Select Page

ফোক-ফ্যান্টাসির রাজা ইবনে মিজান

ফোক-ফ্যান্টাসির রাজা ইবনে মিজান

হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে…. আসিতেছে এই পর্দায়, ফ্যান্টাসি জগতের রাজা ইবনে মিজান পরিচালিত ছবি— ঠিক এভাবেই ৭০-৮০ দশকের পুরোটা জুড়েই ট্রেলারে তার নামটি উচ্চারিত হতো। বিশাল হল পর্দা কেঁপে উঠতো আর আনন্দে ভরে যেতো দর্শকদের হৃদয়। কারণ একটাই, সেটা যে ইবনে মিজানের নতুন ছবি!

তার ছবিই মানে শুধুই বিনোদন আর কল্পরাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। যেখানে দেখা মিলতো দৈত্য-দানব, সুন্দরী পরী থেকে নানান সব জীব-জানোয়ার সঙ্গে তরবারির ঝনঝনানি বিশাল সব দালান-কোঠা থেকে নায়ক-নায়িকাদের বাহারী রঙের পোশাক; সঙ্গে নাচ-গান; এ যেন মনোরঞ্জনের পুরো ডালা সাজিয়ে নিয়ে আসতেন নতুন নতুন চলচ্চিত্র।

বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করতে যে কজন পরিচালক পূর্ব পাকিস্তানে একেবারে শুরুর থেকে হাল ধরেছিলেন তাদের একজন ইবনে মিজান। সেই ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৯ সালের একেবারে শেষ দিক পর্যন্ত তিনি অসাধারণ বৈচিত্র্যময় সব নির্মাণে বাংলা চলচ্চিত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক উচ্চতায়। যে সময়টাকে স্বর্ণালি যুগ বলি তার বহু অংশ জুড়েই সাক্ষী হয়ে থাকবে ইবনে মিজানের সফল চলচ্চিত্রগুলো।

স্বাধীনতার পরের দুই দশকে মিজান সাহেবের ছবি মানেই হিট, সুপারহিট থেকে বাম্পার হিট। যার নতুন ছবি মানেই হল মালিকদের ঈদের খুশি, পুরো সপ্তাহ জুড়ে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। মিজান সাহেব নিজস্ব ধারার ছবি বানাতেন; বিশেষ করে ফোক-ফ্যান্টাসি ছবি নির্মাণে তিনি ছিলেন সবার ওপরে, এ ধরনের ছবি নির্মাণে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ তিনি। তাই তার নামের আগে বলা হতো ‘ফ্যান্টাসি জগতের রাজা ইবনে মিজান’। আবার ‘পুনর্মিলন’-এর মতো সামাজিক ছবি নির্মাণ করেছেন তিনি।

তিনিই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে গ্রাফিকসের ব্যবহার দেখিয়েছিলেন, প্রথম দেখিয়েছিলেন আকাশে মানুষ উড়ার দৃশ্য, পানির নিচে বসবাস, বিশাল দৈত্যের হাতের তালুতে আস্ত একটি প্রাসাদ উড়িয়ে নেওয়া থেকে আরও বহু চমকদার দৃশ্য। যা সময় বিবেচনায় ঢাকায় প্রায় অসাধ্যই ছিল। দর্শকরাও সে সব ছবি দেখেছে মনের তৃপ্তি মিটিয়ে। শুধু ফোক-ফ্যান্টাসিই নয়, সামাজিক অ্যাকশনধর্মী ছবিতেও তার সাফল্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

মিজান সাহেব বিশাল দেহ ও রাশভারী একটা ইমেজ নিয়ে চলাফেরা করতেন। চলচ্চিত্রের সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধা আর সম্মানের পাত্র।

ব্যবসায়িক সাফল্যের বরপুত্র ইবনে মিজান যে সব ছবি নির্মাণ করে অমর হয়ে আছেন— একালের রূপকথা (যৌথ), আবার বনবাসে রূপবান, রাখাল বন্ধু, জরিনা সুন্দরী, পাতালপুরীর রাজকন্যা, আমির সওদাগর, ভেলুয়া সুন্দরী, শহীদ তিতুমীর, নাগিনীর প্রেম, কত যে মিনতি, কমলরানীর দিঘি, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, দুই রাজকুমার, বাহাদুর, শাহজাদা, তাজ ও তলোয়ার, একমুঠো ভাত, নিশান, নাগনাগিনীর প্রেম, পাতাল বিজয়, লাইলী মজনু, পুনর্মিলন, রাজবধূ, বাগদাদের চোর, রাজকুমারী, সতীনাগ কন্যা, রাজনর্তকী, বসন্ত মালতী, বাহাদুর নওজোয়ান, জলপরি, সাপুড়ে মেয়ে, সাগর কন্যা, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা ইত্যাদি।

ইবনে মিজানের জন্ম ১৯৩০ সালে সিরাজগঞ্জে, তার পরিচালিত (যৌথ) প্রথম ছবি ‘আউর গম নেহি’ (উর্দু) মুক্তি পায়নি, পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে তার একক পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘একালের রূপকথা’ (২৬/০২/১৯৬৫) আর সর্বশেষ সাত্তার, জিনাত ও সুচরিতা অভিনীত ‘সাগর কন্যা’ (১০/১১/১৯৮৯)! মিজান সাহেব শুধু একজন পরিচালকই ছিলেন না ছিলেন একজন সফল প্রযোজকও, বেশ কয়েকটি ছবিও তিনি প্রযোজনা করেছিলেন।

১৯৯০ সালে ইবনে মিজান সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার করোনা শহরে চলে যান তার বড় ছেলে টিটো মিজানের কাছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আরিফুল হাসান

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন