বাবা মেয়ের সম্পর্কের অসাধারণ উপস্থাপন-রানআউট
বন্দর নগরী চট্রগ্রামের রাতের শহর, ব্যস্ত রাস্তা। শত শত আলোতে মুখর নগরীর নিস্তব্ধতা ভেদ করে কয়েকটি গুলির শব্দ। নিহত পাগলা মিজান, তার লাশ কোলে নিয়ে সাহায্য চায় কিশোর (স্বজল)। কেউ না এগিয়ে এলেও যথারীতি এগিয়ে আসে পুলিশ ফোর্স। না হেল্প করতে না, তারা ধরে বেঁধে রিমান্ডে পাঠায় স্বজলকে।
ছবির শুরুটা যেভাবে করা হয়েছে তাতে অনেক অস্থির প্রকৃতির দর্শকের একঁঘেয়ে লাগবে নিশ্চিত। দীর্ঘ সময় ধরে একি লয়ের গান চলতে থাকে, পাশাপাশি প্রচারিত হতে থাকে নামের দীর্ঘ তালিকা। যেহেতু অভিনেতারা সবাই টেলিভিশন মিডিয়ার স্বভাবতই দর্শক একটা দোটানায় পড়ে যায়, এমনিতেই পোস্টারে ১৮+ কেন লেখা এটা নিয়েই জল্পনার শেষ নেই। তাই অপেক্ষা-কি ঘটতে যাচ্ছে?
পুরো গল্পটা কিশোরকে ঘিরে তৈরি করা হলেও কাহিনীর সমস্ত কলকাঠি কিন্তু জেনিথের (মৌসুমী নাগ) হাতেই থাকে। একজন সাধারন নয়টা পাঁচটার চাকুরেজীবি ছেলে কেমন করে হায়েনার রোষানলে পড়ে অন্ধকার পথে পা বাড়ায় রান আউট তারই গল্প। মৌসুমী নাগের অসাধারন গেটআপ এবং চমৎকার অভিনয় দক্ষতা দর্শককে চেয়ারে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে তা হলফ করে বলা যায়। গল্পের কথাটা যদি বলতেই হয় তাহলে এইটুকুনই বলবো তন্ময় তানসেন কখনো নকলের তকমা গায়ে মাখেননি, এখানেও ছিল এ্কদম মৌলিক গল্প। পুরো কাহিনী চিত্রায়িত হয়েছে চট্রগ্রামে দু’জন দাপুটে ব্যবসায়ীর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়ে যেখানে একজন সাধারন ছেলে কিশোরকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী বানানো হয়। আর এই কাজটাকে অনেক বেশি সহজ করে দেয় ইলেট্রনিক্স এবং প্রিন্ট মিডিয়া।
মৌসুমী নাগ অর্থাৎ জেনিথ একজন নিম্নবিত্ত ঘরের সাধারন চাকরীজীবি। জীবনের তাগিদে সে প্রতিনিয়ত ইউজ হতে থাকে। একটা সময় বিলাসী জীবনে সে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে ক্ষমতার আকর্ষন তাকে পেয়ে বসে। তাই চেয়ারম্যান তারিক আনাম এবং তার অপজিট পার্টির সাথে সমান তালে তাল মেলায়। সাথে পুলিশ ওমর সানীও থাকে সুযোগের সন্ধানে।এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে ওমর সানীকে একদম নতুন ভাবে উপস্থাপন করা হলেও কোন চরিত্রের সাথে তার কথোপকথনের বিষয় পরিষ্কার ছিল না। ছবির কোন জায়গাতেই ব্যবসায়িক আলোচনাগুলো খুব বেশি পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা হয়নি,দর্শক তার মেধা দিয়ে এবং মিউজিক শুনে শুনে বুঝে নিয়েছে মুল কাহিনী।
