বাংলা সিনেমা ও একজন রিয়াজ
অজান্তে সিনেমা যখন দেখতে যাই; তখন আমার বয়স ১৩ বছর। আমার যতদূর মনে পড়ে আমার সাথে ছিল আমার দুই কাজিন। ওদের সিনেমা দেখাব। কিন্তু এত ভীড় যে টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করাটা আমার জন্য ছিল কষ্টসাধ্য। তারপরও সিনেমা দেখতেই হবে। শাবানা-আলমগীর আছে। নায়ক ইমরান কে মোটামুটি চিনি। কিন্তু আর তিনজন নায়ক নায়িকাকে কস্মিন কালেও চিনলাম না। তবে নায়কটাকে বেশ লাগছে। বেশ হ্যাণ্ডসাম। মোটকথা, নায়ক হতে যা যা লাগে সবগুনই তাঁর মাঝে লক্ষ্য করলাম। অন্যধরণের উত্তেজনা অনুভব করে ঝুঁকি নিয়ে টিকিট কাটলাম। জায়গা পেতে পেতে পেলাম সবার সামনে। ভালই হলো। কারণ আমরা তিনজন আকারে এতই ছোট যে, সবার মাথা ছাপিয়ে সিনেমা দেখাটা মোটেও হতো বলে হলে ঢোকার পরে মনে হলোনা।
ছবি আরম্ভ হয়ে গেছে। শাবানার লিপে গান চলছে ”খোকনরে তুই একবার মা বলে ডাক”। দর্শক কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বড়দের সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকলাম এই কারণেই যে, দেখিনা কেউ নায়কের নাম ধরে কিছু বলে কিনা। অথবা নায়িকাটাকে কিছু বলে কিনা। নাহ্! কেউ কিচ্ছু বললনা। কারণ সিনেমার কাহিনী এতবেশী পুষ্ট যে অন্য কোন দিকে কারও কোন খেয়াল নেই। সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তা উপভোগ করছে।
নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিনেমা শেষ হলো। আমার কাজিন দুজন বার বার জানতে চাইলো নায়ক নায়িকা কারা কারা। আমি কোন সদুত্তর দিতে পারলাম না। পরের দিন আবারও সিনেমা দেখতে ঢুকলাম একা একাই। কারণ আগের দিন জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিনেমা উপভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু ওমা! হলের ভিতরে ঢুকে আমার মাথা চড়কগাছ। গতকাল তাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু আজ সে সুযোগও নেই। বাধ্য হয়ে আমাকে সবাই বের করে দিলো। গেটম্যান অনেক কষ্টেশিষ্ঠে আমাকে ব্যালকণিতে জায়গা করে দিলো। এক মহিলার পাশে বসে উপভোগ করলাম। আমি আজও নায়ক নায়িকার নাম জানতে পারলাম না।
সাতদিন পর আবার গেলাম। এবারও হলোনা। সেবার খোকসার মেলা স্থায়ী হয়েছিল একমাস। আর সিনেমাও ব্যবসা করেছিল ঐ একমাস ধরেই। কি জানি মানুষ কেন এতো পাগল হয়েছিল সেদিন অজান্তে সিনেমাটি দেখার জন্য। আজও সেই হলই আছে একই মানুষ; তবে কেন বিনোদনের জন্য সিনেমা উপভোগ করেনা? তারও পর সবার মুখে মুখে নতুন একটি নাম শুনতে থাকলাম “রিয়াজ”। এরপর আর বোধহয় রিয়াজকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর অভিনয় দক্ষতাতে মুগ্ধ হননি এমন দর্শকের সংখ্যা খুবই কম। অথবা তাঁরা মূলধারার চলচ্চিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না। শ্যামল ছায়া, হাজার বছর ধরে, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, বিয়ের ফুল, নারীর মন, এই মন চায় যে, মাটির ফুল, কাজের মেয়ে, ভয়ংকর বিষু, মিলন হবে কতদিনে, স্বপ্নের ভালবাসা, স্বপ্নের বাসর, মনের মাঝে তুমি, মন মানেনা, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, রং নাম্বার, দারুচিনি দ্বীপ, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, প্রেমের তাজমহল, শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ আরো অনেক ছবি। যে ছবিগুলো বাংলা চলচ্চিত্রকে যেমন করেছে সমৃদ্ধ; তেমনি হয়েছে ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল।
আমার যতদূর মনে পড়ে আমার ইণ্টারমিডিয়েট লাইফ পাড় করেছি রিয়াজের ছবি দেখে। আমার লাইফ ষ্টাইলটা পরিবর্তীত হয় রিয়াজ ভাইয়ের মতো করে। তাঁর মন সিনেমা আমি যখন হলে বসে উপভোগ করি, তখন আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি কলেজে যাবো তাঁর মতো করে। ঠিক আমার কলেজের প্রথম দিন তাঁর ষ্টাইলেই হেঁটেছিলাম আর তার মতো করে বইগুলো ফাইলআপ করেছিলাম। আমার মনে পড়ে, ‘এ বাঁধন যাবেনা ছিঁড়ে’ সিনেমা চলছে; যার শ্রেষ্ঠাংশে আমার দুই ফেবারিট নায়ক-নায়িকা, রিয়াজ-শাবনুর। অথচ আমার এসএসসি পরীক্ষা চলছে। বাংলা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে এসেছি। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুনপোকার মতো শুধু একটি চিন্তাই কাজ করছে তাহলো: এ বাঁধন যাবেনা ছিঁড়ে কখন দেখতে যাবো?
সন্ধ্যা ছয়টার আগে এক বন্ধুর সাইকেল ধার করলাম এবং বাবার কাছ থেকে টাকা নিলাম। সিনেমা দেখা শেষে যখন বাইরে বের হলাম তখন বেশ রাত। বাড়ীর সবাই টের পেয়ে যাবে এই ভয়ে শর্টকাট পথ ধরে আসতে গিয়ে এক্সিডেণ্ট করে খাদে চলে গিয়েছিলাম। কোন ক্ষতি সেদিন আমার হয়নি। কারণ তখনও শাবনুর আর রিয়াজের সংলাপ গুলো মাথার মধ্যে দারুন উত্তেজনা সৃষ্টি করে চলেছিল।
তবে আশার কথা এই, রিয়াজ আবার আমাদের মাঝে আসছেন এটা আমার ও আমাদের জন্য একটি ভেরী গুড নিউজ বলেই আমি মনে করি। আশা নয় বিশ্বাস, আমরা রিয়াজ ভক্ত যারা আছি তারা নিশ্চয় সিনেমা হলে গিয়ে আবার সিনেমা দেখবো। অবশেষে রিয়াজ ভাইয়ের প্রতি সাধারণ দর্শকদের প্রতিনিধি হয়ে অনুরোধ, শুধু ভাল গল্প দিয়ে সিনেমা বা ভাল অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মন ভোলানোর পাশাপাশি সিনেমা হলগুলোর মান কিভাবে ভাল করা যায় সেদিকে নজর দিবেন। তাহলে দেখবেন আমাদের ঢাকাই চলচ্চিত্র আবার তার অতীত মর্যাদা ফিরে পেয়েছে। দর্শক আবার সিনেমা হলে ফেরত যাক সিনেমা উপভোগ করুক, সেই প্রচেষ্টা যেন সবার মাঝে থাকে। যেন গর্ব করে বলতে পারি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।