Select Page

শুক্রবার রাতটা ‘শনিবার বিকেল’

শুক্রবার রাতটা ‘শনিবার বিকেল’

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত সবগুলো সিনেমা দেখেছি। বাদ-বাকিগুলোর তুলনায় সম্ভবত সবচেয়ে অগভীর ‘শনিবার বিকেল’। ফারুকীর যেকোনো নির্মাণে সিরিয়াস কোনো ইস্যু থাকে। সিনেমাগুলোর গল্প আলাদা হলেও কমন একটা ফিলোসফি বোধহয় আছে। যেটারে ওয়েব ফিকশন ‘সামথিং লাইক আ অটোবায়োগ্রাফি’ প্রসঙ্গে (যদি ভুল না করি,বিদেশী কোনো একটা সাক্ষাৎকারে) বারবার বলছেন, মানবজীবনের ‘নাজুকতা’। ‘শনিবার বিকেল’ও এর ব্যতিক্রম নয়। ফারুকীর সিনেমায় হাসাহাসি থাকে বটে, হয়তো এন্টারটেইনিং ভ্যালু আকারে দরকার। তবে মূল গল্পের টেনশনের বদলে হাসানোর চেষ্টা যেন প্রবল হয়ে উঠে, এবারও তাই। এটা ঠিক যে, কেউ কেউ হয়তো হাসানোর চেষ্টাটুকু দেখতে পাবেন না। কিন্তু খুব কষ্ট করা ছাড়াই এমন কসরত আমার চোখে পড়েছে।

ফটোগ্রাফির দিক থেকে খুবই নান্দনিক নির্মাণ ছিল সিনেমা হলে দেখা তার শেষ সিনেমা ‘ডুব’। সেই সিনেমার মতো ডিসক্লেইমার জুড়ে দিয়েছেন ‘শনিবার বিকেল’-এর গল্পও কাল্পনিক। যদিও আমরা শুনেছি কাল্পনিক না। সমান্তরালে আছে স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গা ছমছমে হামলার ঘটনা। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা। সম্ভবত দুই ডজনের বেশি জিম্মি ও সশস্ত্র হামলাকারী এ সময় নিহত হন। ফলত কাল্পনিক হওয়া সত্ত্বেও রেফারেন্স টানা বা তুলনার লোভ আমরা সামলাতে পারি না। তো, আজকালের এ বাংলাদেশে আমাদের ভাবনার জগতে সেই ঘটনার প্রভাব কতটুকু? এ ঘটনা সম্পর্কে আমরা আসলে কতটা জানি বা আমাদের জানতে দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে হামলাকারী তরুণদের সম্পর্কে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল। তাদের মনোস্তত্ব বা মোটিফ আমরা কতটা ধরতে পেরেছি বা আমাদের সামাজিক পরিসরে এ আলোচনা কতটাই স্থান পেয়েছে। আমাদের ধারণা হয়তো আমরা অনেক কিছু জানি। আবার ‘নাজুক’ এ বিশ্বে আমরা কতটাই বা জানতে পারি।

যতই অগভীর বলি বা (সিনেমা হিসেবে) ‘অপছন্দ’ও যদি করি ‘শনিবার বিকেল’-এর গুরুত্ব রয়েছে। যার কারণে আমাদের কিছু না কিছু বলতে হয়। সেটা সিনেমাটিক অথবা অ্যাসথেটিকসের জায়গা থেকে না হলেও রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবে এটাকে নিয়ে তো ভাবতে হবে। বিশেষ করে এমন সিনেমা আমাদের কেন বানাতে হয়। এবং ইসলাম প্রশ্নকে আমরা কীভাবে ডিল করি তার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে।

