বাজার সঙ্কোচন, ছবি কমতে থাকা ও জাজ-টাইগারের দায়
অমুক ছবি ব্লকবাস্টার, তমুক ছবি ফ্লপ। ভক্তকুলের এই ভারডিক্টের কারণ খুবই স্পষ্ট, বাংলাদেশে কোনো অফিসিয়াল বক্স অফিস নেই। তাই যে যার মতো ছবিকে হিট-ফ্লপ বানাচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ করতে চাওয়া প্রযোজকরাও এই ফেসবুকীয় সার্কাস দেখে কনফিউজড, অমুক নায়ক নিলে বোধহয় ব্যবসা জমবে, তমুক নায়কের ফ্যানবেস ভালো। আবার কারো প্রচারণার ধরনে মনে হয় পার্শ্ববর্তী দেশের বাতিল সুপারস্টার ও ফ্লপ নায়কদের কোটি অর্ধ-কোটি টাকা দিয়ে কাস্ট করলে হয়তো আমার ছবি সব রেকর্ড ভেঙে গুড়িয়ে দিবে।
এর জন্য ফ্যানদের দায় যেমন, তেমনি ডিস্ট্রিবিউশন, প্রোডাকশন হাউজ ও গণমাধ্যমেরও সমান দায় রয়েছে। আজ আবধি কেউই বাংলা ছবির মার্কেটের ব্যাপারে একটা মোটামুটি ধারণা দিতে পারছে না। তাই নতুন প্রযোজকদের কাছে মার্কেটটা হয়ে যাচ্ছে আনপ্রেডিক্টেবল। কিন্তু সত্যটা হলো একটি ‘আয়নাবাজি’ ছাড়া এই মার্কেটে আন প্রেডিক্টেবল রেজাল্টের ঘটনা খুব একটা নেই। মূলত এই ধোঁয়াশা তৈরি করার পেছনে প্রোডাকশন হাউজগুলোরও হাত আছে। চলুন দেখি।
জাজ মাল্টিমিডিয়া
যৌথ প্রতারণা ও ভারতীয় অচল নায়কদের পুনর্বাসনের জন্য যতই গাল দিই না কেন, ইন্ডাস্ট্রির দুঃসময়ে এভাবে ইনভেস্ট করতে সাহস লাগে যেটা জাজের ছিল। জাজ এক কথায় প্রোডাকশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ। বাংলা ছবির বাজার সম্প্রসারণে তারাই একমাত্র জোরালো ভূমিকা রেখেছে। ভারত, কানাডা, নর্থ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশি ছবি নিয়ে যাওয়ার অনেক বিচ্ছিন্ন চেষ্টা থাকলেও পরিকল্পিত চেষ্টা ছিল কেবলমাত্র জাজের। ভারতের মার্কেটে হয়তো তারা লাগাতে পারেনি তাই একটা চাপা গুঞ্জন ও শোনা যাচ্ছে ভারত থেকে সরে আসার।
যাই হোক, তাদের আরেকটা বড় ব্যবসা হলো প্রজেক্টর ব্যবসা। হলে হলে প্রজেক্টর ভাড়ায় বড় আয় হয় তাদের। তাইতো ফ্লপের পরও একের পর এক ছবি বানাচ্ছে তারা। এতে আমাদের লাভ হলো ইন্ডাস্ট্রি কিছু ব্র্যান্ড নিউ ঝকঝকে ছবি পাচ্ছে আর কিছু দর্শক হলে আসাটা ভুলে যাচ্ছে না।
তবে নিশ্চয়ই আমি জাজ বন্দনায় বসিনি। তাই আসল কথায় আসছি। ছবিতে হারানো পয়সাটা এরা বেশ সহজভাবে প্রজেক্টর ব্যবসা দিয়ে তুলে আনছে। কিন্তু বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে নতুন প্রযোজকদের। একে তো চড়া টাকা আদায় করছে প্রজেক্টর ভাড়ায়, তার উপর নিজেদের অঙ্গার, হিরো ৪২০, রক্ত বা প্রেম কি বুঝিনির মতো ছবিকে হিট হিসেবে প্রকাশ করে এবং বাজেট বেশি করে দেখিয়ে ছোট প্রযোজকদের করছে বিভ্রান্ত। তাইতো ট্রাইপড মিডিয়া ‘পদ্ম পাতার জল’-এ ৪ কোটি টাকা ঢালে। এতে নতুন নতুন প্রযোজকরা আসছে, সর্বস্বান্ত হচ্ছে, আর একটা ছবি করেই চলে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে ডিস্ট্রিবিউশন আর প্রজেক্টর ভাড়া মিলিয়ে পকেট ফোলাচ্ছে জাজ।
টাইগার মিডিয়া
