বাংলা চলচ্চিত্রে পুলিশের ভাবমূর্তি
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের ১ম সপ্তাহের দিকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলো যে ” চলচ্চিত্রে পুলিশ বাহিনীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যাবে না” ! যে নোটিশের বিরুদ্ধে অনেকেই সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন ।
আমাদের মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাইকেও দেখেছিলাম এই ব্যাপারে ক্ষোভ মিশ্রিত একটা বিবৃতিমূলক স্ট্যাটাস দিতে । দুঃখের বিষয় হলো কেউই পুলিশ বাহিনি’কে বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে কত সাহসী ও সৎ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল সেগুলোর কোন উদাহরণ তো দিলেনই না শুধু প্রতিবাদ করে কথার ফুলঝুরি দেখিয়েছিলেন। অনেকে ভারতের ‘’আব তাক ছাপ্পান’’ ছবির কথাও বলেছেন যেধরনের ছবি এইদেশে এখনও তৈরি হয়নি বলে পুলিশ বাহিনীকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেছেন ।
আমি ফারুকী ভাইয়ের কাছ থেকে আশা করেছিলাম যে বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে পুলিশকে মহান হিসেবে তুলে ধরার একাধিক ঘটনা তিনি উদাহরণসহ তুলে ধরে পুলিশবাহিনীর নোটিশের জবাব দিবেন । কিন্তু তা তিনি করেননি , হয়তো বা সেইসমস্ত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিদেশি পুরস্কার প্রাপ্ত মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাইয়ের কোন ধারনাই নেই যা তিনি প্রমানসরূপ পুলিশ বাহিনীকে দিতে পারতেন ।
যাই হোক, বাংলা চলচ্চিত্রের একজন সাধারন চলচ্চিত্রপ্রেমি হিসেবে আমি মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের কিছু তথ্য তুলে ধরবো পুলিশ বাহিনীর কাছে যা জেনে উনারা অন্তত এইটুকু শান্তি পেতে পারেন যে চলচ্চিত্রে পুলিশ বাহিনীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি হয়েছিল জনগণের জন্য মহান, সৎ ও সাহসী হিসেবেও ।
১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও একাধিক শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ ছবির মূল গল্পটাই ছিল একজন সংসদ সদস্য ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে সৎ ও সাহসী তরুন পুলিশ অফিসারের গর্জে উঠার চিত্র যে অফিসার নিজের জীবন দিয়েও দেশ থেকে একজন সন্ত্রাসী, গডফাদার’কে নির্মূল করেন । সেই ছবিতে খারাপ পুলিশ অফিসার যেমন ছিল তেমনি ছিল মান্নার মতো সৎ ও সাহসী পুলিশ অফিসার যে পুরো থানার ঘুষখোর অফিসারদের পাল্টে দিয়েছিলেণ ।হয়েছিলেন জনগণের সেবক । কোন বাঁধা সেই অফিসারকে তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি ।
কাজী হায়াতের ‘সিপাহী’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে ইলিয়াস কাঞ্চন দেশের সেবা করার জন্য পুলিশ অফিসার হিসেবে চাকরি শুরু করে। ইলিয়াস কাঞ্চন সেই ছবিতে একজন আদর্শবান পুলিশ অফিসার যার পরিনতিতে স্ত্রী চম্পা সহ নিজের জীবন দিতে হয় সন্ত্রাসীদের হাতে । সেই সিপাহী ছবিতেও পুলিশ বাহিনীর জয় জয়কার ছিল ।
কাজী হায়াতের আরেকটি আগুনঝরা ছবি ‘লুটতরাজ’ ছবিতেও সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে পুলিশ ও সন্ত্রাসী গডফাদারদের সহযোগী হাতিয়ারের বিরুদ্ধে এক পুলিশ অফিসারের লড়াই করার গল্প ছিল যেখানেও পুলিশ বাহিনীকে সুমহান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে । কাজী হায়াতের ‘সমাজকে বদলে দাও’ ছবিতে একজন পুলিশ অফিসার ঘুণেধরা সমাজ ও রাজনীতির বিরুদ্ধে সমাজকে বদলে দেয়ার চিত্র দেখানো হয়েছে । যেখানে একজন পুলিশ অফিসার পুরো পুলিশ বাহিনী সহ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার গল্প ।সেই অফিসার সমাজকে বদলে দিতে চেয়েছিল যা দেখে হলের দর্শকদের মাঝে পুলিশের জন্য আলাদা শ্রদ্ধা চলে আসে ।
শুধু একজন কাজী হায়াতের ছবিগুলোর উদাহরণ দিয়ে যাচ্ছি তাহলে ধারন করুন বাকী পরিচালকদের ছবির উদাহরণ দিতে গেলে বাংলা চলচ্চিত্রের কতগুলো ছবি পাওয়া যাবে যেখানে পুলিশ মানেই আদর্শবান , সাহসী, সৎ কোন ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ।
১৯৮৯ সালে একাধিক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত মালেক আফসারীর “ক্ষতিপূরণ ” চলচ্চিত্রে প্রয়াত খলিল ছিলেন একজন সৎ পুলিশ অফিসার যিনি আলমগীরকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করার পর একটি খুনের মামলার রহস্য উদঘাটন করার ক্লু পেয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত আলমগীরের মাধ্যমেই আসল খুনীদের চিহ্নিত করেন।
শহিদুল ইসলাম খোকনের ‘শত্রু ভয়ংকর’ , ‘দুঃসাহস’ ছবিগুলোতেও সোহেল রানা ছিলেন পুলিশ বাহিনীর একজন সৎ ও আদর্শবান অফিসার যার সাথে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় সমাজের শত্রুদের । মমতাজ আলী’র ‘উসিলা’ ছবিতেও জাফর ইকবাল একজন পুলিশ অফিসার যিনি তাঁর আপন বড় ভাই গডফাদার উজ্জ্বলকেও ছাড় দেননি।
শুধু কি পুলিশ ইনস্পেকটর বা ওসিদের চরিত্র ভালো হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল ? না, ‘হাবিলদার’ ছবিতে জসিম পুলিশের একজন হাবিলদার হয়েও আদর্শের দিক দিয়ে ওসি, এসপি সবাইকে ছাড়িয়ে যায় । সেই ছবি দেখলে মনে হবে পুলিশের হাবিলদার’রা অনেক ভালো ও সাহসী মানুষ ।
পুরুষ পুলিশ অফিসারদের পাশাপাশি নারী পুলিশ সদস্যদেরও বাংলা চলচ্চিত্র উপস্থাপন করেছে মহীয়সী হিসেবেও । সিদ্দিক জামাল নানটু’র ‘রক্ত নিশান’ ছবিতে শাবানা একজন নারী পুলিশ অফিসার যার আদর্শ ,সততার কারণে পরিবারের সদস্যদের জীবন দিতে হয়েছিল কিন্তু তারপরেও শাবানা সেই আদর্শ ও সততা থেকে একবারও পিছপা হননি। সেই ছবিতে শাবানা যেন নারী পুলিশ সদস্য সহ পুরো পুলিশ বাহিনীর গর্ব হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল ।
মমতাজুর রহমান আকবরের ‘বাবার আদেশ’ ছবিতেও রাজীব একজন সৎ পুলিশ কনস্টেবল যা দেখে সেদিন সিনেমা হলে দর্শকদের চোখে পানি চলে এসেছিল । এমন অসংখ্য অসংখ্য ছবির উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে পুলিশ সদস্য তথা পুলিশ বাহিনীকে সুমহান , আদর্শবান জনগণের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে ।
পুলিশ ভাইয়েরা কি জানেন বাংলা চলচ্চিত্রের পুলিশকে সুমহান হিসেবে যতবেশি ,যতবার উপস্থাপন করা হয়েছে আর অন্য কোন মাধ্যমেই বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি এতো দারুন ভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
একজন কাজী হায়াতের দাঙ্গআ,সিপাহি, লুটতরাজ, সমাজকে বদলে দাও, ধাওয়া, ছবিগুলোতে পুলিশকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেইরকম পুলিশ বাস্তবে একজনও পাওয়া যাবে না এটা আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি । বাংলা চলচ্চিত্রে যদি সুমহান হিসেবে কোন বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি উপস্থাপন করা হয়ে থাকে সেটা হলো পুলিশ বাহিনী’র চরিত্র । মজার ব্যাপার হচ্ছে ছবিতে পুলিশকে যেভাবে ইতিবাচক উপস্থাপন করা হয়েছে বাস্তবের সাথে সেরকম মিল পাওয়া অনেক সাধনার ব্যাপার , ‘দাঙ্গা’ ছবির মান্নার মতো পুলিশ আজ বাস্তবে নেই বরং ছবিতে যে পুলিশ মারামারি/ কোন অপরাধ ঘটার পরে হাজির হয় বাস্তবেও সেটা প্রতিদিন দেখতে পাই। ছবিতে পুলিশের সামনে যেভাবে অপরাধীরা অপরাধ করে বাস্তবে আজো পুলিশের সামনে খুন করে খুনিরা পালিয়ে যায়, পুলিশের সামনে সরকার সমর্থকেরা বাসে পেট্রোল বোমা মেরে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় ।
বাংলা চলচ্চিত্রে বহুদিন ধরে ভালো পুলিশ সদস্য যেভাবে উঠে এসেছে খারাপ পুলিশ সদস্যর চরিত্রও বহুবার তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু এর আগে কোনদিন শুনিনি পুলিশবাহিনী তাঁদের চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করার উপর কোন নোটিশ বা বিধিনিষেধ আরোপ করেনি কারণ ‘চলচ্চিত্র’ একটি বিনোদনের মাধ্যম যেখানে কাল্পনিক গল্প, কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ থাকবেই যার ফলে ছবির পুলিশের ভালো মন্দ চরিত্রের সাথে বাস্তবের পুলিশের মিল ধরতে কেউ যায়নি । হতে পারে সেইসময় পুলিশবাহিনীর মাঝে ‘আদর্শ’, ‘সততা’, ‘ন্যায়বিচার’ শব্দগুলো বাস্তবে ছিল তাই চলচ্চিত্রে কি দেখালো না দেখালো সেটা নিয়ে পুলিশের কোন মাথাব্যথা ছিল না।
এখন দিন বদল হয়েছে তাই মাথাব্যথাও দেখা দিয়েছে কারণ চলচ্চিত্রের পর্দার কল্পকাহিনী নয় বাস্তবে প্রতিদিন আমরা নীতিহীন পুলিশ সদস্য এতো বেশি দেখতে পাচ্ছি যে পুলিশ জনগণের নয় সরকারের সেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর তা যদি সিনেমার পর্দায় বারবার দেখানো হয় তাতে উনারা ভীষণ লজ্জাবোধ/ বিব্রতবোধ করবেন। অসহায় পুলিশ বাহিনীকে বিব্রতবোধ থেকে রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব, শিল্প মাধ্যমের মানুষগুলোরও দায়িত্ব। পুলিশ বাহিনীর শুভবুদ্ধির উদয় হোক এই কামনা করি।।