Select Page

রিভিউ: ঊনলৌকিক

রিভিউ: ঊনলৌকিক

শিবব্রত বর্মনের গল্প অবলম্বনে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির জন্য ‘ঊনলৌকিক’ তৈরি করেছেন রবিউল আলম রবি। পাঁচটি গল্প নিয়ে পাঁচ পর্বে সাজানো হয়েছে সিরিজটি। পর্ব ভিত্তিক রিভিউ থেকে ধারণা নিতে পারেন পুরো সিরিজের।

মরিবার হলো তার স্বাদ

বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিস‌অর্ডার (বিপিডি) এমন একটা মানসিক রোগ যা ব্যক্তির আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। সম্পর্ক না টেকাতে পারা বা অস্থির মানসিকতাও এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। 

এই রোগে নির্দিষ্ট আমি বোধটাই গড়ে ওঠে না। এর ফলে ব্যক্তি বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য একেক রকম ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময়ই রোগীর অনিয়ন্ত্রিত আবেগ দেখে লোকে তাকে ভুল বোঝে।

‘মরিবার হলো তার স্বাদ’ না ‘সাধ’ নয় কিন্তু। রবিউল আলম রবির ‘ঊনলৌকিক’ সিরিজের প্রথম পর্ব এটি। জনরা অবশ্যই সাইকোথ্রিলার। বিপিডিতে আক্রান্ত রোগীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোস্তফা মনোয়ার। সাংসারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে চরম অস্থিরতায় ভোগা এই রোগী আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন ডিসঅর্ডারের কারণে। অনেক সেশন নিয়েও সাইকিয়াট্রিস্ট (গাজী রাকায়েত) তাকে স্বাভাবিক জীবনে আনতে পারছেন না। এরপর তিনি রেফারেন্স দেন আরেক রেস্টুরেন্ট হোল্ডারের (সুমন আনোয়ার) যিনি কিনা এই ধরনের আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীদের জন্য আয়োজন করেন এক ‘মরণখেলা’!

গল্প খুব ফাস্ট মুডে ছিল। শিবব্রত বর্মনের গল্পকে রবি আর শাওকী ভালো স্ক্রিপ্টে এনে দাঁড় করেছেন। পারফরমেন্স বলতে মোস্তফা মনোয়ার ভালো তবে ডায়ালগ ডেলিভারি খুব রোবটিক লাগলো। ডাবিংও খুব আর্টিফিশিয়াল! বাকিরা স্পেস অনুযায়ী দারুণ।

ডোন্ট রাইট মি

সোহেল মন্ডল মঞ্চের মানুষ। তাকে ঠিকঠাক চরিত্র আর স্পেস দিলে তিনি কত সাবলীল অভিনয় করেন সেটি আবারো প্রমাণিত হলো। ‘ঊনলৌকিক’ সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব ‘ডোন্ট রাইট মি’তে।

আমির হোসেন সাতক্ষীরার মকছেদপুরের ছেলে। ভালোবাসে রোকেয়াকে। তাকে বিয়ে করে সংসার করতে চায়। কিন্তু জীবনে নেমে আসে সংকট। তাকে চলে আসতে হয় ঢাকায়। কাজ নেয় একটা ফটোকপি দোকানে। একদিন ফটোকপি করতে গিয়ে চোখে পড়ে পুরোনো ম্যাগাজিনের একটি গল্পে। নাম ‘আমিরের দিনরাত্রি’। আমির টের পায় এই গল্পের সবটাই হুবহু মিলে গেছে তার জীবনের সঙ্গে। আমির লেখকের খোঁজ করে যেন বাকি গল্পটা জানতে পারে সে। একদিন খোঁজ পায় সে লেখক ডা. ফরহাদের। বাকিটা সারপ্রাইজিং ও ইন্টারেস্টিং!

শিবব্রত বর্মনের এই গল্পটির বাস্তবতা মিল খুব কম হলেও অসম্ভব না। একজন লেখকের চরিত্র জীবন্ত হয়ে সামনে আসা, নিজের জীবন লেখককে দিয়ে লেখানো, জীবনের মতোই কাগজে লেখা গল্পকে বিশ্বাস করা অবাক করা ব্যাপার তবে অচিন্তনীয় না। মেকিং ও ক্যামেরার কাজ দারুণ ছিল।

সোহেল মণ্ডল আবারো ফাটিয়ে দিয়েছেন। মাত্র পঁচিশ মিনিটেও গল্প জমিয়ে ফেলা চমৎকার ব্যাপার। আসাদুজ্জামান নুর এই বয়সেও দারুণ এক্সপ্রেশন দেন তবে অভিনয়ে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। নুর এবং সোহেলের ফেস অফ অ্যাক্ট এবং ডায়ালগ দেখার মতো ছিল। ফারহানা হামিদ তার স্পেস অনুসারে ঠিকঠাক।

