
বাংলাদেশী সিনেমায় ভারত প্রশ্ন
‘বাংলাদেশী সিনেমায় ভারত প্রশ্ন’— মোটের ওপর এটা না হয়ে লেখার শিরোনাম অন্যকিছু হতে পারত। এছাড়া আদতে কোনো প্রশ্ন হাজির নাই এখানে, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রশ্নকে সামনে রেখেছে এ লেখা। বরং কিছু মীমাংসার চিহ্ন আছে; যা গৎবাধা মনে হলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নিশ্চিত আপনি কখনো না কখনো শুনে থাকবেন। হ্যাঁ, কয়েক হাজার বাংলা সিনেমা থেকে পুরো চিত্র হাজির করা মুশকিল…
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক স্রেফ প্রতিবেশী হিসেবে নয়; ঐতিহাসিক ধারাক্রম এবং হ্রস্ব পরিসরের আলোচনায় ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে যে ভূখণ্ডের উদ্ভব তাতে বাস্তবতা ও ভাবকল্পের জটিলতা বরাবরই বিদ্যমান। খেয়াল করলে দেখবেন, সংগত কারণে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবিরোধী ও ভারতবিদ্বেষ শব্দবন্ধ প্রায়শ একাকার হয়ে যায়। ভেদরেখা রাখা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে, এমনকি অস্পষ্ট ‘বিদ্বেষ’ও ন্যায্যতা উৎপাদন করে। মোটাদাগে, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সুনির্দিষ্ট বয়ান দাঁড়িয়ে গেছে। নিজেদের রাজনৈতিক পরিসরে বিজেপি ও কংগ্রেসের বড় ভাগাভাগি থাকলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের ভূমিকা কাছাকাছি রকমের। যেখানে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানের জটিল সংশ্লেষ আছে। বাংলাদেশের তরফে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কিছু অনুমান আছে, যার প্রত্যক্ষ কারণও রয়েছে। যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে অবিশ্বাস এবং ভারতের পক্ষে দাদাগিরি। দুঃখজনকভাবে ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এ মনোভঙ্গি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পাঁচ দশকেও প্রায় একই রয়ে গেছে। ভারতীয় ও বাংলাদেশী একটি শ্রেণীর বয়ানে একই ধরনের অনুমানকে স্বতসিদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ভাগাভাগিজনিত সাংস্কৃতিক হীনমন্যতা ও গোঁড়ামি অচলায়তনে বেধে রেখেছে।
‘বাংলাদেশী সিনেমায় ভারত প্রশ্ন’— মোটের ওপর এটা না হয়ে লেখার শিরোনাম অন্যকিছু হতে পারত। এছাড়া আদতে কোনো প্রশ্ন হাজির নাই এখানে, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রশ্নকে সামনে রেখেছে এ লেখা। বরং কিছু মীমাংসার চিহ্ন আছে; যা গৎবাধা মনে হলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নিশ্চিত আপনি কখনো না কখনো শুনে থাকবেন। হ্যাঁ, কয়েক হাজার বাংলা সিনেমা থেকে পুরো চিত্র হাজির করা মুশকিল। কারণ যতটা খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সমীক্ষা নাই। বাছ-বিচার নেই। এখানে বা এ লেখায় অল্প কিছু নমুনা টেনে ধরে ‘ভারত প্রশ্ন’ বিষয়টা আপনাদের সামনে তোলা হলো।
বাংলা ও সংস্কৃতিগতভাবে ভারতের কিছু অংশের সঙ্গে দীর্ঘ ঐতিহ্য ভাগাভাগি করলেও সাধারণত ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ শব্দের পেছনে ‘প্রায়ই’ একমাত্র উপলক্ষ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে রাজনৈতিক কর্তাসত্তা আকারে বাংলাদেশের ভূমিকা অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ উপমহাদেশে স্বাধীনতার ব্যতিক্রম এক নজির এবং যেকোনো নিপীড়িত গোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, সেখানে ভারতের তরফে কিছু ভয়ও থাকতে পারে। যদিও মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে সাহায্যের বিষয়ে ভারতের নিজস্ব ব্যাখা এবং এ যুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা বরাবরই বাংলাদেশের জনগণের বড় একটি অংশে প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। তো, বন্ধু হিসেবে যে ‘অনড়’ একটা অবস্থানে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও দেখা হয়, পর্দার বাইরের জগতের মতো চলচ্চিত্রে তার আখ্যান বেশ পুরনো। স্বাধীনতার অল্প সময় পর নির্মিত একটি সিনেমা যার ক্লাসিক উদাহরণ। পদ্মা-মেঘনায় বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি প্রবাহিত হলেও হুবহু এ কথাগুলো স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও শুনে থাকবেন। সেটা হলো আলমগীর কবির নির্মিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩)। প্রচার আছে যে সিনেমাটির প্রাথমিক পরিকল্পনা জহির রায়হানের, নির্মিত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায়।

‘ধীরে বহে মেঘনা’র গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশী এক মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ও বাংলাদেশে শহীদ এক ভারতীয় জওয়ানের প্রেমিকা। সাংবাদিক কামরান চরিত্রে অভিনয় করেন আজমল হুদা মিন্টু এবং ভারতীয় তরুণীর চরিত্রে ববিতা। ছবিতে কামরানের সঙ্গে আরেক সহকর্মীর আলোচনা এমন—
সহকর্মী: ভারতকে ভালো না বাসলে কি দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না?