শাহবাগ ও শাপলার ঘটনার পর ইসলাম প্রশ্ন আর আগের মতো নাই বাংলাদেশে। এমনকি গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিও আগের মতো নাই। বাংলাদেশে শাহবাগ জারিত সেক্যুলার রাজনীতি ও তার বাঙালিয়ানার খোলস সব ধরনের সহনশীলতাকে ‘না’ করে দিয়েছে। এ সব পরিস্থিতিতে ভার যেকোনো পরিসরে বিক্ষুব্ধভাবে এসে পড়তে পারে। একইসঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক ঘটনা; বিশেষ করে সশস্ত্র ইসলামকে কোনোভাবে বৈশ্বিক পরিসর ছাড়া বর্ণনা করা যায় না। তার সঙ্গে গুরুতরভাবে যুক্ত ইসলাম সম্পর্কিত বয়ানগুলো। এমন পরিস্থিতিতে আসলে কারা কীভাবে লড়তেছে- তাকে তো ডিফাইন করতে হবে। হলি আর্টিজানকে আমরা (মানে যারা পারে নাই) সেভাবে ডিফাইন করতে পারি নাই কখনো- তেমনি শনিবার বিকেলকে কীভাবে ডিফাইন করব। এমনকি বাংলাভাই সম্পর্কিত আলোচনাগুলো স্পষ্ট না। কিন্তু আমরা যখন এই ঘটনাগুলো কল্পনা করি, তা মূলত সমসাময়িক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এর ছায়া দেখতে পাই। একইসঙ্গে এ সম্পর্কিত প্রভাবশালী তত্ত্বও যুক্ত। আমার পছন্দ হোক বা না হোক, প্রতিটি সশস্ত্র ঘটনার গভীর বয়ান ও ক্ষুব্ধতা থাকে; শনিবার বিকেলে সেটা আসলে কই।

আমরা যখন ছোট ছিলাম- তখন অবাক হয়ে দেখতাম মিডল ক্লাস লেখক বা নির্মাতারা, যারা এখন আর গ্রামে থাকেন না- তাদের ধর্মীয় সংস্কার সম্পর্কিত সব চিত্রায়ন গ্রাম কেন্দ্রিক। গ্রামে ক্ষমতা বলয়ের কাছে সংকুচিত হয়ে থাকা ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মোকাবেলা করতে করতে দিনপাত করছেন তারা। এখন আমাকে নিশ্চয় এটা বিশ্বাস করতে হবে না যে ‘শনিবার বিকেলে’ যেভাবে ইনতেখাব দিনারের ক্যারেক্টারটা বারবার বলে ‘ঠিক কিনা’ সেরকম কোনো ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকার আধুনিক তরুণরা রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে দীনি শিক্ষার আয়োজন করছে। নাকি করতে হবে। বরং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যে ধরনের আলোচনা বা আক্রমণগুলো ইসলামী প্রতিপক্ষের তরফে স্ট্যাটাস বা মন্তব্যের ঘরে মেলে তার আরামদায়ক ও কৌতুককর পরিবেশনা ‘শনিবার বিকেল’। এমন না যে এ বিষয়গুলো হলি আর্টিজান হামলায় ঘটে নাই। কিন্তু এটাই কী শুধু ঘটেছিল! আর হামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনে হয়, তারা শুধু মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়- সে আকর্ষণের বিষয়টা কী আসলে? এ আকর্ষণে সোসাইটি কী গুণগত বদল ঘটবে বলে তারা মনে করে- জানা যায় না। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো- পুরো ঘটনারে কিন্তু একটা লাইনে আর রাখা হলো না।

সোজা কথায়, পুরো থিমটারে ইনডিয়ান বিদ্বেষ কনসেপ্টের মধ্যে ঢোকায়া দেয়ায় জঙ্গিবাদের গল্পটাই হারায়া গেছে। এটা সেফ এক্সিট কিনা জানি না। এটা খুব নিন্দনীয় যে সিনেমাটা বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড আটকে রাখছে। কিন্তু খেয়াল করেন, উত্তর আমেরিকায় পরিবেশক ছিল রিল্যায়েন্স। আর এখন নির্বাচনের আগে ইনডিয়ান প্লাটফর্ম সনি লিভ আমাদের সামনে হাজির করতেছে। এবং এ সিনেমার ইনডিয়া কোশ্চেনের মধ্যে কিন্তু ইনডিয়ারে বাঁচায়া দেয়ার চেষ্টা আছে। যেভাবে কিছুদিন আগে চঞ্চল চৌধুরী বাংলাদেশীদের ক্ষোভের কারণগুলো আড়াল করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে মুখ গুছে দেন। তেমনি বাঙালি জঙ্গিরা এতই ইনডিয়া বিদ্বেষী যে মুসলমান হইলেও তারে মেরে ফেলতে হবে এমন জায়গায় গিয়া বয়ান দাঁড় করাচ্ছে।

