ববিতা : একজন বাংলাদেশি অভিনেত্রীর গল্প
ষাটের দশকের শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে যশোরের ফরিদা আখতার পপি নামের এক কিশোরীর যার চলচ্চিত্রে নাম রাখা হয় ‘ববিতা’। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সর্বপ্রথম পুরস্কার লাভ করার গৌরব অর্জন করেন অভিনেত্রী সেই কিশোরী ফরিদা আখতার পপি অর্থাৎ ববিতা।
শুধু প্রথমবারই পুরস্কার পাওয়া নয় এরপর টানা আরও ২ বার মোট একটানা তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করে হ্যাট্রিক করেছিলেন অভিনেত্রী ববিতা।
ষাটের দশকের শেষ দিকে (১৯৬৮) পরিচালক জহির রায়হান এর ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ ছবির মাধ্যমে ববিতার চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয়। জহির রায়হান ছিলেন ববিতার আপন বড় বোন সুচন্দার স্বামী। সেই দুলাভাই জহির রায়হান এর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটলেও প্রথম ছবি ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ পরিচালক জহির রায়হান শেষ করতে পারেননি। এরপর আবারো জহির রায়হানের ‘সংসার’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান। সেই সুত্রে ববিতার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘সংসার’। এ ছবিতে তিনি নায়ক রাজ্জাক ও নায়িকা সুচন্দার মেয়ের অভিনয় করেন যেখানে টাইটেলে তার নামছিল সুবর্ণা।
১৯৬৯ সালে তিনি নুরুল হক বাচ্চুর পরিচালিত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে প্রথম নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই ছবিতেই তিনি সুবর্ণা নাম বদলে ‘ববিতা’ নাম দিয়ে অভিনয় শুরু করেন। এভাবেই একজন যশোর থেকে আসা ঢাকা গেণ্ডারিয়ায় পরিবারের সাথে বসবাস করা সেই অতি সাধারন কিশোরী পপি হয়ে উঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী ‘ববিতা’। সেই শুরু বাংলা চলচ্চিত্রে একজন ববিতার পথ চলা দর্শকদের মন জয় করে।
স্বাধীনতার পর একে একে মুক্তি পেলো অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী – (১৯৭২) আলোর মিছিল, বাদী থেকে বেগম, ডুমুরের ফুল বসুন্ধরা, গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমনি, সুন্দরী অনন্ত প্রেম, লাঠিয়াল, এক মুঠো ভাত, আকাঙ্খা, মা, ফকির মজনু শাহ, সূর্য গ্রহণ, এখনই সময়, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি, বড় বাড়ির মেয়ে, পেনশনসহ সব কালজয়ী ছবি যা দর্শকদের হৃদয়ে গেথে থাকবে সারা জীবন।
১৯৭৮ সালের দিকে বাংলাদেশের মাস্টারমেকার হিসাবে খ্যাত এ জে মিন্টুর প্রথম ছবি ‘মিন্টু আমার নাম’ মুক্তি পায়। এই ছবি দিয়ে ববিতা পরিচালক মিন্টুর আস্থা অর্জন করেন এবং একটানা ‘প্রতিজ্ঞা’ ‘প্রতিহিংসা’, ‘চ্যালেঞ্জ’ সুপারহিট ছবিগুলোতে অভিনয়ের দক্ষতা রাখেন। বাদী থেকে বেগম , লাঠিয়াল , নয়নমণি একটানা তিনটি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেস্থ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন।
ববিতার ক্যারিয়ারের আমজাদ হোসেনের নির্মিত গোলাপি এখন ট্রেনে,সুন্দরী, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি ছবিগুলো চিরকাল বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মাস্টার পিস চলচ্চিত্র হিসেবে থাকবে। ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রটি ছিল ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাধিক শাখায় রেকর্ড পুরস্কার পাওয়া একটি চলচ্চিত্র।
বাংলাদেশের প্রথম ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের চলচ্চিত্র দেওয়ান নজরুলের সুপারহিট ‘আসামী হাজির’-এ দ্বৈত চরিত্রের ববিতা কিংবা ‘বারুদ’ ছবিতে নায়ক সোহেল রানা ও ওয়াসিমের একমাত্র বোন ববিতাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ‘বারুদ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নায়কবিহীন, রোমান্স ও নাচগান বিহীন এক চরিত্রে তবুও দর্শকদের কাছে সেই ববিতাকেই ভালো লেগেছিল এবং ছবির শেষদিকে দুই ভাইবোন সোহেল রানা ও ববিতার মৃত্যু দর্শকদের কষ্ট দিয়েছিল। রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানা, ওয়াসিম, জসিম, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনসহ সময়ের সকল সুপারহিট নায়কদের বিপরীতে অভিনয়ে সবার সাথেই সফল এই মেধাবী অভিনেত্রী। বিশেষ করে জাফর ইকবালের সাথে তার রোমান্টিক জুটিটি একসময় দর্শকদের কাছে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়।