কামরান: দেখুন, দেশপ্রেম শব্দটা বড্ড গোলমেলে। এরই নামে টিক্কা খান ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে। এরই নামে দালালরা বিহারিদের উসকিয়েছে বাঙালিদের হত্যা করতে। আবার এরই জন্য হাজার হাজার বীর বাঙালি অস্ত্র তুলে নিয়েছে এবং জীবন দিয়ে দেশকে মুক্ত করেছে। ভারত-বাংলাদেশের ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত সরল। যেভাবে পৃথিবীর কয়েকটি বৃহৎ শক্তি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছিল, তাতে ভারত সাহায্য না করলে হয়তো দেশকে স্বাধীন করা অসম্ভব ছিল। এটা স্বীকার করতে লজ্জার কিছু নেই, বরং আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দেয়।
সহকর্মী: কিন্তু এর মানে কি এই নয় যে বাংলাদেশকে চিরকাল দুর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়ে থাকতে হবে?
কামরান: হবে, যদি বাঙালি তার স্বকীয়তা রাখতে না জানে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস কেবলমাত্র দু-এক বছর, দু-এক দশকের ইতিহাস নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষ অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ সত্যিকারের জয়ের পথে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এর পরের ধাপ একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। এর মধ্য দিয়ে বাঙালিকে শক্তি এবং প্রেরণা জোগাতে হবে পৃথিবীর লক্ষ-কোটি নিপীড়তের মানুষের মুক্তি সংগ্রামে। যে সংগ্রাম মূলত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সত্যিকারের শক্তি। এত ভাববার কিছু নেই, ভারতের সঙ্গে যারা হাজার বছরের যুদ্ধ করতে চায় তারা করুক আমাদের দরকার নেই।

‘ওরা ৭ জন চলচ্চিত্রের দৃশ্য
এ আলাপচারিতা স্রেফ ভারত-বাংলাদেশ নয়, বা যেখানে প্রতিবেশী দেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় জওয়ানের আত্মত্যাগের গল্প তুলে ধরা হয। শুধু সম্পর্কই নয়; বরং তৎকালীন রাজনৈতিক বিশ্বকে তুলে ধরে। একইসঙ্গে কামরান কী ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভোক্তা সে কথা বলছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। বামপন্থা ও ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ভারতের এ সম্পর্ক ঠিকঠাক আসলে কী বোঝায়। যাই হোক, তো সারা দুনিয়ার রাজনীতি-অর্থনীতি গত কয়েক দশকে নতুন নতুন অভিমুখে বাঁক বদল করলেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে একমুখীভাবে দেখার প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। এ আলোচনাটা শেষ করার আগে মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি সিনেমার উদাহরণ টানব। খিজির হায়াত খানের ‘ওরা ৭ জন’ (২০২৩)। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনা করছে এমন এক ভারতীয় তরুণীকে হানাদারদের হাত থেকে উদ্ধারের গল্প এটি। এ গল্পের বাস্তবতা যা-ই হোক, ভারত প্রসঙ্গ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায়, যদিও সিনেমার গল্পে সে বিষয়ে আলোচনা নাই। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে একটা বোঝাপড়া আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তরফে স্বতন্ত্র কী বয়ান আছে তা স্পষ্ট নয়। আবার ফাখরুল আরেফীন খান পরিচালিত ‘ভূবন মাঝি’ (২০১৭) সিনেমায় বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের কলকাতায় যেতে দেখা যায়। ওই সময় একটা গান থাকে আবহে, যার কয়েকটি পঙক্তি— ‘পড়শি আমার পশ্চিম জুড়ে, পড়শি আমার পুবে, নাও যদি ছোঁয় জল দেখো ঠিক পড়শিও এসে ছুঁবে। যত দূর যায় চোখ যত দূর পালে লাগে সুবাতাস। যা কিছুই দেখি সবই তো পড়শির ইতিহাস’। এ গানে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা আসে। সম্পর্কের বিচারমূলক অর্থ নয়, কৃতজ্ঞতার মাঝে নিজের আলাদা পরিচয়টা হারিয়ে যায়। মানে ভারতের সংস্কৃতির ভেতর প্রতিবেশীসুলভ ভাব, বাংলা তাতে হারায় স্রেফ!