Select Page

বসগিরি : না-বস্তাপচা সিনেমা

বসগিরি : না-বস্তাপচা সিনেমা

bossgiri-shakibসিনেমা শুরুর অাগের ঘটনা দিয়ে শুরু করি শেষ করব সিনেমা দেখা শেষের ঘটনা। জাতীয় সঙ্গীত বাজছে। পেছন থেকে বাঁজখাই আওয়াজ এল-‘আরে ভাই বসেন না ক্যান, দেখতে পাই না’। খানিকক্ষণের জন্য মুখদর্শন করলাম ভদ্রলোকের। দেখি অামার মতো দাঁড়ানো অনেকেই তার মুখদর্শন করছে।

সিনেমাহলে সিনেমা দেখাটা ১৯৯৪ থেকে। তখন বিনোদন পেতাম তবে অাজকাল তখনকার মতো করে পাই না। আজকাল অনেকরকম সমালোচক, মিডিয়া, গ্রুপ ইত্যাদি হওয়াতে সিনেমা নিয়ে অালাপ করার ক্ষেত্র বেড়েছে। ক্ষেত্র বাড়ার কারণে যা হয়েছে কথা বলার নানা স্টাইল এসেছে।সেদিক থেকে সিনেমাহলে সিনেমা দেখা দর্শক ভাগ হয়েছে কয়েকরকম।
* একভাগ সিনেমা দেখার জন্য যায় এবং দেখাটাই মূল লক্ষ্য।
* একভাগ চিরাচরিত চিন্তা নিয়ে যায় এবং দেখা শেষে মুখটা বাঁকিয়ে বলে ‘বাংলা সিনেমা দেখলাম’
* একভাগ সিনেমা ও ফানকে একযোগে মেশাতে যায়
* একভাগ শুধু ভুল বা খুঁত ধরতে যায়
* একভাগ ভুল ধরলেও যৌক্তিকভাবে ধরে
* একভাগ সমালোচক হবার নেশায় যায় কারণ সিনেমা শেষে তার লেখার হাত খুলবে সে বিশ্বাস করে।
* একভাগ পরিমিতিবোধে সিনেমা নিয়ে অালাপে বিশ্বাসী

দর্শক বিভাজনের এ ক্ষেত্রগুলোকে সাথে নিয়ে অাজ চলতে হয়। সব মিলিয়ে প্রযুক্তির জনবল নিয়ে অাজকের সিনেমা ও সমালোচনার কারবার।

‘বসগিরি’ নিয়ে কথা বলছি।অনেক মিশ্র কথাবার্তা হয়েছে সিনেমাটি নিয়ে। সিনেমাটি সার্বিক অর্থে মোটামুটি মানের বিনোদনধর্মী সিনেমা যার মধ্যে মান ভালো করার আরো সুযোগ ছিল। সিনেমা নিয়ে ‘বস্তাপচা’ অজুহাতও এসেছে। কিন্তু এটা অতিরিক্ত ছিল। ‘বসগিরি’ কোনোভাবেই ‘বস্তাপচা’ না বরং ঐ অতিরিক্ত কথাকে স্ট্রংলি প্রোটেক্ট করার জন্য একে ‘না-বস্তাপচা’ সিনেমা বলা উচিত।

বাণিজ্যিক বা অফট্র্যাক সিনেমা মোটাদাগেই শেষ পর্যন্ত বিনোদনধর্মী শুধু ধরণটা ভিন্ন।’বিনোদন’ দিতে এগিয়ে থাকে বাণিজ্যিক সিনেমা।সেই বিনোদনের ভালো প্রচেষ্টা ‘বসগিরি’-তে আছে। বিনোদনটি নায়ককেন্দ্রিক সম্পূর্ণরূপে থাকলেও তার মধ্যে অালাদা রসদ ছিল। মেকানিজমের যে জ্ঞান এ সিনেমার পরিচালকের অাগে সিনেমাতে ছিল না সেটার একটা উন্নতি ছিল। বোরিং হবার হাত থেকে অন্তত বাঁচা গেছে। সিনেমার চরিত্রগুলোকে এবং চরিত্রের মুখের কথাগুলোকে সাজানোর দিকটা খুব নজরে ছিল পরিচালকের।ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি! না, বাড়িয়ে বলছি না। নায়ক শাকিব খানের নাম ‘sk=super killer’, অমিত হাসানের নাম ‘dk= dangerous killer, রজতাভ দত্তের নাম ‘ double dk’ পাশাপাশি মাজনুন মিজানের নাম ‘সিস্টেম’, অার একজনের ‘মিটার’ কিংবা ডাক্তারের নাম ‘সিরিয়াস’ এসব প্ল্যান ভালো ছিল।নামগুলো শুনে দর্শক হেসেছে প্রাণখুলে। বিনোদনের কৌশলে এটা ছিল পজেটিভ। বাণিজ্যিক সিনেমা হিশেবে ‘বাদশা’-তে যখন বিনোদনের ভিত্তিকেই প্রধান ধরা হচ্ছে তখন ‘বসগিরি’ বিনোদন দিয়েও কেন ‘বস্তাপচা’ লেবেলটা কাঁধে নেবে!  জানি, কথা উঠবে নির্মাণ সমস্যা নিয়ে। হ্যাঁ, সেটার ঘাটতি অাছে কিন্তু সেটা না থেকেও দর্শক সিনেমাহলে বিনোদন পেল সেটার কি মূল্য নেই কোনো!!