এদের ইন্ডাস্ট্রিতে আসার ক্রেডিট আমি জাজকেই দিবো। জাজের সাফল্যেই ‘দি অভি কথাচিত্র‘ নামে বাপের পুরান ব্যবসাকে ‘টাইগার মিডিয়া‘ নামে রিব্র্যান্ডিং করার সাহস পেয়েছে অভি। তারপর ঢালিউড ২৪ এর জন্যও বাহবা কুড়িয়েছে। কিন্তু আদতে সেই পোর্টাল দিয়ে হলুদ সাংবাদিকতার চুড়ান্ত নোংরামি শুরু করেছে তারা। নিজেদের ডিস্ট্রিবিউশনেরর ফিল্ম নিয়ে পঞ্চমুখ আর যৌথ-জাজ নিয়ে মিথ্যাচার ছাড়া আদতে আর কিছুই দিতে পারেনি। এদের একটি নিউজ দেখেই আমার এই পোস্টটা লিখতে বসা।
‘২০১৬-র আগের ৫০ প্রযোজকই নেই’ টাইপের নিউজ করছে তারা। এদের আচরণ জাজের বিপরীত। অনেকটা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। জাজের প্রজেক্টর ব্যবসা দেখে হিংসা হচ্ছে এই লোভেই হোক আর যে কারণেই হোক ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন প্রযোজক আনতে নিরুৎসাহিত করাটা তাদের মূল লক্ষ্য।
বাজার নিয়ে একের পর এক নেগেটিভ নিউজ প্রচার করেই যাচ্ছে। তাদের লিস্ট যদি দেখি, ধ্বনিচিত্রের কথা বলেছে যারা ২০১৫ র পর আর ইনভেস্ট করেনি। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ একটা ক্লিন ব্লকবাস্টার এ নিয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকার কথা না। মূলত এরা কোন পেশাদার ফিল্ম প্রডিউসার না। শিহাব শাহীনের সাথে সম্পর্কের খাতিরেই নামা। শিহাব শাহীন এয়ারটেলের নাটক বানানোর সময়ও ধ্বনিচিত্রের হেল্প নিতেন। তাছাড়া শোনা যাচ্ছে ধ্বনিচিত্র শীঘ্রই তাদের নতুন প্রজেক্ট আনছে।
আরেকটি হল ট্রাইপড। বাজারের ধারণা না রেখে ‘পদ্ম পাতার জলে‘ ইনভেস্টই এই মুখ ফেরানোর কারণ। অনেকদিন পর রানা সরকারের ছবি বাংলাদেশে চালাতেই কিবরিয়া ফিল্মসের ফিরে আসা। নিজেদের প্রযোজনা থেকে এরা অনেক আগেই গুটিয়ে নেয়। বাকি যাদের নাম বলা হয়েছে তাদের ছবিগুলো হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো। আর ২০১৬ তে এই প্রযোজকদের ছবি না আসার কারণগুলো তুলে এনে এবং বাজারের আকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিয়ে রিপোর্ট করতে পারতো যাতে সিঙ্গেল প্রডিউসাররা আকৃষ্ট হতো এবং গাইডলাইন পেতো।
তাহলে আমরা কোনটি গ্রহণ করবো? জাজের বাজার ফুলে যাচ্ছে না টাইগারের বাজার ধ্বসে যাচ্ছে? আমার মতে কোনটাই না। বরং অন্য কোন মাধ্যম যাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের বাইরে বাংলা ছবির জন্য ন্যূনতম ভালোবাসা আছে তারা যাতে একটা মিনিমাম আইডিয়া দেয়।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে হলে দর্শক কমে গেছে। কিন্তু কদিন আগে অনন্য মামুন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন মার্কেট ছোট হয়ে গেলেও অনলাইন রাইটস, টিভি রাইটস, মিউজিক লেবেল রাইটস ও স্পন্সরশীপ থেকে এখন আয়ের পথ বেড়েছে। তাই বলিউডের মতো শুধু হল কালেকশনকে ব্যবসা দেখিয়ে বিলাসিতার প্রবণতা ছেড়ে বরং টোটাল ইনকাম হিসেব করা শুরু করলে দেখা যাবে যে নতুন প্রযোজক আসছে, প্রতারিত হচ্ছে না, ভুইফোঁড়রা বিদায় হচ্ছে এবং মার্কেটটা উন্নত হচ্ছে।
সিনেপ্লেক্সের বাড়াতেই হবে ।