এছাড়া ভারতে আশ্রয় নেয়া পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের কেন্দ্র করে এক ফরাসি নাগরিকের গল্পে ফাখরুল নির্মাণ করেছেন ‘জে কে ১৯৭১’ (২০২৩)। ফরাসি বিমানবন্দরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এ সিনেমায় ইন্দিরা গান্ধীকে চরিত্র আকারে এক ঝলক দেখিয়েছেন এ নির্মাতা। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প সে অর্থে না এলেও অন্য একটি গল্প বলার চেষ্টা রয়েছে, যা কিনা ভারতনির্ভর।

‘জে কে ৭১’ সিনেমার দৃশ্য
যাই হোক, ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ধরে আমরা আরেকটু পেছনে ফিরে যায়। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তান তথা ঢাকার সিনেমায় প্রায় অনুপস্থিতই ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার ভাগ। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে এ নিয়ে বিশেষ করে বিকল্পধারা হিসেবে পরিচিত এলিট নির্মাণে কিছু সিনেমা পাওয়া গেলেও মুহাজির হয়ে ওপার থেকে আসা মুসলমানদের গল্প প্রায় না করে দেয়া হয়েছে। এখানে গৌতম ঘোষ পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার ‘শঙ্খচিল’ (২০১৬) নিয়ে আমরা কিছুটা বলব, যেখানে ১৯৪৭ প্রসঙ্গ আছে; কিন্তু মুসলমানদের দীর্ঘ রাজনৈতিক ভাষ্যকে প্রায় না-ই করে দেয়া হয়েছে। যা মূলত ভারতীয় বয়ানই, যাতে ভারতের সাম্প্রতিক দায় মোচনের আড়াল আছে। এছাড়া হিন্দুদের ভারতের যাওয়ার প্রেক্ষাপটে নির্মিত আকরাম খানের ‘খাঁচা’ (২০২১) সিনেমার সাবপ্লটে মুসলমানদের পূর্ববঙ্গে এসে আশাহত হওয়ার গল্প পাওয়া যায়। ‘খাঁচা’ সিনেমাটি হাসান আজিজুল হকের গল্প অবলম্বনে নির্মিত, যিনি কিনা এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কিন্তু তার গল্প এপার থেকে ওপারে যাওয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এমনিতেই দেখবেন বাংলাদেশের বড় বড় অনেক কবি-সাহিত্যিক, কলাকার পশ্চিম বাংলা থেকে আসা। তো পশ্চিমবঙ্গ যেমন পূর্ববঙ্গেও তেমন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রিফিউজিরা হয়েছেন সিনেমা, গল্পের বিষয়। হতে পারবে না, এমন না। বরং হওয়া দরকার। কিন্তু ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া তথা বাংলা ভাগের যে দায় আলাদা করে মুসলমানদের নিতে হয়; সেটাই সিনেমা-গল্পে দেখা যায়। অথচ রাজনৈতিক ইতিহাস পড়লে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ভাগের পেছনে পূর্ববঙ্গে জমিদারী কেন্দ্রিক বৈষম্য ও কলকাতার হিন্দু এলিটদের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্টের শাসন মেনে নেয়ার প্রতি অনিহায় ছিল প্রধান ঘটনা।
