বাঁক বদলের সিনেমা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে সর্বশেষ কোন সিনেমাটা ”ব্রেক থ্রু” দিয়েছিলো সেটা কি গত প্রায় দুই দশক ধরে বেড়ে উঠা চলচ্চিত্রের আজকের প্রযোজক, পরিচালক ,শিল্পী ও দর্শকদের প্রশ্ন করলে বলতে পারবেন? …মাথার সব চুল ছিড়ে ফেললেও বলতে পারবেন না জানি। কারণ ইন্ডাস্ট্রির এসব রীতিনীতি আপনারা এখন পর্যবেক্ষন করেন না বলেই জানি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে একেকটি সিনেমা ”ব্রেক থ্রু” এনে দিয়েছিলো। স্বাধীনতার পুর্বে যখন এই ইন্ডাস্ট্রিতে ধীরে ধীরে উর্দু সিনেমার দিকে ঝুঁকছিলো ঠিক তখনই ১৯৬৫ সালে সালাহউদ্দিন এর ‘রূপবান’ ব্যাক থ্রু দিয়ে পুরো ইন্ডাস্ট্রির চিত্র পাল্টে দিয়েছিলো। ফোক ফ্যান্টাসী বা লোক কাহিনীর উপর নির্মিত ‘রূপবান’ এর অভাবনীয় সাফল্য সেইসময়কার ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজক, পরিচালকদের বাংলা ভাষায় সিনেমা নির্মানে উদ্বুদ্ধ করে ফলে উর্দু সিনেমা নির্মান কমিয়ে বাংলা সিনেমার দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রযোজক পরিচালকরা । ‘রূপবানের’ সাফল্য ফোক ফ্যান্টাসি সিনেমাও নির্মাণ হতে শুরু করে একের পর এক। ইবনে মিজান, অশোক ঘোষ, খান আতাউর রহমান, আজিজুর রহমান, মোস্তাফিজ, এহতেশাম এর মতো প্রায় সকলেই ফোক ফ্যান্টাসি সিনেমা নির্মান করেন ।
স্বাধীনতার পর জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ এর সাফল্য বাংলা সিনেমায় ধীরে ধীরে অ্যাকশনের প্রচলন শুরু হয় যার একটি ”ব্রেক থ্রু” দেন দীলিপ বিশ্বাস ‘সমাধি’ সিনেমা দিয়ে। ‘সমাধি’র বছর খানেক পরেই ‘জিঞ্জির’ দিয়ে দীলিপ বিশ্বাস আরেকটি ধাক্কা দেন। যা লুফে নিয়ে প্রযোজক পরিচালকরা তারকাবহুল সামাজিক অ্যাকশন সিনেমা নির্মানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফোক ফ্যান্টাসির সাথে একই তালে শুরু হতে থাকে সামাজিক অ্যাকশন ধারার তারকাবহুল সিনেমা যার ফলশ্রুতিতে এই ইন্ডাস্ট্রি পায় দেওয়ান নজরুলের ‘ দোস্ত দুশমন’’, ‘’বারুদ’’, ‘’আসামী হাজির’’, ‘’ধর্ম আমার মা’’, ‘’ওস্তাদ সাগরেদ’’ এ জে মিন্টুর ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ প্রতিজ্ঞা’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘প্রতিহিংসা’, এস এম শফির ‘বেদীন’, ইবনে মিজানের ‘বাহাদুর’, ‘নিশান’, অশোক ঘোষের ‘ তুফান’, শফি বিক্রমপুরীর ‘রাজদুলারী’, দীলিপ বিশ্বাসের ‘অংশিদার’ এর মতো অসংখ্য সুপার ডুপার হিট তারকাবহুল সামাজিক অ্যাকশন ও ফোক ফ্যান্টাসি সিনেমা।
এর ফলে সারাদেশে যেমন করে সিনেমা হল নির্মান বাড়তে থাকে ঠিক তেমনি একই ভাবে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পী ও কলাকুলশীও বাড়তে থাকে। কারোরই দম ফেলার সময় নেই। দিনের পর দিন রাতের পর রাত সবাই নতুন নতুন সিনেমা নির্মানে ব্যস্ত আর দর্শকরাও সিনেমা হলে গিয়ে একেকটি সিনেমা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়া শুরু করলো। কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে পেছনে ফেলে বোম্বের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতো থাকলো আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি । ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশের প্রযোজক পরিচালকরা আমাদের প্রযোজক পরিচালকদের নিয়ে দুর্দান্ত সব যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মানও শুরু করলেন। আমাদের রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, ওয়াসিম , শাবানা, ববিতাদের পাশাপাশি এই দেশের দর্শকরা শশী কাপুর, শর্মিলি ঠাকুর, রাজেশ খান্না, মিঠুন চক্রবর্তি, নাদিম, ফয়সাল দের মতো বিদেশি তারকাদের সিনেমাও বাংলা ভাষায় দেখার সুযোগ পায়।
রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, ম্যাগাজিনে সিনেমার বিজ্ঞাপন ও খবর শুনতে, দেখতে ও পড়তে দর্শকদের প্রচন্ড আগ্রহ তখন। ১৯৮৬ তে শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘লড়াকু’ এসে আলোড়ন তৈরি করলো । ভিসিআরে এদেশের দর্শকরা চীন ও হলিউডের মার্শাল আর্ট ভিত্তিক অ্যাকশনের সিনেমা দেখলেও উপমহাদেশের কোন ইন্ডাস্ট্রিতে তখনও মার্শাল আর্ট /কংফু ,ক্যারাটি অ্যাকশন দেখা যায়নি তাই ‘লড়াকু’ ছিলো সেসময় সম্পুর্ন নতুন একটি ধারার সুচনার সিনেমা। ‘লড়াকু’র সাফল্য সব শ্রেণির দর্শকদের মাঝে মার্শালআর্ট ধারার সিনেমার একটা আগ্রহ জন্মে এবং এই আগ্রহ থেকেই তখন সারাদেশে কিশোর,তরুন যুবাদের মাঝে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণের চাহিদা দেখা দেয়। শহিদুল ইসলাম খোকন, ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম , আহমেদ সাত্তার, আবুল খায়ের বুলবুল, মাসুদ পারভেজ এর মতো পরিচালকরা শুরু করেন একে একে মার্শালআর্ট অ্যাকশনধর্মি সিনেমা নির্মানের যার ফলে আমরা পেয়েছিলাম শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বীরপুরুষ’, ‘বজ্রমুষ্ঠি’, ‘বিপ্লব’, মাসুদ পারভেজের ‘মারকশা’, আহমেদ সাত্তারের ‘বজ্রপাত’, ‘বীর বিক্রম’, ‘আবুল খায়ের বুলবুলের ‘ আমিই শাহেনশাহ’, জাহাঙ্গীর আলমের ‘মাস্টার সামুরাই’, ‘ক্যারাটি মাস্টার’, ‘মরণ লড়াই’ এর মতো দুর্দান্ত সব মার্শাল আর্ট ধারার অ্যাকশন সিনেমা যে ধারাটি ৯০ দশকেও ছিলো পুরো বহমান।
এতো সফলতার মাঝেও তোজাম্মেল হক বকুল ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ দিয়ে আরেক আলোড়ন তৈরি করলেন । ফোক সিনেমাকে যে সময় অনেকেই শেষ বলে ধরে নিয়েছিলেন ঠিক সেই সময়েই বকুলের ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ আশার আলো দেখায়। এর কয়েকবছর পরেও ফোক ফ্যান্টাসি নিয়মিত নির্মান হতো । রাজ্জাক,আলমগীর, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল ,জসিমদের সিনেমা দেখতে দেখতে যখন দর্শকরা ক্লান্ত ঠিক তখনই এহতেশাম ‘চাঁদনী’ দিয়ে আরেকটি ব্র্যাকথ্রু দিলেন । কিশোর কিশোরী / টিএনজারদের আকর্ষণ করার মতো একটা জুটি উপহার দিলেন যারা ছিলেন নতুন যুগের নতুন তারকা নাঈম –শাবনাজ। চাঁদনী’র ধারাবাহিকতায় প্রযোজক পরিচালকরা নবীন প্রবীন সব তারকাদের নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন ধারার সিনেমা উপহার দিতে লাগলেন এবং প্রায় সিনেমায় চেষ্টা করতেন নতুন কোন নায়ক নায়িকাকে উপহার দিতে।
প্রযোজক পরিচালকদের আন্তরিক চেষ্টায় শেখ নজরুল ইসলামের ”চাঁদের আলো” তে পেলাম ওমর সানী, সোহানুর রহমান সোহানের ”কেয়ামত থেকে কেয়ামত ” থেকে পেলাম সালমান শাহ ও মৌসুমীকে, এহতেশামের ”চাঁদনী রাতে” সিনেমায় পেলাম শাবনুরকে , মোহাম্মদ হোসেনের ”অবুঝ দুটি মন” সিনেমায় পেলাম আমিন খানকে এভাবেই প্রায় নিয়মিতই সেসময় প্রযোজক পরিচালকরা দর্শকদের জন্য নতুন নতুন তারকা নিয়ে হাজির হতেন। তারপরেও ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা আরও পেয়েছিলাম অমিত হাসান, শাহিন আলম, মেহেদী, সঞ্জয় খান, সোনিয়া, শাহনাজ, অন্তরা সহ আরও অনেক নতুন নতুন নায়ক নায়িকাকে। এতো কিছুর মাঝেও মান্না ”কাশেম মালার প্রেম” সিনেমা দিয় একক নায়ক হিসেবে উঠে এসে নিজের আলাদা একটা ভক্ত শ্রেণী গড়ে তুলেছিলেন। কারণ সবার একটাই ধ্যান জ্ঞান ছিলো যে ব্যবসার সাথে সাথে দর্শকদের মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করতেন। দর্শক কি চায় সেটা বুঝে সিনেমা নির্মান করতেন।
