Select Page

বাংলা চলচ্চিত্রের গলায় ‘সেন্সরশিপ’ কাঁটা

বাংলা চলচ্চিত্রের গলায় ‘সেন্সরশিপ’ কাঁটা

চলচ্চিত্র হচ্ছে একটা সৃজনশীল মাধ্যম। এই মাধ্যমে একজন নির্মাতা সমাজের কথা বলে, মানুষের কথা বলে অর্থাৎ এক কথায় চলচ্চিত্র আমাদের কথা বলে। কিন্তু এই কথা বলার মধ্যে যখন আপনি একটা কাচি (✂) দিয়ে খোঁচা মারবেন সমস্যাটা তখনই।

আসলে চলচ্চিত্র যেমন সৃজনশীল মাধ্যম তেমনি এই চলচ্চিত্র একটি স্বাধীন মাধ্যম। যদিও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন ফিল্ম সার্টিফিকেশন সিস্টেমে একটি গ্রেড দিয়ে সিনেমা প্রদর্শনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ এখনও পাকিস্তান আমলের সেই সেন্সরবোর্ডের আইন নিয়েই পরে আছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যেই পাকিস্তানি সেন্সর আইন মেনে এখনো আমরা নির্মাতাদের স্বপ্নের উপর কাচি দিয়ে কাটছাট করি সেই পাকিস্তানও এখন ফিল্ম সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শনের অনুমতি প্রদান করে।
ভাবতে পারেন?

গত কয়েকমাস আগে যখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ডের নতুন জুরি বোর্ডের কমিটি ঘোষণা হলো, তখন সেই জুরি বোর্ডের একজন সদস্য এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির বর্তমান সভাপতি জনাব খোরশেদ আলম খসরু বলেছিলেন যে তারাও এই সেন্সর সিস্টেম বিলুপ্ত করে খুব দ্রুত ফিল্ম সার্টিফিকেশন সিস্টেম চালু করবেন।
কিন্তু কই?

ওই যে উনি জুরি বোর্ডের সদস্য হওয়ার পর কোনো এক টিভিতে বলেছিলেন, তারপর আর কখনো তাকে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি বা এখন পর্যন্তও এই ফিল্ম সার্টিফিকেশন সিস্টেম নিয়ে জুরি বোর্ডে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

তারপর মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশে শুধু একটা সেন্সরবোর্ড না আরও অনেক সেন্সরবোর্ডই আছে। যেমন- আমাদের ডিএমপি পুলিশ কার্যালয় থেকে গত দু’তিন বছর আগে একটা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো যে পুলিশকে চলচ্চিত্রে নেগেটিভ ভাবে দেখানো যাবে না। চলচ্চিত্রে নাকি পুলিশকে নেগেটিভ চরিত্রে দেখানোর কারণে, জনগণের মন থেকে পুলিশের প্রতি আস্থা উঠে গেছে।
ভাবতে পারেন?

তারপর আসুন আরেক মজার কান্ডতে, আপনি যদি ক্রিকেট নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র বানান তাহলে সেই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে জমা দিতে হবে। তারপর ক্রিকেট বোর্ড যদি আপনাকে ‘হ্যাঁ’ বলে তাহলে আপনি চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করতে পারবেন।

একবার ভাবুন তো, একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের পর যদি এত এত বাধা আসে তাহলে কেন একজন নির্মাতা মৌলিক এবং বাস্তবধর্মী সিনেমা নির্মাণ করবেন? আর কেনই বা একজন প্রযোজক এইসব বাস্তবধর্মী, মৌলিক সিনেমার পিছনে টাকা লগ্নি করবেন?

আমাদের চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ডে আরও কিছু এমন বিষয় আছে যেগুলো আপনাদের জানা দরকার। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড প্রশাসনিকভাবে একজন চেয়ারম্যানের অধীনে পরিচালিত হয়। যার অধীনে একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন সচিবসহ ছয়জন পরিদর্শক থাকেন। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন পেশা ও স্তরের লোকদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠিত হয় যারা চলচ্চিত্র ছাড়পত্র দিয়ে থাকে।

সমাজের বিভিন্ন পেশা ও স্তরের লোকদের নিয়ে?
আপনি ভাবতেও পারবেন না এই জুরি বোর্ডের যে সদস্যরা থাকে তাদের বেশীরভাগ সদস্যই অতীতে কিংবা বর্তমানে চলচ্চিত্রের সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং চলচ্চিত্র নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞানও নেই। তাদের মধ্যে বেশীরভাগই সরকারি আমলা।
বুঝতে পেরেছেন?
যাদের চলচ্চিত্রের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্কই নেই তারা একজন শিক্ষিত এবং সৃজনশীল নির্মাতার সিনেমাকে ছাড়পত্র দিচ্ছে।
ব্যাপারটা হাস্যকর না?