প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এবং ঐতিহাসিক সম্পর্কের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নানা বিষয়ে অংশীদারত্ব রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যেকোনো দেশের মধ্যে প্রতিবেশীদের চলাচল বা ভ্রমণ একটি সাধারণ ঘটনা। এতে যেমন পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেন থাকে, তেমনি অপরাধমূলক কার্যক্রমে থাকে না এমন নয়। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ বরাবরই এ বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সব সময় বাংলাদেশে থাকা অবৈধ ভারতীয়দের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে এবং এর বিপরীতে ভারতে অবৈধভাবে বাংলাদেশীরা প্রবেশ করছে এ প্রচারই বেশি। বিষয়টি বাংলাদেশের সিনেমায় বেশ দেখা যায়; এখানে কয়েকটির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো মূলত যৌথ প্রযোজনায় নিয়মিত। এটা কিছুটা অদ্ভুত মনে হলেও যৌথ প্রযোজনার (কখনো একক প্রযোজনা) সিনেমায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোই প্রামাণ্য করার চেষ্টা হয়েছে।
‘শঙ্খচিল’-এর নাম আমরা আগেই নিয়েছি। এ সিনেমার গল্প বেশ মানবিক। যেখানে অসুস্থ শিশুকন্যাকে নিয়ে ভারত সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরার এক স্কুলমাস্টার ও তার স্ত্রীর সংগ্রাম তুলে ধরা হয়। ঢাকার দূরত্ব বেশি হওয়ায় তারা এক পর্যায়ে অবৈধভাবে ভারতীয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলকাতার হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। একে শুধু অবৈধভাবে বাংলাদেশীদের সীমান্ত পাড়ি দেয়ার ঘটনা হিসেবে দেখার জো নেই। এ গল্পের আবহে রয়েছে অন্য কাহিনী, মনে হতে পারে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া বিভাগজনিত জমিদারি হারানোর ট্রমা ভর করেছে। ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার এসব কিচ্ছা সেই অর্থে ওই স্কুলমাস্টার মুনতাসীর চৌধুরী বাদলের স্মৃতিতে থাকার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিসর চিন্তা করলে এটা সচেতনভাবে থাকার কথা। কী বিচিত্র এক বিষয়। একইসঙ্গে বিপজ্জনকভাবে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি করে হত্যাকে যুক্তিসংগত বলেই তুলে ধরা হয়। যখন কিনা ভারতের দেয়া কাঁটাতারে বিএসএফের গুলি খেয়ে বাংলাদেশের ফেলানির ঝুলে থাকার স্মৃতি দগদগেভাবে জাগ্রত। যেখনে অনেক কিছুই আড়াল করে বিএসএফ জওয়ানের সঙ্গে বাদলের মেয়ে রূপসার বন্ধুত্ব দেখানো হয়। শুধু তাই নয়, ফেলানির শহীদ হওয়ার কারণও ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার বিভাগ, যার দায় একতরফা মুসলমানের। এমনই এক বক্তব্যের সিনেমা ‘শঙ্খচিল’, যা কিনা আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা বিভাগে ভারতে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল।

‘শঙ্খচিল’ সিনেমার দৃশ্য
ঢাকার সাংস্কৃতিক বলয়ের দিকে তাকানো যাক। কারা ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নিয়ে হায় হায় করেন। বর্তমানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী! এমনকি সংস্কৃতিকে তারা ঠিকঠাকমতো সংজ্ঞায়িত করতে পারেন না কলকাতা ছাড়া। এ দীর্ঘশ্বাসের পুনরুত্থান হলো ‘শঙ্খচিল’। যার লেখক ও নির্মাতা কলকাতার। এ সিনেমা ফেলানীর কথা বলে না। যৌথ প্রযোজনায় তাকে মাটিচাপা দেওয়া গেলেও রূপসাকে সম্ভব নয়। এ সিনেমা বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতাকে দেখায়। তাই দাঙ্গা মানে নিষ্ঠুর মুসলমান; এমনকি কলকাতায় যে লোক ‘বাংলাদেশী চোর’ বলে বাদলকে গালি দিচ্ছেন, তিনিও মুসলমান।
