Select Page

আবদুল্লাহ জহির বাবু, আমরা কিন্তু আসল-নকল চিনি

আবদুল্লাহ জহির বাবু, আমরা কিন্তু আসল-নকল চিনি

Abdullah Zahir Babu prominent screenplay writer script writer of bangladeshi film son of filmmaker actor Zahirul Haqueপ্রথমেই আপনার সাম্প্রতিক অসাধারণ সাক্ষাৎকারের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আপনি সাহস করে অনেক ভেতরের কথা বলেছেন যে কথাগুলো আমাদের দর্শকদের কাছে মূল্যবান। আপনার কথায় সিনেমাপাড়ার ভেতরের রাজনীতি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি আপনার কথায় আপনার নিজের কিছু ব্যক্তিগত মতামতও ফুটে ঊঠেছে। ব্যক্তিগত মতামতের জায়গায় বলতে গিয়ে আপনি একটা বড় কথা বলে ফেলেছেন যে কথাটি এখন একটা টপিক হয়ে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে।

আপনি বলেছেন-
‘বাংলাদেশের প্রথম ছবি থেকে শুরু করে সবই তো নকল’

শুধুমাত্র এ কথাটাই সোজা বাংলায় এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা লেবুর রসের মত হয়ে আপনার পুরো সাক্ষাৎকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আপনার কথার পিঠে এখন প্রতিবাদও হচ্ছে যেটা করা আমাদের দর্শকদের অধিকার বা কর্তব্য দুটোই। আপনি যখন এ কথাটি শুরু থেকেই বলেছেন তখন মহামান্য আব্দুল জব্বার খান-কে খুব মনে পড়ছে যে ব্যক্তিটি আমাদের সিনেমার জাগরনের স্বপ্ন দেখে ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণ করেছিলেন।আপনি বলেছেন প্রথম সিনেমা থেকে সবই নকল কিন্তু আপনার কথা তো সত্য নয়। ‘মুখ ও মুখোশ’ আমি দেখেছি এটা অসামান্য কাজ ছিল। ঐ সময়ে এত আপগ্রেটেড সিনেমা নির্মাণ হয়েছে দেখেই তো বিস্মিত হয়েছি। আমার মত আরো অনেকেই হয়তো হয়েছে। এ সিনেমাটি মেীলিক ছিল, নকল ছিল না।আব্দুল জব্বার খানের নাটক এবং পরে উপন্যাস হিশেবে প্রকাশিত ‘ডাকাত’ উপন্যাস থেকে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল। তাহলে তো প্রমাণ হল যে আপনি মিথ্যাচার করেছেন। কিন্তু আপনি এত কথার ভিড়ে এই বড় কথাটিই বা কেন বলতে গেলেন সেটি বোধগম্য হচ্ছে না…

আপনি প্রথম সিনেমা থেকে আজ পর্যন্ত সবগুলোকে নকল বলার সময় চিন্তার মধ্যে রাজ্জাক,বুলবুল আহমেদ-দের সময়ের কথা মাথায় রেখে বলেছেন কিনা বা তাদের পরবর্তী সময়ের আরো যে অসাধারণ কাজগুলো হয়েছে সেগুলোর কথা মনে রেখে বলেছেন কিনা বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ। আমি আপনাকে খুব বেশিজনের নাম বলব না। সেকাল থেকে একাল কয়েকজন নির্মাতার কথা বলব যারা মেীলিক সিনেমা করেছেন। এখন তাঁদের কাজকেও কি আপনি নকল বলবেন?…সেটি আপনার কাছে প্রশ্ন এবং আফসোসও বটে কারণ আপনার মত অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন স্ক্রিপ্ট রাইটারকে এ প্রশ্নটা করার প্রয়োজনও পড়ে গেল আর সেটাই আফসোসের বিষয়…

১.আজিজুর রহমান যখন ‘ছুটির ঘণ্টা’ নির্মাণ করেন সেটি ছিল সত্য ঘটনার ওপরে নির্মিত একটি কালজয়ী সিনেমা।সত্য ঘটনা মেীলিক হয়।আর তাকে সেলুলয়েডে নিয়ে আসার কাজটা আরো মেীলিকভাবে করতে হয়।নারায়নগঞ্জের “গণবিদ্যা নিকেতন’ স্কুলের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা।ঘটনাটি আমাদেরই দেশের সত্য ঘটনা আর সিনেমাটি আমাদেরই দেশে নির্মিত তাহলে একে কি হিশেবে ‘নকল’ বলার দুঃসাহস দেখাব আমি বা আমরা!!..

