বন্ধুত্বের জয় স্রোতের পরাজয়
সামাজিক আন্দোলনের অনেক মাধ্যম আছে। সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম সম্ভবত চলচ্চিত্র। যে কোনো সামাজিক বক্তব্যকে জনে জনে পৌঁছে দিতে চলচ্চিত্রের ভূমিকা আছে। ফাখরুল আরেফিন খান নির্মিত ‘গণ্ডি‘ (২০২০) ছবি সামাজিক আন্দোলনে চিরন্তন একটি বক্তব্যকে ধারণ করে নির্মিত হয়েছে। তাঁর প্রথম ছবি ছিল ‘ভুবন মাঝি’ (২০১৭)।
এ ছবির সাথে সামাজিক আন্দোলনের বিষয়টি আগে ক্লিয়ার করা যাক। শেষ বয়সের বাস্তবতাটি প্রতিটি মানুষের জন্য সত্য। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে তারুণ্য ও বার্ধক্যের তফাত করতে গিয়ে বার্ধক্য সম্পর্কে বলেছেন-‘বার্ধক্যকে কেউ গ্রহণ করতে চায় না।’ গ্রহণ না করার যে সামাজিক বাস্তবতায় একজন মানুষ বৃদ্ধকালে পৌঁছে যায় তখন তার মনে বন্ধুত্ব বা কারো সাথে মেশার দরকার পড়ে। সেটি বিপরীত লিঙ্গের সাথেও হতে পারে। তার সেই স্বাভাবিক চাহিদাকে কাছের বা সমাজের আর দশজন স্বাভাবিকভাবে নেয় না। যার জন্য নিঃসঙ্গতা তাকে গ্রাস করে নেয়। এর ফলে একসময় হয়তো চূড়ান্ত বাস্তবতায় পড়ে তাকে যেতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে বন্ধুত্বের চিরন্তন চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করে সেটাকে চলচ্চিত্রে পরিবেশন করলে সামাজিক আন্দোলনের পর্যায়েই পড়ে যায় মেসেজ হিসেবে। সেই আন্দোলনের একটা পদক্ষেপ ‘গণ্ডি’ ছবি।
শাব্দিক অর্থে ‘গণ্ডি’ অর্থ ‘সীমা, বেষ্টনী।’ পশ্চিমবঙ্গের লেখক শুভজিৎ রায়ের একটি গল্প থেকে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। গল্পে শেষ বয়সের দুজন মানব-মানবীকে ট্যাক্সি ঠিক করে দিতে দেখা যায় বৃষ্টির দিনে। তারা ট্যাক্সিতে উঠে গল্প শুরু করে।
সেই থিম থেকেই ছবিটি নির্মিত হয়েছে। এদিক থেকে সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত ছবিও বলা যায়।
ছবির গল্পে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকর্তার সাথে আরেকজন মহিলার বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। তাদের পরিচয়পর্বটা শুরু হয় মজার ঘটনা থেকে। তারপর সেই কর্মকর্তার ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম থেকে তার পাশে থাকার একটা প্রয়োজন তৈরি হয়। এভাবে দুজন শেষ বয়সী মানব-মানবীর চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাদের বন্ধুত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটাই দেখার বিষয়। এ দুজন হচ্ছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী ও সুবর্ণা মুস্তাফা। এই প্রথম তাঁরা একসাথে অভিনয় করেছেন। এ দুজন কিংবদন্তিই ছবির প্রাণ।
ছবিতে বন্ধুত্বের দিকটা গল্পের প্রধান বিষয়। বন্ধুত্বটা দুদিক থেকে দেখানো হয়েছে :
১. দুজন শেষ বয়সের মানুষের বন্ধুত্ব
২. দাদু-নাতনীর বন্ধুত্ব
সব্যসাচী-সুবর্ণার বন্ধুত্বকে দেখাতে তাঁদের রসায়নকে ধরাবাঁধা রোমান্টিকতায় না রেখে বয়সের সাথে ম্যাচিং করে কিছু মজার ঘটনা রেখে খানিকটা কমেডির সাথে দেখানো হয়েছে। এতে করে ম্যাচিউর জিনিসটা থেকেছে। আর দাদু-নাতনীর বন্ধুত্বকে প্রযুক্তির সাথে তুলে ধরা হয়েছে একটা চিরন্তন বন্ধনকে কেন্দ্র করে। শেষ বয়সে মানুষ তার ভেতরের শিশুটিকে খুঁজে পায় ছেলেমেয়েদের সন্তানের ভেতর এবং নাতনীর সাথে সেই বন্ধুত্বটাই দেখানো হয়েছে।
এর সাথে শৈশব-যৌবন-বার্ধক্য ত্রিভুজ সময়কে ছবির চরিত্রে তুলে ধরা হয়েছে।
সমাজের বাধাকে কেউই উপেক্ষা করতে পারে না। ছবিতে সামাজিক বাধাটিকে স্রোত বলা যায়। স্রোতের বিপরীতে চলতে গেলেই বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। অপর্ণা ঘোষের চরিত্রটি সামাজিক বাধাকে দেখিয়েছে। কিছুটা নেগেটিভিটি রেখে তার চরিত্রটি ছবিতে চরিত্রের দ্বন্দ্ব এনেছে। তার সাথে আরো একটি চরিত্র যোগ হয়েছে। স্রোত বা বাধা ভেঙে বন্ধুত্বের জয় কীভাবে হয় শেষ পর্যন্ত ছবিতে দেখানোর লক্ষ্য সেটাই ছিল।
– নিজের সাথে হেঁটেছেন?