ভারতের বাংলাদেশীদের প্রবেশ বিষয়ে এখনকার আলাপ দিয়ে লেখাটা শেষ করব। তার আগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভাগে মুসলমানের হীনমন্য হওয়ার গল্প নিয়ে আরেকটু বলতে চাই। বাংলাদেশে তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’ (১৯৯৮) ও আরো কিছু সিনেমায় এ ভাগাভাগি গল্প উঠেছে। সেখানে হিন্দুদের চলে যাওয়াকে একপক্ষীয়ভাবেই দেখা হয়েছে। কারণ খাঁচা বা শঙ্খচিলের মতো সিনেমায় মুসলমানদের চলে আসার গল্প উঠে আসলেও সেই অর্থে রাজনৈতিকভাবে নতুন রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার রূপান্তর মুসলমানের কাছে কী ধরনের সম্ভাবনা আকারে ছিল তা উঠে আসেনি। বা পেছনে ফেলা আসা স্মৃতিগুলো তাকে নতুন অভিমুখে বদলে দেয়, তেমন বাসনা নেই। এছাড়া আশুতোষ সুজনের ‘দেশান্তর’ (২০২২) সিনেমায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভাগাভাগি নিয়ে একটি আখ্যান উঠে এসেছে।

যাই হোক; এ ধরনের কোনো বিষয় উঠে আসবে, তেমন কোনো বাসনা ছাড়াই একটা সিনেমা দেখছিলাম। যা অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জহির রায়হানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ঢাকার মানুষদের পশ্চিম পাকিস্তানে নির্মিত রঙিন উর্দু সিনেমা ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ (১৯৭১), পরিচালক নুরুল হক বাচ্চু। এ সিনেমায় ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ভাগ অল্প পরিসরে ছিল। যেখানে এলিট পরিবারের এক নারী দাঙ্গার ভয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরে দাঙ্গার কারণেই স্বামী-সন্তান থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। যদিও পাকিস্তানে তিনি ফিরতে পারেন। বিষয়টা ব্যতিক্রম লেগেছে এ কারণে, একাত্তরপূর্ব ঢাকার সিনেমায় আমরা ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার বিভাজন দেখি নাই। সিনেমাটির সঙ্গে ঢাকার যারা যুক্ত, তারা খুবই রাজনীতিসচেতন মানুষ। তাদের হতে পাকিস্তানের শোষণবিরোধী সিনেমা হতেও আমরা দেখি, কিন্তু ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ভাগের প্রেক্ষাপটে একটা গল্প বলতে উর্দু ভাষার প্রয়োজন হলো! অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতি জায়গা থেকে এটি ব্রাত্য হইলেও রাষ্ট্র আকারে পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে এ গল্পের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। যেটা কিনা ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্কের মধ্যেও স্পষ্ট বহমান।
ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া প্রশ্নে এখন পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রীয় মীমাংসা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। এ মীমাংসায় প্রায়শ চাপা পড়ে থাকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, যেমন বিহারী। বাংলা সিনেমায় গৌন চরিত্রে তাদের দেখা গেছে বরাবরই। তাদের ইতিহাসকে কখনো যেভাবে তুলে ধরা হয় না; যেভাবে তারা সব হারিয়ে ভারত থেকে এসেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তারা অবশ্য খাতা-কলমে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন; যদিও তাদের বেশির ভাগের সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো যোগ নেই। এই বিহারী চরিত্র বেশ শক্তিশালীভাবে উঠে এসেছে কাজী হায়াতের ‘ধর’ (১৯৯৯) সিনেমায়। এ গোষ্ঠী থেকে আসা এক নাচনেওয়ালী চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা, যিনি কিনা ডিপজলের রক্ষিতা। মানুষ হিসেবে বাংলাদেশে তার অধিকার চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত এ সিনেমার মূল সুর। এ আলাপ ভারত-বাংলাদেশ প্রশ্ন হয়তো পুরোপুরি জায়গা পায় না, কিন্তু নোকতা হিসেবে এ আলাপ গুরুত্বপূর্ণ। ববিতা প্রশ্ন করেন, ভারতে যে মুসলমান বাংলাদেশে সে এসে কী করে বিহারী হয়ে গেল!
বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্ট স্বার্থে দেখার কারণে ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কিছু বিষয় সব সময়ই গুরুত্ব পেয়েছে। তার একটি ট্রানজিট প্রসঙ্গ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়ন কেন দেশটির প্রয়োজন পড়ে! বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ভৌগলিক ও ভুরাজনৈতিক স্বার্থের ইন্টারেস্টিং একটা উদাহরণ আছে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নজাল’ (২০১৮) সিনেমায়। এটি হয়তো সচেতন প্রয়াস নয়, কিছুটা কৌতুককর অর্থে তুলে ধরেছেন সেলিম। কিন্তু সেটা এ অঞ্চলের পলিটিক্যাল ইকোনমির দারুণ একটা দিক তুলে ধরে। সেখানে দেখা যায়, বাবা গুম হওয়ার পর মায়ের সঙ্গে কলকাতায় মামার বাড়ি চলে যায় হিন্দু নায়িকা। এরপর কলকাতায় যেতে দালাল ধরে মুসলমান নায়ক। তো, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ঢোকার পর নায়ক একজনকে জিগাসা করে, সে কলকাতা যাবে, গাড়ি কোথা থেকে ছাড়ে। ওই লোক বলে, এটা ত্রিপুরা। এখান থেকে কলকাতা যাওয়া ট্রেনে দেড়দিনের পথ। তখন নায়ক বাড়ি মানে চাঁদপুর ফিরে আসে। এরপর দালাল ছাড়াই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কলকাতা গিয়া হাজির। এখন এই যে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, সঙ্গে প্রায় অপ্রয়োজনীয় রেলসেতু। এ ধরনের সহজ উপায় থাকতে ত্রিপুরার একজন মানুষকে দেড় দিন গাড়িতে কাটিয়ে কলকাতা যাওয়া; এটা ভাবা যায়, মানা যায়! মানে ভারতের স্বার্থ দেখভাল করে এমন কেউ যদি ক্ষমতায় থাকে এবং সাংস্কৃতিকভাবে যদি তার জন্য সম্মতি উৎপাদন করা যায়! আর জনপ্রিয় প্রচারের দিক থেকে কীভাবে অবৈধভাবে বাংলাদেশীরা ভারতে প্রবেশ করছে তার একটি নমুনা এ সিনেমা। এ ধরনের কয়েকটি নমুনা নিচে দেখানো হলো। এর আগে আরেকটা বিষয় বলি, গল্প বলার দিক থেকে ‘স্বপ্নজাল’ সিনেমায় কিছু সুক্ষ্ণ দিক রয়েছে। সেটা শুধু হিন্দু-মুসলমানের আলাদার কালচার অর্থে নয়; প্রতিবেশী হিসেবে সহমর্মিতার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের ক্ষমতা প্রশ্নে কীভাবে দেখা হয় তা উঠে এসেছে। পাশাপাশি একই ভাষা ও সাংস্কৃতিক অনেক অনুষঙ্গ ভাগাভাগি করলেও ঢাকা-কলকাতার কিছু পার্থক্য গিয়াসউদ্দিন সেলিম ‘স্বপ্নজাল’-এ দারুণভাবে তুলে ধরেছেন।

‘স্বপ্নজাল’ সিনেমার দৃশ্য
এবার পুরোনো প্রসঙ্গ। অবৈধ সীমান্ত পারাপারের গল্প দেখা যায় আরেক যৌথ প্রযোজনার সিনেমায়, শাকিব খান অভিনীত ‘শিকারি’ (২০১৬)। বাংলাদেশী বিরোধী প্রচারে জঙ্গী-সন্ত্রাসের যে যত্রতত্র ব্যবহার দেখা যায়, তুমুল হিট এ সিনেমায় তার একটা নমুনা। সেখানে দেখা যায়, শাকিব মূলত পশ্চিমবঙ্গের এক বিচারপতির ছেলে। ছোটবেলায় বাবার বকুনি খেয়ে বাড়ি পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। পরে বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত ভাড়াটে খুনি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। এমন আরো দুটি সিনেমার কথা বলা যাক। উত্তম আকাশের ‘ঢাকা টু বোম্বে’র (২০১৩) নাম থেকেই এ সিনেমার গল্প সম্বন্ধে আবাস পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ঢাকা থেকে কোনোভাবে হারিয়ে যাওয়া শিশু বোম্বে গিয়ে বড় হচ্ছে আবার সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে আসছে। ‘ঢাকা টু বোম্বে’ একক প্রযোজনা হলেও অনন্য মামুন পরিচালিত ও একই অভিনেতার আরেক সিনেমা ‘দরদ’ (২০২৪) যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত, সেখানেও দেখা যাচ্ছে মূল চরিত্র বাংলাদেশী হয়েও ভারতের বেনারসে বড় হয়েছে। এ ধরনের গল্পের বিপরীত (শিকারি বাদে) সিনেমায় এমন কোনো বয়ান আপনি দেখবেন না যে