অশ্লীল যুগের সিনেমাগুলোর দাপটের ভিড়েও আমাদের পরিচালকরা চেষ্টা করেছিলেন এর থেকে উত্তরণের জন্য ভালো গল্প ও নির্মানের সিনেমা দিয়ে ব্রেক থ্রু দিতে। শহিদুল ইসলাম খোকনের ”ম্যাডাম ফুলি”, ”পাগলা ঘন্টা”, কাজী হায়াতের ”আম্মাজান” , ”ইতিহাস” সিনেমাগুলো সেই চেষ্টারই অংশ। সেসব সিনেমা দারুণ সফল হলেও একটি সিন্ডিকেটের কারণে তার সুফল ইন্ডাস্ট্রি পায়নি। এরপরেও থেমে থাকেনি আমাদের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালকরা। ডিপজলের ”কোটি টাকার কাবিন” , ”চাচ্চু”, গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ”মনপুরা” আশাতীত ব্যবসা সফল হলেও ততদিনে ইন্ডাস্ট্রি প্রায় গুনি প্রযোজক পরিচালক ও শিল্পীর শূন্যতা সৃষ্টি হিয়েছিল যার অভাবে সেই ব্রেক থ্রু গুলোর সুফলতা পায়নি।
এই শূন্যতার মাঝে শূন্যতা পুরণের চেষ্টা না করে আরেকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবসা করার লড়াইয়ে যার ফলশ্রুতিতে শাকিব খান ছাড়া আর কাউকে বাণিজ্যিক সিনেমার দখল নিতে দেয়া হয়নি কৌশলে আর শাকিব খান নিজেও সেই ফাঁদের পক্ষে থেকে নিজের একক রাজত্ব কায়েম করে গেছেন যা আসলে বাঘহীন বনে বিড়ালের রাজত্ব করে যাওয়ার মতো। কারণ ইন্ডাস্ট্রিতে তখন সিনিয়র নায়ক নায়িকারা অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন যারা আর ফিরে আসার চেষ্টা করেনি বা যাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করা হয়নি। আরেকটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠে তথাকথিত ভালো সিনেমার নামে স্বল্প বাজেটে নির্মিত টেলিভিশনের পর্দায় নতুন নতুন সিনেমা প্রিমিয়ার শো এর নামে ব্যবসা করার। ফলে বাণিজ্যিক সিনেমায় শাকিব সিন্ডিকেট আর কথিত বিকল্পধারা কেন্দ্রিক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সিন্ডিকেট দখলে নেয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি।
যাদের সাথে পরবর্তীতে যোগ দেয় জাজ মাল্টিমিডিয়া। বড় বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাজ আসে কোটি টাকার বিনিয়োগের গল্পের ফাঁদ পেতে ”ডিজিটাল চলচ্চিত্র” এর নামে রঙিন ফানুস উড়াতে। টাকা দিয়ে নিজেদের প্রযোজনা সংস্থার কাছে শিল্পি ও সিনেমা হল মালিকদের জিম্মি করে নতুন আরেকটি সিন্ডিকেট গরে তোলে জাজ। ফলে ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়ানোর নামে একচেটিয়া সিন্ডিকেটের দখলে গিয়ে তামাশায় পরিণত হয় যা থেকে আর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সবাই । এখন ইন্ডাস্ট্রিতে নেই বড় বড় প্রযোজক আর গুনী নির্মাতা যারা আরেকটি সিনেমার মাধ্যমে ব্রেক থ্রু দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে । আর কেউ কোন ব্রেক থ্রু এনে দিলেও সেটা বুঝার মতো মন প্রযোজক, পরিচালক , সিনেমা হল মালিক ও দর্শক কারোরই আজ নেই , এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি কারো কোন দায়বদ্ধতা আজ আর নেই।।