বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় ‘চার সতীনের ঘর’
দুই হাজারের পর থেকে বাংলাদেশে অশ্লীলতার প্রতিযোগিতা চলছিল। তবে এইসব হঠাৎ করে হয়নি। আমার মনে পড়ে. ‘জন্মদাতা’ ছবিতে প্রথম কাটপিস দেখি। খুব অবাক হয়েছিলাম। স্বনামধন্য একজন গীতিকার পরিচালিত ছবিতে এ কি দেখলাম! পরে সিনে-ম্যাগাজিনের মাধ্যমে জানতে পারি, পরিচালকের অজান্তে এই কাটপিস জুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে অশ্লীলতা শুরু হয়।
২০০০ সাল পরবর্তীতে অশ্লীলতার মহামারি শুরু হয়। অনেক বড় বড় তারকা, জনপ্রিয় তারকারা এইসব অশ্লীল ছবিতে অভিনয় শুরু করে। অশ্লীলতার কারণে সিনেমা দেখা প্রায় বাদই দিলাম আমি। তবে ভালো মানের ছবিগুলো বাছাই করে দেখতাম।
আমার এক সহকর্মী ছিল। অশ্লীল ছবি তার খুব প্রিয়। কোনো ছবি দেখার আগে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, কেমন? সে যদি বলতো ফালতু তাহলে আমি দেখতাম। সে যদি বলতো ভালো, তাহলে দেখতাম না।
যেমন; সে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’কে ফালতু বলেছে। ‘হাছন রাজা’কে ফালতু বলেছে। ‘মনের মাঝে তুমি’কে ফালতু বলেছে। আর সে যেসব ছবিকে ভালো বলেছে- সে সব ছবির নাম নাইবা বললাম।
এপ্রিল ২০০৪ থেকে আমি প্রবাসী। ২০০৬ সালের এক জুমাবারে সুখজুমায় গেলাম। জুমার দিন যে বাজার বসে, তাকে সুখজুমা বলে আরবরা। সেখানে সিডি-ডিভিডি হকারের কাছে ‘চার সতীনের ঘর’ ছায়াছবির ক্যাসেট দেখলাম। আমি ফোন করলাম বাংলাদেশের সেই সহকর্মীকে। জানতে চাইলাম ‘চার সতীনের ঘর’ দেখেছে কিনা? ছবি কেমন? সে এক ঝটকায় বলে দিলো ‘বাজে’। আমি যা বোঝার বুঝলাম, ডিভিডি ডিস্ক কিনে নিলাম।
কাহিনী সংক্ষেপ: আলমগীরের তিন স্ত্রী ববিতা, দিতি ও ময়ূরী। বাবা হওয়ার জন্য আলমগীর একের পর এক বিয়ে করতে থাকে। তার ধারণা বন্ধ্যা বলে ববিতা, দিতি ও ময়ূরী মা হতে পারে নি।
ববিতা মাটির মানুষ। নরম মন। স্বামীর প্রতি প্রবল ভক্তি। ববিতার সাথে দশ বছর সংসার করার পর আলমগীর দ্বিতীয় বিয়ে করে। ববিতাই বিয়ে করতে বলে। দ্বিতীয় স্ত্রী দিতি। ববিতা-আলমগীর যা বলে তাই মেনে চলে। তার নিজস্ব কোনো পৃথিবী নাই। বড় সতীন আর স্বামীই সব।
যখন দ্বিতীয় স্ত্রীরও সন্তান হচ্ছে না। তখন আলমগীর তৃতীয় বিয়ে করে। তৃতীয় স্ত্রী ময়ূরী। ময়ূরী গরীবের মেয়ে। দারিদ্র্যতা নিত্য সঙ্গী। দিনের পর দিন উপবাস থাকতে হয়। ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে। যখন নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়স্ক আলমগীরের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসে, এককথায় রাজি হয়ে যায়। আলমগীর ধনী, তিনবেলা খেতে পারবে। ক্ষুধার কাছে ময়ূরী পরাজিত।
তৃতীয় বিয়ে করার পরও যখন আলমগীর বাবা হচ্ছিল না। তখন চার নাম্বার বিয়ের জন্য আলমগীর পাত্রী দেখলো। পাত্রী শাবনূর। বয়সে তরুণী, আলমগীরের চেয়ে তিনগুণ ছোট বয়সে। শাবনূরের লোভী বাবা ও বড়ভাই মূলত শাবনূরকে আলমগীরের কাছে বিয়ের নামে বিক্রি করছিল। এই বিয়েতে শাবনূরের বাবা-ভাইকে জমি দিতে হবে আলমগীরকে।
শাবনূর যখন দেখল, বাবা-ভাই জমির বিনিময় বিয়ে দিচ্ছে। আর এই বিয়ে ঠেকানোর কোনো পথ নাই। তখন বাবা-ভাইকে শিক্ষা দিতে অভিনব কৌশল অবলম্বন করলো। বিয়ের একদিন আগে শাবনূর আলমগীরের বাড়িতে গেল। আলমগীরকে বললো, আমি বিয়ে বসতে নিজেই চলে আসলাম। শর্ত আমার বাবাকে জমি দিতে পারবেন না। আলমগীর রাজি হলো এবং বিয়ে হয়ে গেল।