কেউ ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে থাকছে কেউ। তাও কিনা ‘শিকারি’র নায়ক ভাড়াটে খুনি হিসেবে দেশে ফিরছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হিসেবে এ অনন্ত যুদ্ধের কালে জঙ্গীবাদের ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত নয়। কেন না, বাংলাদেশে সফট-মডারেট থেকে বিভিন্ন ঘরানার ধর্মীয় দল বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ‘মাই নেম ইজ খান’ হওয়াই তো ভয়ানক বিষয়। জঙ্গীবাদের সেই হাওয়া আমরা সিনেমার পর্দায়ও দেখি। যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বলে সীমিত থাকে না, সেখানে ভারতও জড়িয়ে পড়ে। না এমন নয় যে ভারত থেকে অস্ত্র সরবরাহ দেখানো হচ্ছে। যেমন হলি আর্টিজানের মতো এলিট ক্যাফেতে হামলা শুধু বাংলাদেশ নয় আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন তুলেছিল। ওই ঘটনায় নিহতদের বড় অংশ বিদেশী নাগরিক, যাদের অধিকাংশ বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপানের নাগরিক। ছিলেন ইতালির বেশ কয়েকজন নাগরিক। তরিশি জৈন নামের এক ভারতীয় নাগরিকও নিহত হন। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাপান বা ইতালি নয় ‘ফারাজ’ নামের সিনেমা নির্মিত হয়েছে বলিউডে। কৌশলগত স্বার্থ একেই বলে। তবে আমাদের আলোচনা ‘শনিবার বিকেল’ বা ‘স্যাটারডে আফটারনুন’ (২০২৩) প্রসঙ্গে, যেটি পরিচালনা করেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুবই পরিচিত নাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সম্ভবত ‘দেশীয় ভাবমূর্তি’র দোহাই দিয়ে সিনেমাটি সেন্সর বোর্ড আটকে রেখেছে কয়েক বছর ধরে। আপিল ও পরবর্তী সংশোধন এনেও তার সুরাহা হয়নি। অবশেষে বিদেশের পর্দায় ও ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম সনি লিভে মুক্তি পায় যৌথ প্রযোজনার ‘শনিবার বিকেল’। এ সিনেমায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশের জন্য স্পর্শকাতর জঙ্গিবাদের মতো সিরিয়াস বিষয় তুলে ধরেছেন ফারুকী। দরকারি বটে। কিন্তু সেখানে হৃদয়বিদারক ও রাজনৈতিক বিষয়টি ভারত প্রশ্ন দিয়ে শেষ হয়। দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিদের সকল প্রচেষ্টা দিয়ে থামছে হত্যার জন্য একজন ভারতীয়কে খোঁজাখুঁজিতে। আয়রনি হলো সেই ভারতীয় আবার শিয়া মুসলিম। শিয়া-সুন্নী বিষয়টি বৈশ্বিকভাব স্পর্শকাতর বটে, কিন্তু তা কখনো বাংলাদেশে এতটা ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনায় পৌঁছেনি। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে ‘শনিবার বিকেল’-এ চিত্রায়িত হলেও খোদ হলি আর্টিজানের সঙ্গে ভারত প্রশ্ন নতুন একটি সমীকরণ দাঁড় করায়।

‘খাঁচা’ সিনেমার দৃশ্য
ভারতের ভূরাজনৈতিক আগ্রাসনের গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হলো নদীতে বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ। এ জায়গায় সবচেয়ে বড় প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ফারাক্কা বাঁধ। বাংলাদেশে বিস্তৃত মরুকরণের সাক্ষি হয়ে আছে এ বাঁধ। যে বাঁধের বিরুদ্ধে একসময় দাঁড়িয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি। ভারতীয় নদী আগ্রাসনের বলী হয়েছেন বাংলাদেশের শহীদ আবরার ফাহাদ। যাকে কিনা ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করে বুয়েটে। এ মরুকরণ বাংলাদেশে অল্পসংখ্যক সিনেমায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র খন্দকার সুমনের ‘সাঁতাও’ (২০২৩)। যেখানে তিনি সরাসরি কোনো দেশ বা ফারাক্কা বাঁধের উল্লেখ না করেই তিস্তা বাঁধের মাধ্যমে অন্যায্য জলবন্টনের চিত্র দেখিয়েছেন।