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অন্ধকার বা কালো সময় সম্পর্কে সবারই জানা। যখন অবাধে যৌনতাকে পুঁজি করে চলচ্চিত্র নির্মান হতো, এই সময়টা থেকেই আমাদের চলচ্চিত্রের দর্শক এবং প্রেক্ষাপৃহের সংখ্যা কমতে থাকে। সেন্সরবোর্ডের সদস্যরা তখন টাকা খেয়ে এইসব সিনেমাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিতো। এখনও তারা থার্ড ক্লাস অনেক চলচ্চিত্রকে সেন্সর ছাড়পত্র দেয় কিন্তু তাদের কার্পণ্যতা আসে সকল মৌলিক এবং বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রের বেলায়।

রানা প্লাজা ট্রাজেডি সম্পর্কে সবারই জানা। এই রানা প্লাজা ট্রাজেডি নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের প্রশ্ন এবং আগ্রহের শেষ নেই।নির্মাতা নজরুল ইসলাম খান মানুষের আগ্রহ দেখে, গার্মেন্টস কর্মীদের এবং মানুষদের সচেতন করার জন্য নির্মাণ করেন রানা প্লাজা নামে একটি চলচ্চিত্র। কিন্তু সেন্সরবোর্ড গত কয়েকবছর ধরে এই সিনেমা আটকে রেখেছে। নজরুল ইসলাম খান আইনি লড়াই পর্যন্ত করেছেন কিন্তু দূর্ভাগ্য তার সত্যের প্রতি সহায় হয়নি কেউ।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্র সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। গুলশানের হলি আর্টিজনে জঙ্গী হামলার ঘটনা থেকে আংশিক অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই সিনেমাটি নির্মান করেন। ইতিমধ্যেই এই চলচ্চিত্রটি মস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রাশিয়ান ফিল্ম ক্রিটিকস জুরি প্রাইজ পেয়েছে এমনকি সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ফিল্মফেস্ট মুনচেন, বুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং হং কং ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সহ আরও কয়েকটি ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়ে প্রশংসিত হয়েছে।

এমন একটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কারজয়ী সিনেমার বেলায় বাংলাদেশ সেন্সরবোর্ডের এমন সিদ্ধান্ত সত্যিই আমার বোধগম্য হলো না। হয়ত মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী আইনি লড়াই করে বা অন্যভাবে সেন্সরবোর্ড থেকে প্রদর্শনীর জন্য ছাড়পত্র নিবে কিন্তু তখন ছাড়পত্র দিলেও দেখা যাবে হইতো সিনেমাটাকে কাটছাট করে বারোটা বাজিয়ে  দিবে।

বাংলাদেশ সেন্সরবোর্ডের আরেক বলির পাঠা হচ্ছে ‘মর থেঙ্গারি’ বা ‘আমার বাইসাইকেল’।এই চলচ্চিত্রটি চাকমা ভাষায় তৈরি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। আসলে এই চলচ্চিত্রটি শুধু চাকমা ভাষায় তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র বলে গুরুত্বপূর্ণ না, এই চলচ্চিত্রটি আমাদের জন্য অনেক গর্বের এবং আবেগের।এই চলচ্চিত্রটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নিপিড়ীত চাকমা বা পাহাড়িদের কিছু ঘটনা উল্লেখ করার জন্য বাংলাদেশ সেন্সরবোর্ড চলচ্চিত্রটি আটকে রেখেছে।

তার মানে বুঝেছেন?
স্বাধীনতায় কাচি!
সত্য বলায় কাচি!
বাস্তবতায় কাচি!

এরকম আরও বহু চলচ্চিত্র আছে, যেগুলো বাংলাদেশ সেন্সরবোর্ডের বলির পাঠা হয়েছে।
এত সকল বাধা, তার মধ্যে সিনেমা নির্মাণ!
আসলে আমাদের দেশে কিসের মৌলিক, কিসের বাস্তবধর্মী সিনেমা হবে?
কোন নির্মাতা চাইবে, তার স্বাধীনতা এবং স্বপ্নের উপর কাচি চালানো হোক?

এখনও সময় আছে এই বিলুপ্ত প্রজাতির সেন্সর বোর্ডকে বিলুপ্ত করার। এই প্রজাতিটি বিলুপ্ত নাহলে একদিন নির্মাতারা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা দিবে, লেখকরা বাস্তবধর্মী-জীবনধর্মী লিখালিখি ছেড়ে দিবে এবং সত্য লিখতে ভয় পাবে আর প্রযোজকরা লগ্নি করা বন্ধ করে দিবে অন্যদিকে দর্শকরা চলচ্চিত্র থেকে চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নিবে।


Leave a reply