শাবনূরের সঙ্গে বিয়ের আগে আলমগীর-ময়ূরীর দাম্পত্য জীবন ভালোই ছিল। কিন্তু শাবনূর আসার পর ময়ূরী একা হয়ে যায়। ড্যানি সিডাক আলমগীরের কামলা। সেই ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে। আলমগীরের ঘরে-বাইরে সব দেখাশোনা করে। অবিবাহিত, শক্তসমর্থ যুবক। দাম্পত্য সুখ বিরহী ময়ূরী নিজের ইচ্ছাতেই ড্যানি সিডাকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। ড্যানি সিডাককে স্বপ্ন দেখায় সে। স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজ মনিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ড্যানি সিডাক যখন বিয়ে করতে চায় তখন ময়ূরী ‘কামলা’ গালি দেয়। ড্যানি সিডাক অপমানে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
শাবনূরের সঙ্গে বিয়ের পরও যখন আলমগীর বাবা হচ্ছে না। তখন শাবনূর পরামর্শ দেয় ডাক্তার দেখাতে। তারা শহরে যায়। ডাক্তার দেখানোর পর রিপোর্ট আসে আলমগীর কখনো বাবা হতে পারবে না, শাবনূর মা হতে পারবে। অর্থাৎ ববিতা, দিতি, ময়ূরী মা না হওয়ার জন্য আলমগীর-ই দায়ি।
এ দিকে ময়ূরী বুঝতে পারে সে ড্যানি সিডাকের সন্তানের মা হতে চলেছে। লজ্জা আর অপমান থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করে।
নার্গিস আক্তার পরিচালিত এবং সেলিনা হোসেনের ছোটগল্প ‘ঘাম ও শ্রমের সংসার’ অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবি ‘চার সতীনের ঘর’ আমাদের সমাজের বাস্তবরূপ।
শিক্ষণীয় বিষয়: সন্তান না হওয়ার জন্য স্ত্রী-ই দায়ী। এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। অথচ আমাদের সমাজে এখনো অনেকে এমন ধারণা পোষণ করে। সন্তান হচ্ছে না। তাই বলে বারবার বিয়ে করতে হবে- এটাও ঠিক নয়। সন্তান ছাড়াও সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করা যায়।
তিন-চার স্ত্রী রাখতে হলে সবার অধিকার সমানভাবে আদায় করতে হয়। যদি না পারা যায় তাহলে একের অধিক বিয়ে করাটাই বোকামি। ময়ূরী অধিকার বঞ্চিত হয়েই ড্যানি সিডাকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ছোটবেলায় আমি এমন অনেক ঘটনা দেখেছি-শুনেছি। একাধিক স্ত্রী যার থাকে। তাদের অনেক স্ত্রী বাড়ির কামলা বা অন্যকোন পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাই এক নৌকার মাঝি হওয়া-ই ভালো।
ময়ূরী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পরবর্তীতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। আমরা নারী-পুরুষ যে-ই হই এমনটা ঘটে। সকল দূর্যোগ মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি। ক্ষণিকের কামনায় নিজেকে অসুন্দর পথের পথিক না বানাই।
বিশ্বাসঘাতকতার ফলাফল ভালো হয় না। আলমগীর ড্যানি সিডাককে খুব বিশ্বাস করতো এবং ভালোবাসতো। ড্যানি ক্ষনিকের মোহে নিজের বিশ্বস্ততা বিসর্জন দিয়ে মনিবের স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়। যা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার চরমরূপ। কিন্তু ফলাফল সুখকর হয়নি। অপমানিত হয়ে রাগ-দুঃখ-ক্ষোভে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। যদি বিশ্বাসঘাকতা না করতো তাহলে সুন্দর একটি জীবন পেত। আলমগীর বলেছিল তার নামে জমি দিতে। সেই জমিতে ঘর তুলে একটি সুন্দর সংসার পেত।
আর শাবনূরের চরিত্রটি যে শিক্ষা তার লোভী অভিভাবকদের দিয়েছে। তা চমৎকার। এমন লোভীদের এমনি শাস্তি হওয়া উচিৎ।
চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা
১৫ মে ২০২০