২.আলমগীর কবির তাঁর ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমায় যে সময়কে দেখিয়েছেন তার দৃষ্টি তাঁর সময়ের থেকে অন্তত বিশ বছর এগিয়ে ছিল।তাঁর নির্মাণে মেীলিকত্বই প্রধান গুণ ছিল।বুলবুল আহমেদকে দিয়ে তিনি যে অভিনয় করিয়েছেন তাকে কি নকল বলা যাবে!!নাকি সিনেমার গল্পটাকে নকল বলা যাবে!!..ঠিক একইভাবে ‘মহানায়ক’ সিনেমার কথাও যদি বলি সেইসময়ে এত অসামান্য কাজ তিনি করেছেন যার তুলনা নেই।তিনি জানতেন প্লেবয়-কে কীভাবে উপস্থাপন করতে হয় তাই বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট অনুয়ায়ী গল্পকে উপস্থাপন করেছেন।তিনি নকলবাজ পরিচালক এটা বলার দুঃসাহসও কি আমি বা আমরা দেখাতে পারি!!..

৩.আফতাব খান টুলু-র ‘দায়িী কে?’ সিনমোটি না দেখলে জীবনে অনেক বড় একটা শিল্প মিস হবে।এটিএম শামসুজ্জামানের শ্রেষ্ঠ কাজ।একজন যাযাবর লোকের জীবনের করুণ বাস্তবতা সিনেমাটিকে করুণ করেছে।|শেষ দৃশ্যে এসে চোখে পানি আসবে না এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর হবে।রাজনৈতিক মঞ্চে নিজের জন্মদাতা বাবাকে খুন করার পর ফাঁসিতে যাবার আগে ইলিয়াস কাঞ্চন-অণ্জুর ছেলের পা নিজের কপালে ঠুকে যখন বলে-‘জীবনভর লাত্থিগুতা খাইয়া মানুষ হইলাম আজ শ্যাষ লাত্থিটা তুই দে’..এই ধরনের সংলাপ এটিএম যখন ডেলিভারি দেয় চোখের পানি আর বাঁধ মানে না।এই সিনেমাটি জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা। এটা কোনো নকল শিল্প নয়।তবে আপনি কেন ঢালাও বললেন!!…

৪.আমাদের দেশের দর্শক ‘ভাত দে’ সিনেমার সাথে সুপরিচিত।এ সিনেমাটি যার উপন্যাস থেকে বানানো তিনি মাস্টার ডিরেক্টর আমজাদ হোসেন।তাঁর কাছে নকল সিনেমাশিল্প পাব এটা তো অকল্পনীয়।শাবানাকে যদি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজকে নির্বাচন করতে বলা হয় তিনি নিজেও এ সিনেমার কথা বলবেন এটা বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে।দুর্ভিক্ষের জীবন্ত অভিনয় কাকে বলে শাবানা দেখিয়েছেন।এখন কি ‘ভাত দে’কেও নকল বলবেন!!….

৫.তারেক মাসুদকে একটা সিনেমা প্রতিষ্ঠান বললেই তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান দেখানো হয়।তাঁর চিন্তা-চেতনা প্রগতির পথে ছিল।নিজের মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ‘মাটির ময়না’ নামের মাস্টারপিস সিনেমা করে দেখিয়েছেন ধর্মের প্রকৃত চর্চা কীরকম হওয়া উচিত।পৃথিবীতে সেই শিল্পই সবচেয়ে সম্মানজনক যার পেছনে বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে।আপনি কি তবে তারেক মাসুদকেও ‘নকল নির্মাতা’ বলবেন!!…

চাইলে এমন বিশুদ্ধ নির্মাতা ও তাঁদের বিশুদ্ধ সিনেমাশিল্পের কথা আরো বলা যাবে।বলা যাবে নারায়ণ ঘোষ মিতার কথা,সুভাষ দত্তের কথা,কামাল আহমেদের কথা,দিলীপ বিশ্বাসের কথা কিংবা পরবর্তী সময়ের শিবলী সাদিক বা তোজাম্মেল হক বকুল-দের কথাও বলা যাবে।তারা তো বড় নির্মাতা।এতসব আয়োজন হাতের কাছে থাকতেও আপনি সার্বিকভাবে বাংলাদেশের সব সিনেমাকে কীভাবে নকল বললেন তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে বারবার…আমরা যারা এখনকার প্রজন্ম তারা কিন্তু একদম খোঁজখবর রাখি না তা নয় বা এসব ভাবারও কেনো কারণ নেই।আমরাও খোঁজ রাখি,আমরাও সিনেমার ক্ষুধায় বড় হয়েছি..আর সেই ক্ষুধা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি….

আমাদের কাছে মিথ্যাচার করে নিজের বড় ক্যারিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না,প্লিজ…আমরা কিন্তু আসল-নকল চিনি…বাকিটা আর বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না..ভালো থাকবেন


মন্তব্য করুন