে আমাদের সবারই মাথায় রাখতে হবে অন্যের পথ অনুসরণ করে ‘ক্যাপ্টেন’ হওয়া যায়না। ‘ক্যাপ্টেন’ হতে হলে নিজেকেই উদাহরণ তৈরি করতে হয়। নতুন গল্প তৈরি করতে হয়। নতুন কিছু দেখাতে হয়। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে নির্মাতারা আমাদের এই প্রত্যাশা বিবেচনায় রাখবেন।