বাংলাদেশের সিনে ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে ধারণাই নেই অনন্ত জলিলের
লেখার শুরুতেই বলে রাখি, অনন্ত জলিলের চলচ্চিত্র বানানোর প্রচেষ্টাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি ও সাধুবাদ জানাই; কিন্তু তার কিছু কার্যকলাপ ও বক্তব্য সেই শ্রদ্ধাটা আর থাকে না। অনন্ত জলিলকে নিয়ে আজ থেকে ৮ বছর আগে সর্বশেষ কিছু ব্লগে কিছু কথা বলেছিলাম যারপর তাকে নিয়ে আর কিছু লেখতে কখনও মন চাইনি ও প্রয়োজন বোধ করিনি। আজ আবার লিখতে বাধ্য হলাম তার আচার আচরণ ও কথাবার্তায় অহংকারী মনোভাব দেখে।
মূল প্রসঙ্গে আসি। স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে সম্ভবত অনন্ত জলিলের কোন ধারণাই নেই, যার কারণে তিনি আজ নিজেকে বিরাট কিছু ভাবতে গিয়ে ক্লাউনে পরিণত করেছেন।
অনন্ত, আপনি হয়তো জানেন না যে এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে একদিন এ কে এম জাহাঙ্গীর খান নামের এক প্রযোজক ছিলেন যার আলমগীর পিকচার্স নামের প্রযোজনা সংস্থা ছিল। তাকে তৎকালীন শিল্পী, কলাকুশলী, পরিচালকরা শ্রদ্ধার সাথে ‘মুভি মোঘল’ নামে ডাকতো। উপাধিটা তিনি নিজে নিজেকে দেননি তাঁর কর্মের জন্য তৎকালীন চলচ্চিত্র শিল্পের সংশ্লিষ্টরা এই উপাধি দিয়েছিলেন।
তৎকালীন অনেক জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, পরিচালক আলমগীর পিকচার্সের অফিসে লাইন ধরে বসে থাকতো শুধুমাত্র জাহাঙ্গীর খান সাহেবের সাথে একবার দেখা করার জন্য, তার প্রযোজিত চলচ্চিত্রে একটা সুযোগ পাওয়ার জন্য। অথচ তখন চলচ্চিত্র অবস্থা ছিলো রমরমা, আজকের মতো অবস্থা ছিলো না যে আপনার মতো একটা উর্বর মস্তিষ্কের, রুচিহীন, আনস্মার্ট কোন ব্যক্তি চলচ্চিত্রের প্রযোজক-নায়ক হওয়ার সাহস করতো।
তখন জাহাঙ্গীর খান ছাড়াও এই ইন্ডাস্ট্রিতে আজিজুর রহমান বুলি, মোতালেব হোসেন (মেরিনা মুভিজ), শফি বিক্রমপুরী (যমুনা ফিল্মস), হাবিবুর রহমান খান (শাওন সাগর প্রোডাকশন) , মাসুদ পারভেজ (পারভেজ ফিল্মস), সফর আলী ভূইয়া, আজমল হুদা মিঠু (সালিমার প্রোডাকশন), শাহ আলম খান (সোনামণি ফিল্মস), দিলীপ বিশ্বাস, গাজী মাজহারুল আনোয়ার (দেশ চিত্রকথা), অভিনেতা জসিমের জ্যাম্বস প্রোডাকশন, রাজ্জাকের রাজলক্ষী প্রোডাকশন, শাবানার এসএস প্রোডাকশনের মতো অসংখ্য বড় বড় প্রযোজক ও প্রোডাকশন হাউস ছিল যাদের একেকটি চলচ্চিত্রের অবদানের সমান আপনার নির্মিত সবগুলো চলচ্চিত্র মিলিয়ে হবে না। তারপরও আলমগীর পিকচার্স এর কাছে কেন সবাই গিয়ে ধর্ণা দিতো জানেন? কারণ এ কে এম জাহাঙ্গীর খানের প্রজ্ঞা, বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনা, রুচি ও ব্যক্তিত্বের কারণে সকলের টার্গেট থাকতো আলমগীর পিকচার্সের কোন সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া।
আলমগীর পিকচার্স চাইলে যে কাউকে সুপারহিট নায়ক-নায়িকা বানিয়ে দিতে পারে। এ হাউসের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো থেকে অল্প কয়েকটা নাম বলি শুনেন হারুন অর রশীদের ‘মেঘের অনেক রঙ’ (স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রঙিন চলচ্চিত্র), আলমগীর কবিরের ‘সীমানা পেরিয়ে’, কাজী হায়াতের ‘দি ফাদার’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘শুভদা’, এফ কবিরের ‘সওদাগর’, মনতাজুর রহমান আকবরের ‘প্রেম দিওয়ানা’, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, ‘বাবার আদেশ’ ও ‘খলনায়ক’।
এতো এতো দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ, অনেক পরিচালক-তারকা শিল্পী উপহার, একাধিক চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরও কখনো এ কে এম জাহাঙ্গীরকে কখনও কোথাও বলতে শুনিনি ‘আমি এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা করেছি, অমুক তমুককে তারকা বানিয়েছি’। উল্টো তার চেহারাটা পর্যন্ত অনেক দর্শক দেখেনি, তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ ছিলো তখনকার বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের কাছে অসাধ্য সাধন করার মতো।
এতো গেলো একজন জাহাঙ্গীর খানের কথা, তখনকার সময়ে আরও অনেক সফল প্রযোজক, পরিবেশক ও প্রদর্শক ছিলেন যাদের কারও সমকক্ষ হওয়ার মতো আজকের তথাকথিত একশো কোটি টাকার প্রযোজক অনন্ত জলিলের যোগ্যতা নেই আর হবেও না কোনদিন। আপনি একশো কোটি টাকা ব্যয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন কিন্তু কয়েক লাখ / কোটি টাকা খরচ করে ভালো অভিনেত-অভিনেত্রীকে কাস্ট না করে নিজে নায়ক ও নিজের বউকে নায়িকা বানিয়ে পুরো চলচ্চিত্রের বারোটা বাজিয়ে দেন। আপনার মতো যদি এ কে এম জাহাঙ্গীর খান কিংবা তখনকার অন্য বড় প্রযোজকেরা করতো তাহলে এই ইন্ডাস্ট্রি একজন রাজ্জাক, আলমগীর, ওয়াসিম, বুলবুল আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাবানা, ববিতার মতো অসংখ্য গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী পেতো না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রির পিছনে একজন জসিমের যে অবদান আছে তা অনন্ত জলিল হাজার কোটি টাকার সিনেমা নির্মাণ করলেও জসিমের অবদানের ছিটেফোঁটাও পূরণ করতে পারবে না।
আজকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রির সেই সুসময় নেই তাই নেই একেএম জাহাঙ্গীর খান, শফি বিক্রমপুরী, হাবিবুর রহমান খানের মতো সত্যিকারের শিল্পবোধ সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র প্রযোজকেরা। যদি থাকতো তাহলে আপনি অনন্ত জলিল এফডিসির গেইটের ভেতরে প্রবেশ করতে পারতেন কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আজকের নির্বোধ প্রজন্মের কাছে আপনি অনেক বড় কিছু হতে পারেন, অনেক চাপাবাজি করতে পারেন কিন্তু আমরা যারা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি দিনের দর্শক তাদের কাছে, তাদের চলচ্চিত্র জ্ঞানের কাছে আপনি অনন্ত জলিল কিছুই না।