Select Page

বাজবে না আর মেঘমল্লার

বাজবে না আর মেঘমল্লার

জাহিদুর রহিম অঞ্জন। প্রিয় অঞ্জনদা আর নেই, অপৃথিবীর কেউ হয়ে গেছেন, এই কথা ভাবলেই কেমন এক শূন্যতা আর হাহাকার গ্রাস করছে আমাকে।

ওই অর্থে যোগাযোগ ছিল না বলতে গেলে। আলাপও ছিল সামান্যই। ওইটুকুতেই অঞ্জনদা বলেই ডাকতাম। ২০১৪ সালের আগে কেবল নামটাই জানতাম, যেহেতু আমার সিনেমা বিষয়ে আগ্রহ ছিল, আর তিনি শর্ট ফিল্ম আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন।

আমি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করতাম। একদিন আমাকে একটা লোগো বানাতে হলো, বেঙ্গলের নতুন একটা উইং ‘বেঙ্গল ক্রিয়েশন’-এর। কদিন পর জানলাম বেঙ্গল ক্রিয়েশন একটা সিনেমা বানাচ্ছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্প নিয়ে। যেহেতু ইলিয়াস আমার প্রিয় লেখক, আর গল্পটাও আমার প্রিয়। আমি কৌতূহলের বশে খোঁজ খবর করে ফেললাম। যা খবর জানলাম সিনেমার নাম ‘মেঘমল্লার’, পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন। সরকারি অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু ওই অনুদানের টাকায় এই সিনেমা বানানো সম্ভব নয় বলেই বেঙ্গল বাকি অর্থায়ন করছে।

তবে আমার জন্যে চমকে যাবার মতো খবর ছিল জাহিদুর রহিম অঞ্জন ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে মনি কাউলের ছাত্র ছিলেন। এই খবরটাই ছিল অঞ্জনদার প্রতি আমার আগ্রহের মূল কারণ। মনি কাউল আমার প্রিয় ফিল্মমেইকারদের একজন। ফলে তার অন্তত ৫টা সিনেমা আমি আমার ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই দেখে ফেলেছিলাম যে কটা পেয়েছিলাম। এই যে শুরুতে মনি কাউলের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তাও তার সিনেমা দেখে নয়, এর কারণ ছিল ঋত্বিক ঘটক।

যাইহোক, অঞ্জনদার কথায় চলে আসি। তার প্রথম সিনেমা ‘মেঘমল্লার’। এই সিনেমার সঙ্গে আমিও খানিকটা যুক্ত ছিলাম, বেঙ্গলে কাজের সূত্রে। শুরুতে সিনেমার পোস্টার, কয়েকটা হোল্ডিং সহ কিছু গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ আমাকে করতে হয়েছিল। সেইসবও বিষয় নয়। আমার জন্যে আনন্দের আর সম্মানের বিষয় ছিল এই সিনেমা আমি মুক্তি পাবার আগে এডিটিং প্যালেনেই কিছু অংশ দেখেছিলাম। তার পরে প্রিমিয়ারে পুরো সিনেমা।

রাশেদভাই মানে ফিল্মমেইকার এন রাশেদ চৌধুরী তখন বেঙ্গল ক্রিয়েশনের পরিচালক। তিনি আমাকে বললেন সিনেমার একটা রিভিউ লিখতে। বললাম, ‘রাশেদভাই, আমি তো রিভিউতে ভালো ভালো কথা লিখতে পারি না, আমাকে মন্দ কথাও লিখতে হয়। দেখা গেল রিভিউ পড়ে অঞ্জনদার মন খারাপ হয়ে গেল’। রাশেদভাই বললেন, ‘তুমি তোমার মতো লেখো, অঞ্জনদা কিছুই মনে করবে না’।

মেঘমল্লার সিনেমা মুক্তির পর অনেক রিভিউ বের হয়েছিল প্রথম দিকে, দেখা গেল তখন কেবল আমার রিভিউতেই নেগেটিভ অনেক কথা লিখেছিলাম, সমালোচনা করেছিলাম সিনেমার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। কিন্তু অঞ্জনদা মন খারাপ করেননি, করলেও আমার কাছে প্রকাশ করেননি, তিনি আমাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলেন, ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ১১ বছর আগে লেখা সেই রিভিউটার শেষ প্যারাটা এইখানে রাখছি –
‘সব শেষে এসে আমরা যে সিদ্ধান্তে আসি তা হলো মেঘমল্লার বাঙলা সিনেমার ইতিহাসে এমনই এক সংযোজন ও নির্মাণ যার বাহুল্যহীনতা আর নিস্তব্ধতা এমন এক সিনেমাকে আমাদের চোখের সামনে হাজির করে যার সৌন্দর্যে, কোমলতায় ঢাকা পড়ে আপাতচোখে দেখা ছোটোখাটো ত্রুটিগুলি। মেঘমল্লার বাজুক দিনমান’।

বাঙলাদেশে শিক্ষিত ফিল্মমেইকারদের সংখ্যা খুবই কম, একদম হাতে গোনা, তার মধ্যে আরও একজন চলে গেলেন। তারেক মাসুদের মৃত্যু আমাকে যেমন বেদনাহত করেছিল, অঞ্জনদার মৃত্যুও তেমনই করল।

আমার খুবই প্রিয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’। আমি ফিল্মমেইকার হলে এটা নিয়ে সিনেমা বানাতাম, এমন কথা অনেক বছর ধরে অনেকের সঙ্গেই বলেছি। কেননা অন্য কেউ বানাচ্ছে না। একবার কমল বলল যে সে বানাবে, তখন বললাম তাহলে বানাও খুবই ভালো হবে। এর মধ্যে জেনে গেলাম অঞ্জনদা চাঁদের অমাবস্যা বানাচ্ছেন, সরকারি অনুদানও পেয়েছেন। আমার কী যে আনন্দ হলো! অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি চলে গেলেন, তার চাঁদ ঢেকে গেল অমবস্যায়। মেঘমল্লার নিভে গেল।


About The Author

জন্ম ২৪ আগস্ট ১৯৮১, চকরিয়া, কক্সবাজার, বাঙলাদেশ। লেখালেখি আর ছবি আঁকাই মূল কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর। বইয়ের সংখ্যা ১৮টি।

Leave a reply