ব্যাপার তা নয়। ‘বসগিরি’ বিনোদনটিকে ব্যালেন্স করতে পেরেছে। ভাবছেন কিভাবে? বলছি তবে।
ডায়লগে স্ট্রং ছিল সিনেমাটা।শাকিব খানের ঢাকাইয়া ডায়লগ খুব হাসিয়েছে দর্শককে।সিচুয়েশন বেইসড ডায়লগ অ্যাকশন ও কমেডি দুই বিভাগেই উপভোগ্য ছিল। উদাহরণ না দিলে খারাপ দেখায়-
* শাকিব খান যখন বুবলির সামনে মাইকওয়ালা গাড়ি নিয়ে হাজির তখন শাকিব মাজনুন মিজানকে বলেছে-‘অাব্বে জানস মাইনশে ক্যান পরকীয়া করে?’স্ট্যামিনা, স্ট্যামিনার কমতি থাকলে এইটা হয়।বুবলি গুণ্ডা লইয়া আইছে অামার স্ট্যামিনা পরীক্ষা করনের লাইগা।’
* অমিত হাসানের সাথে প্রথমবার দেখার সময় যখন শাকিবের সব তথ্য জানতে চায় বলে-‘আব্বে অাগে টেইলার দ্যাখ, পুরা ফিলিম তো দেখবি সিনামাহলে।’
* ‘বসের সাথে পাঙ্গা অার যমের সাথে পাণ্জা সেইম টু সেইম’- এটা শাকিবের থ্রোয়িং-এর গুণে বারবারই শুনতে দারুণ লেগেছে।
ডায়লগগুলো দারুণ উপভোগ্য ছিল বিশেষ করে শাকিবের বলার স্টাইলে।dialogue based entertainment এ সিনেমাটি অন্য সীমাবদ্ধতাগুলো ব্যালেন্স করতে পেরেছে।

সীমাবদ্ধতা বড় বড় বাণিজ্যিক সিনেমাতেও থাকে।পরিচালক মূলত ফেসবুকে গালি, ট্রল, সার্কাজম এর শিকার হয় নির্মাণ সমস্যার কারণে।যার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ থাকে। যেমন-
* ফাইটের সময় কেন দড়িতে ঝোলাটা বোঝা গেল
* কেন শিবা সানু পরচুলা পরেও ক্যামেরায় তার আসল চুল বোঝা গেল
* কেন বু্বলি ইন্টার্নি করতে এসে তার সিনিয়র ডাক্তার সিরিয়াসকে শাকিবের চিকিৎসা করতে বলল
* কেন বস্তা থেকে বেরোনো নায়িকার সাথে নায়কের মিনিট দুয়েকের বেশি চোখাচোখি দেখিয়ে টাইম পাস করানো হলো
* কেন ধানুশ বা সণ্জয় দত্তের সিনেমার আইডিয়া ধার করার এত নেশা!
* কেন নাচের মধ্যে নায়কের ভুড়ি চোখে লাগে
* কেন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ হাওয়া হলো। চিরাচরিত ‘অা অা’ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো কিছু কেন থাকল না।
* কেন রজতাভ দত্তের ভয়েসটা ডাবিং এর প্রয়োজন পড়ল নাা। কেনই বা এত অল্প স্পেসে তার মত শক্তিমান অভিনেতাকে ব্যবহার করা হলো।
এসব সীমাবদ্ধতা ফ্যাক্টর হয়ে যায়। যতদিন এসব সীমাবদ্ধতা কাটাতে না পারবে ততদিন গালি, ট্রল, সার্কাজম বরাদ্দ থাকবেই পরিচালকের জন্য।তবে ‘বসগিরি’-তে ডায়লগ বেইসড অ্যাকশন+কমেডির ব্যালেন্সটা পরিচালক যেন সব সিনেমাতে করতে না যান তাহলে টোটালি মুখ ফেরাবে দর্শক।এক জিনিস বেশিবার ভালো না।