উদাহরণে ভারাক্রান্ত লেখাটি আর দীর্ঘ করব না। আপনি যদি ভারতীয় সিনেমার বয়ানে বাংলাদেশ দেখেন আপত্তির তালিকায় প্রথমে থাকবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ হিসেবে চিত্রায়ন। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারের অন্যতম উদাহরণ হলো বিশাল ভরদ্বাজের সাম্প্রতিক সিনেমা ‘খুফিয়া’ (২০২৩)। যা কিনা বাংলাদেশের বিতর্কিত একটি নির্বাচনের আগের নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়। সে সিনেমায় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে খোলাখুলি আলাপ রয়েছে, যা আমরা বাংলাদেশের সিনেমায় দেখি না। বলিউড ও ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক সিনেমায় প্রতিবেশীদের সন্ত্রাসী হিসেবে রূপায়নের একটি ধারা শক্তিশালীভাবেই রয়েছে। সেখানে হিন্দু ও ভারত যেমন একাকার, প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় পরিচয়গুলোও রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া হয়। বাংলাদেশী সিনেমায় এমনটা থাকবে, আশা করাও বোকামী। কিন্তু সফট অর্থে এবং বাস্তব কারণ থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব না। একটা উদাহরণ হয়তো জুতসই হতে পারে। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ যখন লেখা হচ্ছিল তখন ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের শত্রুতা তুঙ্গে। একাত্তরপূর্ব গল্পে ওই সিরিজের প্রধান অবলম্বন ছিল ভারতীয় ষড়যন্ত্র। কিন্তু যখন সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংসপাহাড়’ অবলম্বনে সিনেমা ‘এমআর নাইন: ডু অর ডাই’ (২০২৩) নির্মিত হয় সেখানে খোলনলচে গল্প পাল্টে যায়। অবশ্য এতটা পাল্টে গেলে বাংলাদেশে সেন্সর পেতো কিনা সন্দেহ আছে। কারণ বাংলাদেশি সিনেমা বরাবরই ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ বা ‘বন্ধু রাষ্ট্রের’ স্বার্থকে দেখভাল করার কথা বলে। সিনেমা যে কৌশলগত হাতিয়ার হতে পারে, তা এখানকার নিয়ম-কানুনে অনুপস্থিত। এমনকি শিল্পের স্বাধীনতা প্রশ্নেও। বর্তমানে সার্টিফিকেশন আইন নতুন করে তৈরি হচ্ছে। তাই সে বিষয়টি বিস্তারিত বলে রাখা থেকে উহ্যই রাখি।

‘শনিবার বিকেল’ সিনেমার দৃশ্য
এ আলোচনায় সাধারণভাবে কিছু বিষয় নিশ্চয় চোখে পড়ে। এবং আবার স্মরণ করিয়ে দিই আলোচনাটি মূলত উদাহরণ নির্ভর। বিশেষ করে যৌথ প্রযোজনার ধারণাটি বাংলাদেশে এক ধরনের অবিকশিত পর্যায়ে রয়েছে। যা কিনা বাণিজ্যিক সিনেমার ক্ষেত্রে বড় বেশি সৃজনী ক্ষমতাহীন। মূলত ভারত বড় দেশ ও তার কালচারাল আধিপত্যে আমরা আক্রান্ত। সাধারণ গড়পরতা একক প্রযোজনার সিনেমায় ভারত প্রসঙ্গ খুব একটা আসে না। কিন্তু যৌথ সিনেমার ক্ষেত্রে এক ধরনের গল্পজনিত সাম্যতার দোহাইয়ে সম্ভবত দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের বিষয়টি চলে আসে। এছাড়া বিকল্পধারার কৃতজ্ঞতানির্ভর সিনেমার কথা না-ই বলি। এ আলোচনায় দেয়া উদাহরণ যে বয়ান নির্মাণ করে; তাতে খুব একটা ভিন্নমত নেই। সেখানে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী সম্পর্কে ভারতীয় বয়ানই উঠে আসে। যেখানে সীমান্ত হত্যা, চোরাচালান বা বাংলাদেশের ভারতীয় অবৈধ বসবাসের চিহ্নগুলো অনুপস্থিত। বাংলাদেশের রাজনীতি, পরিবেশ-প্রতিবেশে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপও আমাদের গল্প-সিনেমায় অনুপস্থিত। এমন নয় যে আমাদের নির্মাতারা এসব বিষয়ে অনবহিত। বরং বাংলাদেশের বিদ্যমান সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া, ক্ষমতা সম্পর্ক বা এর চর্চার ভেতর এ ধরনের নির্মাণ, যা কিনা আত্মমর্যাদার প্রশ্নও তা বরাবরই অধরা থেকে গেছে।
- লেখাটি ‘সাম্প্রতিক দেশকাল’ ঈদ সংখ্যা ২০২৫-এ প্রথম প্রকাশিত। তবে লেখাটিতে সম্পাদনা চলমান।