– নিজের সাথে?
– কেন! আপনার কি মনে হয়নি এ জীবনে নিজেকে সবচেয়ে কম সময় দিয়েছেন
– জানি না আর বেলা শেষে জানতেও চাই না।
নিজেকে চেনার গুরুত্ব কয়জন উপলব্ধি করে! মানুষ অনেককে চিনতে চিনতে সময় অনেক পার করলেও নিজেকে চিনতে পারে না, নিজের জন্য সময়ও রাখতে পারে না। ছবির সংলাপে নিজেকে জানার জন্য মেসেজ দেয়া হয়েছে।
– বন্ধুত্ব, গল্প, আড্ডা এগুলো কি শুধুই তোমাদের? আমাদের জন্য কি শুধুই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা
শেষ বয়সের করুণ বাস্তবতা এ সংলাপে পরিষ্কার।
‘মানুষ তার জীবনকে নিয়ে গর্ব করে অথচ মানুষ ছাড়া কারো জীবন এত হীন নয়। মানুষ ছাড়া আর কারো জীবনে কোনো গণ্ডি নেই।’
সংলাপ এভাবেই পুরো ছবিতে শক্তিশালী ছিল। ‘বারান্দা’-কে দারুণভাবে সিগনিফাই করা হয়েছে। যে বাড়িতে বারান্দা নেই সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মনের খবর নেবার মতো সময়ও কারো নেই।’
অভিনয়ে সব্যসাচী-সুবর্ণার রসায়নই প্রাণ ছিল। তাঁরা অসাধারণ। নাতনীর চরিত্রে মুগ্ধতা মোর্শেদ ঋদ্ধি চমৎকার ছিল। সব্যসাচীর মতো কিংবদন্তি অভিনেতার সাথে অভিনয়ে তার কোনো জড়তা নেই। এই শিশুশিল্পীর ভবিষ্যৎ ভালো। অপর্ণা ঘোষ নতুন চরিত্রায়ণে দারুণ। ছবির শেষে তার সংলাপেই দর্শক হাততালি দেবে। ডাক্তার চরিত্রের অভিনেতা বেশ ইন্টারেস্টিং। মাজনুন মিজান চলনসই। ছবির গানের মধ্যে টাইটেল ট্র্যাকই সেরা। চোখে পড়ার মতো নেগেটিভ দিক ছিল ছবির কানে ধরা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এছাড়া ছবির প্রথম আধঘণ্টা স্লো লাগতে পারে।
মূলত বন্ধুত্বের কোনো সীমা নেই। গণ্ডির মধ্যে তাকে ফেলা যায় না। সময়, আধুনিকতায় যতই আমরা এগিয়ে যাই না কেন মানসিকতায় এখনো কনজারভেটিভ মোটাদাগে। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে মানুষের মনের খবর রাখার জন্য ‘গণ্ডি’ ছবি বন্ধুত্বকে পথ্য রূপে দেখিয়েছে। বন্ধুত্বের জয় হোক।
‘গণ্ডি’-র মতো ছবি আরো হোক।
রেটিং – ৭.৫/১০