মিসেস প্রহেলিকা

নিঃসন্দেহে ‘মিসেস প্রহেলিকা’ শুধু এই সিরিজের না, চরকির মুক্তিপ্রাপ্ত সকল দেশি কনটেন্টের মাঝে সবচেয়ে ‘মাথা ঘুরিয়ে’ দেওয়া গল্প।

সাইকিয়াট্রিস্ট এম. আলীর চেম্বারে শেষ রোগী হুমায়রা। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী যখন সিনেমা হলে ‘দেবী’ সিনেমা দেখতে টিকিট কেটে অপেক্ষা করছেন তখন এই রোগী তাকে বেশ জটিলতায় ফেলে দেয়। রোগীর ধারণা তিনি স্বপ্ন দেখেন না। না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় না। আসলে তিনি ঘুমানই না। আরও প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বের হলো তিনি আসলে ঘুমিয়েই আছেন এবং স্বপ্নের মাঝেই আছেন বলে তার ঘুমানোর দরকার হয় না। এম. আলী তার রোগের সূচনা বিশদভাবে শুনে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন হুমায়রা আসলে স্মৃতিভ্রম রোগে ভুগছেন। হুমায়রা কি সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারবে নাকি ডাক্তার নিজেই হুমায়রার এই জটিলতায় চমকে যাবেন?

এর আগে ‘মরিবার হলো তার স্বাদে’ সাইকো থ্রিলিং ও ‘ডোন্ট রাইট মি’ তে ফ্যান্টাসির সঙ্গে সাসপেন্সের আবহ থাকলেও ‘মিসেস প্রহেলিকা’ পুরোপুরি প্যারানরমাল সাইকো মিক্সআপ জনরার। এতে আবার বিজ্ঞান ও কল্পনার যুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে শেষটায় রেখে দেওয়া হয়েছে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো। এই ধরনের গল্প আমরা ক্রিস্টোফার নোলানকে দেখি থিম হিসেবে কাজ করতে।

চঞ্চল আর তিশার পারফরমেন্স নিয়ে শুধু একটা কথাই বলব, এত লো ভয়েস আর সেম সেটে পুরো তেইশ মিনিট শুধু তারা তাদের ডায়ালগেই আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। রবিউল আলম রবিকে আবারও ধন্যবাদ থ্রিলার প্রেমীদের প্রতি সপ্তাহে এমনভাবে ভাবনার খোরাক জোগানোর জন্য।

হ্যালো লেডিজ

‘ঊনলৌকিক’ ওয়েব সিরিজটা প্রশংসিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাপ্তাহিকভাবে বের হওয়া প্রতিটি অ্যাপিসোড একটা স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করছে। কোনটা হয়তো সাইকোথ্রিলার, কোনটা ফ্যান্টাসির সঙ্গে সাসপেন্স আর কোনটা পুরো মাথা আউলিয়ে দেওয়ার মতো প্যারানরমাল।

পর্ব চারে আমরা দেখছি সাদা কালো কালার টোনে একেবারে ভিন্ন একটা সাসপেন্স ড্রামা। ‘হ্যালো লেডিজ’ নারীদের অংশগ্রহণে হওয়া একটি টিভি রিয়্যালিটি শো। এই অনুষ্ঠানে শুধু নারীরা অংশই নেয় না, তারা নিজের বাড়ির ছাদে পুরো টিমকে আমন্ত্রণ করে আয়োজনও করে। শোর হোস্ট হচ্ছেন সিসিলি যার আবার একটা এক্সট্রা ইনট্যুশন পাওয়ার আছে যে, প্রোগ্রাম ধারণ করার ক্যামেরায় তিনি প্রায়ই বাসাবাড়িতে নারীদের প্রতি ভায়োলেন্স হওয়াটা দেখতে পান। ঘটনাক্রমে একটি বাসায় একজন মধ্যবয়সী স্বামী রাগের বশে মার্ডার করে ফেলেন তার স্ত্রীকে। অতি আশ্চর্যজনকভাবে খুন করার পর স্বামী দেখে, টিভিতে প্রচারিত ‘হ্যালো লেডিজ’ অনুষ্ঠান থেকে এক দৃষ্টিতে খুনের ঘটনাটা দেখছে সিসিলি।

চারটি পর্বের মধ্য এটি সবচেয়ে স্লো তবে সর্বোচ্চ মাত্রায় এক্সপেরিমেন্টাল। এখানে ক্যামেরা, পারফরমেন্স, গল্পের প্লট, কালার এমনকি স্ক্রিনপ্লে নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে বেশ। সাদা-কালো করে প্রেজেন্ট করার একটা মেটাফোরিক ব্যাপার থাকতে পারে নির্মাতা রবিউল আলম রবির। কেন না আমাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া অনেক নারী সহিংসতা আমরা দেখেও দেখি না, প্রতিবাদ করি না। সেই সব বর্ণহীন নির্যাতিতা নারীর জীবনের সঙ্গে স্ক্রিনে কালার সাদৃশ্য রাখা হতে পারে। তা ছাড়া ক্যামেরার দারুণ কিছু লং শট, ক্লোজ শট আছে যা গল্পের ধীরতার সঙ্গে দর্শককে এক করে ফেলে।