আমজাদ হোসেনের ‘সুন্দরী’ সিনেমায় ছিলেন জসিমের মেয়ে চরিত্রে নাম ভুমিকায়। পরবর্তীতে জসিম খলনায়ক থেকে নায়ক হওয়ার পর জসিমের বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে রাজী ছিলেন না। অনেকদিন পর অবশেষে জসিমের বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে রাজী হলেন আওকাত হোসেনের ‘উচিৎ শিক্ষা’ সিনেমায় যে সিনেমাটি সেই বছর একটি শাখায় জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করেন। পর্দায় জসিম–ববিতা জুটিকে দর্শক গ্রহণ করে নেয়। এরপর কামাল আহমেদের ‘রাজাবাবু’, জিল্লুর রহমানের ‘টাইগার’সহ আরও বেশকিছু সিনেমায় জসিম –ববিতা জুটি সফলতা পায়।
ববিতার ক্যারিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি চলচ্চিত্রের নাম ‘অশনি সংকেত’। ভারতীয় ক্যামেরাম্যান নিমাই ঘোষ স্বাধীনতার পর ঢাকাতে এফডিসিতে এসে তার প্রায় ১৫০ থেক ২০০ ছবি তুলে নিয়ে যান।ওনাকে সত্যজিৎ রায় ছবি তুলতে পাঠিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর তাদের বাসায় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে চিঠি আসে প্রাথমিক মনোনয়নের কথা জানিয়ে।সুচন্দা ও ববিতা তখন ভারতে যান সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করতে। সত্যজিৎ তাকে দেখে অনেক লাজুক ভেবেছিলেন।তাই ইন্দ্রপুরের স্টুডিওতে আবার তাকে পরীক্ষা করেন।পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সত্যজিৎ বলেন, “আই অ্যাম সো হ্যাপি, আমি অনঙ্গ বউ আজকে পেয়ে গেছি।আমি ভাবতেও পারিনি এই মেয়েটি সেদিনের সেই মেয়েটি। আজকে এই মেয়ে সম্পূর্ণ অন্য মেয়ে।এই আমার অনঙ্গ বউ।” ববিতাও অনেক চাপের মুখে ছিলেন তাকে নেয়া হয় কিনা।তিনি বলেন, “একজন অল্পবয়সী বাঙালী যা করে- ভেতরে ভেতরে অনেক মানত-টানত করে শেষে জানলাম, আই ওয়াজ সিলেক্টেড ফর দেয়ার মুভি।”
কাজী হায়াতের ‘ধর’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন একজন বিহারী নারী চরিত্রে। সিনেমার গল্পে সন্ত্রাসী ও গডফাদার ডিপজলের সেবাদাসী হিসেবে দারুণ অভিনয় করেছিলেন যিনি ডিপজলের ‘অবৈধ’ সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন কিন্তু ডিপজল থাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি ও সন্তানের পিতৃত্বের স্বীকৃতি দিতে চায় না যা ছিল সিনেমাটির গল্পের টার্নিং পয়েন্ট। বিহারী ববিতার সন্তানের পিতৃত্বের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ডিপজলের সাথে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িত হয় ডিপজলের আশ্রিত জন্ম পরিচয়হীন আরেক যুবক মান্না। সিনেমার পর্দায় হাসপাতালে ববিতা ও মান্নার কথোপকথনটি আজও মনে পড়লে দর্শকদের চোখে অশ্রু চলে আসে। ববিতা ‘ধর’ সিনেমায় প্রমাণ করেছিলেন অভিনয় করার মতো চরিত্র পেলে ববিতা এখনও দর্শকদের অনেক কিছু দিতে পারেন, ববিতা আজও ফুরিয়ে যাননি।
ববিতা হলেন আমাদের চলচ্চিত্রের সময়ের সোনালি সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও ফ্যাশন সচেতন মেধাবী অভিনেত্রী। শিবলি সাদিকের ‘তিন কন্যা’ ছবিতে আমরা সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ তিন বোন সুচন্দা, ববিতা ও চম্পাকে দেখতে পাই। সেখানেও তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে স্টাইলিশ অভিনেত্রী ছিলেন ববিতা। লাভ ইন সিঙ্গাপুর, মিস লংকা, দূরদেশ, প্রেমিক, অবুঝ হৃদয় চলচ্চিত্রগুলোর ববিতাকে কখনও ভুলে যাবে না সেদিনের দর্শকরা। গ্রামীণ,শহুরে, সামাজিক অ্যাকশন, পোশাকী,রোমান্টিক সব ধরনের ছবিতেই তিনি সাবলীলভাবে অভিনয় করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন।তৎকালীন সময়ে তিনি ফ্যাশনের ক্ষেত্রে শহরের মেয়েদের ভীষণ প্রভাবিত করে।চিরকাল মনে প্রানে একজন ‘বাংলাদেশী’ চেতনার এই মেধাবী ও চিরস্মরণীয় অভিনেত্রী নার্গিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছবির পর নতুনধারার ডিজিটাল মানহীন চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন না বলে আজ অভিনয় থেকে দূরে আছেন ।
ববিতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্রের তালিকা: জ্বলতে সুরুজ কি নীচে, সংসার, স্বরলিপি, টাকা আনা পাই, শেষ পর্যন্ত, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আলোর মিছিল, বাদী থেকে বেগম, ডুমুরের ফুল, বসুন্ধরা, গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমনি, সুন্দরী, অনন্ত প্রেম, লাঠিয়াল, এক মুঠো ভাত, আকাঙ্খা, মা, ফকির মজনু শাহ, সূর্য গ্রহণ, এখনই সময়, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি, বড় বাড়ির মেয়ে, পেনশন, আসামী হাজির, দহন, চন্ডীদাস ও রজকিনী, দীপু নাম্বার টু, অশনি সংকেত, রামের সুমতি, নিশান, মিন্টু আমার নাম, নাগ-নাগিনী, দোস্তী, প্রতিজ্ঞা, বাগদাদের চোর, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, প্রতিহিংসা, নাগ পূর্ণিমা, চ্যালেঞ্জ, হাইজ্যাক, মায়ের জন্য পাগল, তিনকন্যা, লটারী, শ্বশুরবাড়ি, মিস লংকা, জীবন পরীক্ষা, জীবন সংসার, লাইলি মজনু …আরও অনেক।