বহুমাত্রিক আফসানা মিমি
‘আকাশে ছোঁয়ায় তার
ভালোবাসা এসে লাগে,
দৃষ্টি আড়ালে গেলেও তার
সৌরভ জড়িয়ে থাকে’
- জিঙ্গেল, মেরিল ট্যালকম পাউডার
মিমি ফুল হাতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন থেকে কেউ একজন ছবি তুলছে। মিমি একবার পেছন ফিরে তাকালে ছেলেটি আড়ালে লুকায়। পরে মিমি তাকে অবাক করে সামনে দাঁড়ায়। হাতে তুলে দেয় মেরিল ট্যালকম পাউডার। জিঙ্গেল সিঙ্গার ‘ডিফারেনটাচ’ ব্যান্ডের আলী আহমেদ বাবু।
আমরা যারা নব্বই দশকে বড় হয়েছি তারা এ বিজ্ঞাপন দেখেনি এটা হতেই পারে না। আফসানা মিমি-র গ্ল্যামার, অভিনয় অপূর্ব আবেশে চোখ আটকে দেয় বিজ্ঞাপনটিতে। বিজ্ঞাপনে মিমি-র ক্যাটওয়াকের ভঙ্গি জাস্ট সুপার। মডেলিং তখন একটা স্টাইলিশ বিষয় ছিল মিমি তার অন্যতম আর্টিস্ট।
আফসানা মিমি নামটি বহুমাত্রিক গুণের সমষ্টি। তার ক্যারিয়ারে বৈচিত্র্য অনেক। জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৮। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। বাবা সৈয়দ ফজলুল করিম ও মা শিরিন আফরোজ।
মিমির মডেলিং যাত্রাই তাকে শোবিজে পরিচিত করে তোলে প্রথমত। অসাধারণ সব বিজ্ঞাপনে কাজ করতে থাকে। ‘মেরিল ট্যালকম পাউডার, লাক্স বিউটি সোপ, মেরিল বিউটি সোপ, ফিনলে চা’ এরকম আরো প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছে। ‘লাক্স’-এর আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরণে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিশাবে বাংলাদেশী যে তারকারা প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদের মধ্যে মিমি ছিল অন্যতম। বিজ্ঞাপনের ভাষা দারুণ ছিল। প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল :
- অনিন্দ্যসুন্দর মিমি। এই রূপের গোপন রহস্য কি?
- সবার আগে সুন্দর ত্বক।
উপস্থাপনা করেছে ‘মনের কথা’ নামে একটি অনুষ্ঠানে।
১৯৯০ সালে হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের মধ্য দিয়ে টেলিভিশন নাটকে যাত্রা শুরু মিমির। এরপর অসংখ্য নাটকে কাজ করেছে এবং এখনো চলছে সে ধারাবাহিকতা। গত কোরবানীর ঈদেও তাকে ‘ভালোবেসেছিলে’ নামে একটি নাটকে দেখা গেছে। তার সময়ের প্রথম কাতারের ব্যস্ত সব তারকার সাথে তার অভিনয় দর্শকের মন ছুঁয়ে গিয়েছে একের পর এক। উল্লেখযোগ্য অন্য নাটক – নক্ষত্রের রাত, বন্ধন, সবুজ সাথী, বেদনার রং নীল, শেষ চিঠির পরে, বিবর্ণ ভালোবাসা, ঝিনুক নীরবে সহো, নাটের গুরু, বউ কথা কও, এবং বনলতা সেন, অন্তরায়, অফবিট, অতিক্রম, বোকাট্টা, ভালোবাসার তিন বেলা ইত্যাদি। ‘অন্তরায়’ নাটকে টনি ডায়েসের সাথে ‘ওরে ও জান রে’ শিরোনামে রোমান্টিক গান আছে। নাটকের মধ্যে ‘নক্ষত্রের রাত’ সর্বাধিক জনপ্রিয়। এছাড়া ‘সবুজ সাথী’ নাটকে তার একক চরিত্রের প্রভাব অনেক বেশি থাকায় দর্শকের পছন্দের মধ্যে আছে।
পরিচালক হিশাবে নাটক নির্মাণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য নাটক – কাছের মানুষ, ডলস হাউজ, পৌষ ফাগুনের পালা, গৃহগল্প। এটিএন বাংলায় প্রচার হওয়া ‘ডলস হাউজ’ খুবই জনপ্রিয় ছিল।
কৃষ্ণচূড়া নামে নিজের প্রোডাকশন হাউজ খুলেছে মিমি। নিজের মতো করে কাজ করার জন্য এটা করেছিল।
চলচ্চিত্রে মিমি বৈচিত্র্যময়। বাণিজ্যিক ছবি ‘দিল’-এ নায়ক নাঈমের বোন ছিল। নাঈম ও মিমির লিপে এ ছবিতে একটি জনপ্রিয় মায়ের গান আছে-
‘ওগো মা তুমি শুধু মা
পৃথিবীতে নেই তুলনা,
জনম জনম ধরে মাগো
তোমায় ভালোবেসে যাবো
তোমার ভালোবাসা পাবো।’
একটা সময় পর্দায় নায়িকা শাবনাজের কণ্ঠ প্রদান করত মিমি।
মিমির অফট্র্যাক ছবির সংখ্যা বেশি। ‘নদীর নাম মধুমতি, চিত্রা নদীর পারে, প্রিয়তমেষু, বিহঙ্গ, লিলিপুটরা বড় হবে’ এ ছবিগুলো করেছে। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের মনে রাখার মতো সব ছবি। ‘চিত্রা নদীর পারে’ ছবিতে মিমির অভিনয় দর্শকের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। সহশিল্পী প্রেমিক তৌকীর আহমেদ-কে রাজনৈতিক কারণে হারাবার পর তার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। ‘প্রিয়তমেষু’ ছবিটিতে তার ভূমিকা অসাধারণ। গাজী রাকায়েতের মাধ্যমে সোহানা সাবার উপরে অত্যাচারের শাস্তির জন্য সাহসী নারীর পদক্ষেপ নেয় মিমি। মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’-তে ছিল মিমি। সামনে মুক্তি পাবে গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘পাপপুণ্য’।
‘ব্যতিক্রমী’ নামে একটি নাট্যদলে কাজের সময় অভিনেতা গাজী রাকায়েতের সাথে পরিচয় ঘটে মিমির। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এ দুজনে এলে প্রেম ও বিয়ে হয়। বেশিদিন সংসার টেকেনি। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৯৬ সালে।
চলচ্চিত্র পরিচালনায় এসে মিমি ২০১৩ সালে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল-এর মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‘ক্যাম্প’ থেকে ‘রান’ নামে একটি চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করে। তবে ছবিটি অসমাপ্ত আছে।
আফসানা মিমি-র অনেকগুলো প্রতিভার দিক পাঠক ইতোমধ্যে জেনেই গেছে। একজন বহুমাত্রিক তারকা মিমি। তার সাফল্যকে আদর্শ ধরে নিলে পরবর্তী প্রজন্মের শেখার মতো অনেককিছু থাকবে।