পারফরমেন্স বিচারে ‘হ্যালো লেডিজ’ ইরেশ যাকেরের ওয়ান ম্যান শো মনে হয়েছে। এত শান্ত, ধীর, ইমোশনাল ও ক্ষুব্ধ এক্সপ্রেশনের ব্লেন্ডিং অনেক দিন ধরে অনেকের মাঝেই দেখি না। অন্তত এই পারদর্শিতায় ইরেশকে আমার ‘আন্ডাররেটেড’ লাগে। তবে শেষ দৃশ্যে মিথিলার এক্সপ্রেশন মাস্ট ওয়াচ। সাহানা রহমান সুমি একটি দৃশ্যে ছিলেন, ভালো করেছেন।

অ্যাপিসোডের একমাত্র দুর্বল দিক এর স্লো স্ক্রিনপ্লে, যদিও এই গল্পের জন্য দরকার ছিল। অনেকের কাছে কালার টোনটাও অস্বস্তিজনক লাগতে পারে। তবে ওভারঅল পর্বটা একটা ভিন্ন স্বাদ আনবে।

দ্বিখণ্ডিত

শিবব্র‍ত বর্মণের ‘বানিয়ালুলু’ বইয়ের গল্প ‘দ্বিখণ্ডিত’কে পুরোপুরি সার্থকভাবে চিত্রায়ণ করা হলো ’ঊনলৌকিক’ সিরিজের শেষ পর্বে। পাঁচ পর্বের মধ্যে পারফরমেন্স বিচারে এটি ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং সেটাই দারুণভাবে করতে সক্ষম হলেন ইন্তেখাব দিনার।

থানার ব্যস্ততম এসআই’র টেবিলে দুপুরবেলা হাজির তথ্য মন্ত্রণালয়ের ক্লার্ক মোস্তাক। সে গল্প শোনানোর নাম করে একের পর এক বিভিন্ন সত্য ঘটনা কিংবা আজব খবর জানাতে থাকে এসআই’কে। সেগুলোর মধ্যে কোনটা এভারেস্টের হিলারি স্টেপস উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে মতান্তর, দেশভাগের সময়কার একটি আলোচিত ফটোগ্রাফের সত্যতা নিয়ে দ্বিধা, আবার কোনটা কোন এক মন্ত্রীর একই সময় দুই জায়গায় অবস্থান নিয়ে নীরবতা। তবে এসব ঘটনা বলার আগে সে এসআই’কে বলে নেয় এর সঙ্গে তার আজকে এখানে আসাটা সম্পর্কযুক্ত।সেই সম্পর্কটা জানতে হলে দর্শককে দেখতে হবে চব্বিশ মিনিটের এই পর্বটি।

শুরুতে যেটা বললাম, পারফরমেন্স এর দিক থেকে আমার মতে ইন্তেখাব দিনার এই সিরিজে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। শুধু টানা পাঁচ মিনিটের ওয়ানশট টেকে অনর্গল একটানা ডায়ালগ বলে যাওয়া কিংবা মৌখিক এক্সপ্রেশনই না, দিনারের ডেডিকেশন আপনাকে বাধ্য করবে সামনে বসা এসআই’কে ভুলে যেতে। এমনও মনে হচ্ছিলো হয়তো তার সামনে বসা কাউকে দেখানোই হবে না বা খুব একটা দরকারও নেই। এক কথায়, ‘দ্বিখণ্ডিত’ ছিল ইন্তেখাব দিনারের ‘ওয়ান ম্যান শো’। এ ছাড়া শুরুতেই মাইক্রোতে বসা লোকগুলোর অরগানিক ডায়ালগগুলো দারুণ উপভোগ্য ছিল।

নেগেটিভ দিক একটাই, টানা চরিত্রের বলে যাওয়াটা গল্পে পড়তে যতটা ভালো লাগে, দেখতে হয়তোবা ততটা না লেগে জ্যাম লাগতে পারে। তবে গল্প পড়া থাকলে বিষয়টা সহজেই বোঝা যায়, নির্মাতা একচুলও সরেননি বা চরিত্রে ছাড় দেননি।

থানার সেটআপ, গাড়িতে চিত্রায়ণ আর ক্লাইম্যাক্স মিউজিক সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। রবিউল আলম রবির নির্মাণে দেখতে পারেন প্যারানরমাল জগতের আবছা আলোর ধারণায় ‘দ্বিখণ্ডিত’।


মন্তব্য করুন