অভিনয় নিয়ে কথাও মিশ্র ছিল। শাকিব খান এখন সেই পর্যায়ে চলে গেছে তাকে ক্যারেক্টার শুধু বুঝিয়ে দিতে হবে বাকিটা সে করে দেখাবে। ‘বসগিরি’-র প্রাণ ছিল শাকিব। হাসিয়েছে প্রচুর। তার এন্ট্রিসিনে হেলিকপ্টার থেকে মুখে বিড়ি অার হাতে চায়ের কাপ দেখে দর্শককে বলতে শোনা গেল ‘অস্থির। ‘কথাটার মূল্য অাছে। এক্সপ্রেশন মাপমতো সব। অভিনয়ে শাকিবের বিকল্প শাকিবই এখন এবং সেটা তার অভিজ্ঞতার ফসল। বুবলিকে নিয়ে নেগেটিভ কথা এসেছে বেশকিছু এমনকি দ্বিতীয় অপু বিশ্বাস বলে কটাক্ষ করা হয়েছে। অপু বিশ্বাসের থেকে এগিয়ে অাছে সে। জড়তা ছিল না।প্রথম কাজ হিশেবে এক্সপ্রেশনে দুর্বলতা ছিল তবে সেটা গুরুতর না। ভালো গাইড পেলে সে এগিয়ে যাবে। মাজনুন মিজান imbalanced ছিল।অভিনয়ে ‘পুরান চাল ভাতে বাড়ে’ নামে প্রবাদটিকে প্রমাণ করেছে সাদেক বাচ্চু। তার ছেলের প্রতি বিশ্বাস ও সেটা মুছে যাবার অভিনয় অনবদ্য। মিজু অাহমেদ একালে এসেও ‘এ কাজ যদি না করি তবে আমার নাম শফিক পাটোয়ারি না’ এ ধরনের ডায়লগ বলাটা হতাশাজনক। অমিত হাসানকে নানাভাবে ছোট করা হচ্ছে ইদানিং। অভিনয় নিয়ে প্রশ্নও তোলা হচ্ছে। মান্না উৎসবে রিয়াজ অমিতকে বলেছিল-‘অমিত ভাই আমার দেখা অন্যতম পাওয়ারফুল অভিনেতা’। রিয়াজের অভিনয়জ্ঞান ভালোই অাছে তাই অমিত যে সময়ের সাথে খাপ খেয়ে ‘ডিকে’ চরিত্রকে দেখিয়েছে সেটা ফেলনা নয়। একদম বিরক্তির অভিনয় ছিল চিকন অালির। তার শোধরানো দরকার।

ওয়াইড স্ক্রিনে ‘বসগিরি’ সিনেমা দেখে দর্শকদের মধ্যে ভালো প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ফুল স্ক্রিনে ডিজিটাল সিনেমা খারাপ দেখায়। যে কারণে নাটক/টেলিফিল্মের বাড়তি অভিযোগ শুনতে হয়। ওয়াইড স্ক্রিন অব্যাহত থাকুক অন্য বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোতেও। লোকেশনের জায়গায় ইনডোর/আউটডোর ব্যালেন্স করা ছিল।খারাপ লাগেনি। গান অন্যতম অাকর্ষণ ছিল। দর্শকের ঠোঁট মেলানো দেখে বোঝা গেছে। বিশেষ করে ‘কোনো মানে নেই তো, সোনা বুবলি, মন তোকে ছাড়া’ গানগুলো দর্শকের অাগ্রহে ছিল।

বিনোদন, বিনোদন, বিনোদন যদি বাণিজ্যিক সিনেমার লক্ষ্য হয়ে থাকে এবং বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা সেটাই প্রমাণ করে তবে ‘বসগিরি’ বেশ সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও ঐ চাহিদা মিটিয়েছে। এর মানদণ্ড সিনেমার ক্যাটাগরিতেই ঠিক করা। ‘বস্তাপচা’-র ফ্যাশনেবল অভিযোগ তাই এ সিনেমার জন্য ধোপে টিকবে না। ‘না-বস্তাপচা’ সিনেমার লক্ষণ জেনে তারপর না হয় ‘বস্তাপচা’ বলা হোক।

বসের ‘বসগিরি’ চলুক..

বি: দ্র:
শেষের ঘটনা বলতে চেয়েছিলাম।ঘটনা সামান্য।সিনেমাহল থেকে বেরোনোর সময় একটা মেয়ে তার পাশের জনকে বলছিল-‘আজকে অনেকদিন পর মন খুলে অনেক হাসলাম রে।’


Leave a reply