টেকনিক্যালি সিঙ্গেল-শটের সিনেমা হিসেবে প্রচারিত ‘শনিবার বিকেল’। যদিও শুরুর ক্রেডিটের তিনটা সিনই আলাদা আলাদা জায়গার। তাছাড়া মূল গল্পের দৃশ্যায়নে কোনো কাট থাকলেও দর্শকের বোঝার উপায় নাই। কিন্তু নির্মাতা হিসেবে নিশ্চয় উচ্চাভিলাষী বিষয়। এ সিদ্ধান্ত মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কেন নিয়েছেন- তা স্পষ্ট না। তবে গল্পকে একটা ফ্লোরে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে কার্যকরী যুক্তি বটে। বারান্দা বা দরোজার বাইরে- এমনকি দোতলা অবধি যাইতে হয় নাই। অন্যদিকে অভিনয় প্রসঙ্গে যা বলতে হয়- ফারুকী সাবলীলভাবে যে কাউকে অভিনয় করানোর ক্ষমতা রাখেন। সেটা আলাদা হয়ে উঠে না- অতিসাধারণই থাকে, এ ছবিতেও তাই। অভিনয় তো ঠিকঠাকই, তবে যার ওপর যতক্ষণ ফোকাস থাকে গল্প, ততক্ষণই তিনি অভিনয়টা করেন, কিন্তু আবহে চলাচলের সময় হোস্টেজ হওয়ার টেনশন ধরা পড়ে না। বরং তারা আক্রমণকারীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। এছাড়া শেষের টুইস্টটা হয়তো অনেকেই ধরে ফেলবেন। টুইস্টের কারণে হয়তো গল্পটা মানবিক হতে গিয়েও হয় না।

হলি আর্টিজানের যে গল্প তার সঙ্গে শনিবার বিকেল ঠিকঠাক কিনা এই প্রশ্ন আমরা করছি না। যেকোনোভাবেই বলা হোক, এ গল্প সেদিকে কানেক্ট করবে। বরং আবার এটাই মনে করায়া দিই যে সর্বোচ্চ সুবিধাপাওয়া শ্রেণী ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটা কীভাবে তৈরি হয়, সেটা মিসিং। এমনকি সেক্যুলার ভাবনার জায়গা থেকেও তরুণদের সমস্যাটাও ধরার চেষ্টা করে নাই এ ছবিতে। বন্ধুর বাবার আবেগী আলাপের কোনো সার কিন্তু নাই। বাবারা কী করতে ব্যর্থ হইছে- সে আলাপ করা না হলে বন্ধু বাবার ক্যারেক্টারের দরকার নাই আসলে। নইলে সারবস্তুহীন লাইন ‘এই বাংলাদেশই কি চেয়েছিলাম’ বা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ এর মতোই আরকি। হয়তো বলা যায়, এই শনিবার বিকেলই কি আমরা দেখতে চেয়েছিলাম! না, এটা বলব না। ‘শনিবার বিকেল’ তো আসলে সেটাই যা ফারুকী বানাতে চেয়েছিলেন। বড়পর্দায় না হোক, এখন তো পাইরেটেট কপি দেশের মানুষ দেখছে। দেখুক।

শিরোনামের দোহাই : শুক্রবার রাতে দেখছিলাম ‘শনিবার বিকেল’! সে সূত্রে রাতটা ‘শনিবার বিকেেল’ হয়ে গেছে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন