‘বিউটি সার্কাস’ – রক্তের ইতিহাসের সাক্ষ্য
‘বিউটি সার্কাস’-এর গল্প না বিউটির, না সার্কাসের। এটি সার্কাসের আলোকদীপ্ত ও সুকুমার প্রদর্শনীর আড়ালে এক রক্তের ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। মাহমুদ দিদার বিশাল ক্যানভাসে সার্কাসের অদ্ভুত এই পেশা ও বিচিত্র লুকের অন্তরালে তুলে ধরেছেন ক্ষমতাধরদের আসল চরিত্র।
‘বিউটি সার্কাস’ দলের মালকিন ও প্রধান পারফরমার বিউটি। সে তার দলে নিয়ে বানিয়াশান্তা নামে এক শান্তিপ্রিয় গ্রামে পারফর্ম করতে যায়। তার রূপে ও জাদু প্রদর্শনীর গুণে দিওয়ানা গ্রামের তিনজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। পুরুষের ভূমিকাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই দেখানো হয়েছে। তিনজনের মধ্যে দুই জন তাকে নিজের করে পেতে চাইলেও বাকি একজন তার শুভাকাঙ্ক্ষী। বিউটি এই গ্রামে সার্কাসের দল নিয়ে আসলেও তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। সেই উদ্দেশ্য জানতে পারলে তার দলকে ধর্মের দোহাই দিয়ে গ্রামছাড়া করতে ওঠে পড়ে একটি মহল। এই বিপদে তার রূপে মোহাবিষ্ট পুরুষদের কাউকে সুযোগসন্ধানী, কাউকে অসহযোগিতামূলক ও কাউকে সাহায্যের হাত বাড়াতে দেখা যায়। বিউটি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কীভাবে এই বিপদ মোকাবেলা করবে সেটাই ওঠে আসে এই ছবিতে।
সার্কাস দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। গ্রাম বাংলায় এক সময় বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই সার্কাস। নানা কারণে এই ঐতিহ্য তার গতি হারিয়েছে। সেই হারানো ঐতিহ্যকে মাহমুদ দিদার একজন শিল্পীর চোখে পর্দায় দেখিয়েছেন। প্রতিটি সার্কাস শিল্পীকে তাদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। সার্কাসের দৃশ্যগুলো দর্শকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, বিউটির সংগ্রাম অন্তর্বেদনা জাগায়।
বিউটি চরিত্রে জয়া আহসান এই ছবির প্রাণ। তিনি একই সাথে লাস্যময়ী, তার দলের প্রতিটি সদস্যের প্রতি যত্নশীল, এবং প্রতিশোধপরায়ণ। তিনি একই সাথে নমনীয় এবং তার লক্ষ্যে অবিচল। তার সৌন্দর্য ও অভিব্যক্তি দুই’ই এই গল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জয়ার পাশাপাশি যিনি ছবিটিতে দর্শককে ধরে রাখতে পেরেছেন তিনি রঙ্গলাল চরিত্রে অভিনয় করা এবিএম সুমন। জয়ার পাশে তার সাবলীল উপস্থিতি ও নির্ভরযোগ্য অভিনয় যৌথ আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্রের মধ্যে তৌকীর আহমেদ ও ফেরদৌসের অভিনয় আপ-টু-দ্য-মার্ক নয়। তৌকীরের চরিত্রে কিছুটা কমিক রিলিফ থাকলেও দুজনেই অতি-অভিনয় ও গল্পের যে গতি তার তুলনায় লাউড অভিনয় এবং লিপ সিংক ঠিক-ঠাক না হওয়া বিরক্তির উদ্রেক করে। গাজী রাকায়েতের ছদ্মবেশী চরিত্র ও তার চোখের ভাষা তাকে ভয়ানক করে তুলে। ঘোষক স্যাম চরিত্রে প্রয়াত হুমায়ুন সাধু যতটা স্পেস পেয়েছেন, তার যথার্থতা বজায় রেখেছেন।
নাটক নির্মাণ থেকে চলচ্চিত্রে যেসব নির্মাতারা আসেন তারা বেশিরভাগই চলচ্চিত্রকে ধীর-গতির ও নাটুকে করে তোলেন। মাহমুদ দিদার এই বৃত্তের বাইরে। তার এই চলচ্চিত্রে গতিময়তা রয়েছে। তিনি একই সাথে একাধিক ইস্যু নিয়ে ডিল করেছেন – সার্কাস, ধর্ম ও একাত্তর। সার্কাসের জনপ্রিয়তা তুলে ধরা হয় হাজার-হাজার লোকের ঢল দেখানোর মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে একটি মহল সার্কাসের নামে অশ্লীলতা ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তুলে যা ধর্মের পরিপন্থি বলে সার্কাসের তাবুতে আগুন ধরায়, বাউলের চুলে কেটে দেয় যা সম্প্রতি বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের শিষ্য ও বাউল গায়ক রণেশ ঠাকুরের বাউল গানের ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার সাথে প্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি দেখিয়েছেন একাত্তরের অশুভশক্তিরা এখনও ছদ্মবেশে আমাদের আশেপাশেই লুকিয়ে আছে এবং ধর্মের নাম দিয়ে সাধারণ শ্রেণির মগজধোলাই করছে।
সর্বোপরি, বিউটি সার্কাসে বিচিত্র মানুষ, অদ্ভুত জাদুর ব্যবহার, ছন্দ ও গতিময়তা রয়েছে। দর্শক হিসেবে আপনি যেখান থেকেই এটি দেখা শুরু করেন আপনি গল্পে ঢুকে যাবেন। মনে হবে যেন আপনি কোন সার্কাসের প্যান্ডেলে ঢুকে গেছেন। বিরতির পর তাড়াহুড়া করে শেষ করে দেওয়ার ছাপ স্পষ্ট হলেও ‘বিউটি সার্কাস’ একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প বলতে সক্ষম হয়েছে।
রেটিংঃ