এবার একটু পোস্টার নিয়ে কিছু বলি। এইযে সারা দেশে একটি উদলা মহিলার পোস্টার দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হলো এটা কেন? এই প্রশ্ন আমার পরিচালকের কাছে, কারন তিনিই জানেন তার সন্তানকে কিভাবে পরিচিত করিয়ে দেবেন। নায়লা নাইমকে সাক্ষা্ত মাটির মূর্তি ছাড়া এর বাইরে কিছু বলা চলে না। আইটেম সং দেখবো অথচ শরীরের কোন অংশ দুলে উঠবে না এইটা কেমন কথা। নারী বা পুরুষ এমন কেউ কি আছে যে আইটেম সং শুনে গুন গুন করে না, বম্বের নায়িকারা তো কেবলমাত্র আইটেম সং করার জন্য মুখিয়ে থাকে। যদি আইটেমি রাখতে হয় তাহলে সেই আইটেমের চোখে মুখে কিছু আইটেম মানে অভিব্যক্তি রাখা দরকার।শুধুমাত্র নারী মূর্তির স্তনের বা নিতম্বের উপর কৃত্তিম ঝর্না ঢাললেই আইটেম গার্ল হয় না। আর এমন ফালতু একটা দৃশ্য রাখার কোন প্রয়োজনই ছিল না এই ছবিতে।
আমার চোখে এই ছবির সেরা দৃশ্য-কিশোরের খোলা পিঠে ঘুমন্ত রাফার (জেনিথের মেয়ে) মুখ।পৃথিবীর সমস্ত বাচ্চাদের আছে বাবা মায়ের জন্যে এক অজানা আকাঙ্খা। জেনিথ জানে না –এই বাচ্চা আসলে কার। রাফা জানে না –কে তার বাবা। তবু কিশোরের কাছ থেকে যে ভালোবাসা সে পায় তা এসেছে স্বর্গ থেকে, তাকেই সে বাবা বলে ডেকে উঠে ছবির একদম শেষে। একজন পরিচালকের কারিশমা ফুটে উঠে তখন-কোন দর্শক প্রস্তুত ছিল না কি হতে যাচ্ছে। কিশোর বাবা ডাক শোন মাত্র তারিক আনামের ধাক্কায় উপর থেকে পড়ে গেল আর স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো হল রুম। যারা এতোক্ষন চলে যাবার জন্য উদ্যত ছিল তাদের পায়ে কে যেন শেকল পড়িয়ে দিল। সবার চোখ তখন পর্দায়। ট্রলিতে কিশোরের লাশ নেওয়া হচ্ছে, জেনিথের চোখে জল আর রাফসা হাত বাড়িয়ে দিল কিশোরের হাত ছোঁয়ার জন্য।
যারা কেবল মার্কেটিঙ্গের জন্য এমন সব পোস্টার বানায় তারা ছবির এই দৃশ্যটা কাজে লাগিয়ে অভুতপূর্ব সাড়া পেতে পারতো। কিন্তু ব্যবসায়িক মন কিযে চায় কে জানে। মৌসুমী নাগ খুব ইম্পর্টেন্ট একটি চরিত্র ,কিন্তু প্রোম বা পোস্টার কোথাও তার সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা নেই। নারীর নগ্ন ছবি যতোটা ছাপাতে আগ্রহী মিডিয়া ততোটা আগ্রহী নয় তার সাফল্যের গুন গাইতে। এ এক আশ্চর্য হীনমন্যতা।
পরিশেষে কিছু অসংলগ্ন দৃশ্যের বিষয়টা বলতেই হয়। স্বর্না এমনিতেই স্বজলের চাইতে বয়সে বড়, আর স্ক্রীনে এই জুটিকে ভীষন রকম বেমানান লেগেছে। বিশেষ করে বাটালি হীলে কিশোরের সাথে দেখা করতে গিয়ে তার মা সম্পর্কে কোন তথ্য না দেওয়া, হুট করে পালিয়ে যাওয়া আবার সুস্বজ্জিত জামা কাপড় পড়ে ডলাডলি। আর একটা দৃশ্য ছিল তারিক আনামের সাথে মৌসুমী নাগের যেটা একদম অপ্রাসংগিক লেগেছে। কারো চার মাসের প্রেগনেনসীর খবর দেবার জন্য এমন করে বিছানা গরম করার দৃশ্য করা হলো কেন বুঝতে পারিনি। হয়তো ওই ১৮ প্লাসকে সার্টিফিকেট দেবার জন্য।
পরিশেষে, পদ্ম পাতার জল দেখতে দেখতে যেমন চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি, তেমনি রাআউট অর্থাৎ জীবন যুদ্ধে একজন পরাজিত সৈনিককে এভাবে রাফাকে ফেলে চলে যেতে দেখে চোখের জল আটকাতে পারিনি। তন্ময় তানসেন আপনি সফল, এবার পোস্টারগুলো মার্জিত করে বাকী সফলতার স্বর্ন মুকুট মাথায় পড়ুন-এইটুকুনই চাওয়া।