বিনোদন জগতের মানুষেরা কেমন ‘রিভিউ’ চান?
বাংলাদেশের নাটক-সিনেমা নিয়ে রিভিউ বা শিল্প সমালোচনার সমালোচনা কম নয়। এমনিতে পেশাদার সমালোচক কম, মোটের ওপর অল্প কিছু সাংবাদিক, দর্শকদের উৎসাহী গোষ্ঠী ও শোবিজের সঙ্গে জড়িত অনেককে আলোচিত কনটেন্ট নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়।
তবে সবসময় সংশ্লিষ্টরা এ সব প্রতিক্রিয়ায় সহনশীলতা দেখান এমন না— অনেক সময় নির্মাতা বা অভিনেতাদের দেখা যায় লেখকদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়াতে। অনেকে তো বলেই দেন যেন প্রথম দু-এক সপ্তাহ কেউ যেন ‘নেগেটিভ’ রিভিউ না দেন। তারা আসলে কী চান?
এ প্রশ্নের উত্তর জটিল ও মতামত সংগ্রহ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বটে। তবে খানিকটা ধারণা দেওয়ার জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকীর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে।
নিজের ফেসবুকে সম্প্রতি অভিনেত্রী লেখেন, “নেটফ্লিক্সে “হাসিন দিলরুবা” নামে সিনেমাটি বাংলাদেশের টপ চার্ট-এ ১ নম্বরে আছে.. আমরা দেখছি এবং ‘দারুণ’ ‘সুপার’ ‘অসাধারণ’ বিশেষণ ব্যবহার করছি..
কেউ কী একবারও এই সিনেমাটায় এটা নেই, ওটা নেই প্রশ্ন তুলছি..?? কিন্তু চাইলেই কিছু কিছু জায়গায় প্রশ্ন আসে মনে.. যেমন-
– রাণী (তাপসী পান্নু) চরিত্রটি বিয়ের পর তার মা-মাসীর সাথে স্বামীর সাথে রাত কেমন কাটছে থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন সব শেয়ার করছে অথচ রাণীর স্বামী মারা যাবার পর এই মেয়ের বাবার বাড়ির কোন ভূমিকা চোখেই পড়ে না..
– রাণীর যে প্রেমিক তার সাথে রাণী এবং তার স্বামী এত খারাপ আচরণ করার পরও সে হুট করে একদিন রাণীর শ্বশুর বাড়িতে এলো এবং রাণী তাকে বের না করে দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে দেখা গেল..
– রাণী তার ইন্টারোগেশনের সময় বারবার একজন লেখকের নাম বললো অথচ ইনভেস্টিগেশান পুলিশ অফিসার সেই লেখকের বইটা পড়ার প্রয়োজনই বোধ করলো না.. আবার সেই অফিসার বদলি হয়ে চাকরিস্থলে যাবার জন্য পরিবার নিয়ে রেলস্টেশানে এলো তখন উক্ত লেখকের বই দেখে পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো… এবং ঐ গল্পের পড়ার মধ্যে দিয়ে সিনেমার সবকিছু জানা গেল, সিনেমা শেষ হয়ে গেল…
এমন বেশ কিছু প্রশ্ন আছে যা নিয়ে কথা বললে চিত্রনাট্য দুর্বল মনে হবে.. সিনেমাটা তখন ‘ভুয়া’ মনে হবে.. চরিত্রগুলোকে ‘যথাযথ’ মনে হবে না.. কিন্তু এটা বলিউড প্রোডাকশান তাই ‘সব সঠিক’.. এত এত প্রশ্ন আসার পরও আমার কাছেও সিনেমাটা ভাল লেগেছে কারণ, দুর্বলতা বাদ দিয়ে আমি সিনেমাটা এনজয় করেছি..
যত বেঠিক বাংলাদেশের প্রোডাকশানে.. ‘খুঁত কতপ্রকার ও কী কী, কাহাকে বলে.. উদাহরণসহ বুঝাইয়া’ দিতে কেউ কার্পণ্য করে না..
কিন্তু.. জ্বী, একটা কিন্তু আছে.. পজিটিভ এবং নেগেটিভ দু’টো শব্দ সব কাজে শুনতে হয় এবং শুনতে হবে-এটাই স্বাভাবিক.. এখানেই কিন্তু ‘নেগেটিভ কথাগুলো আমরা কীভাবে বলছি..??’ মানে, কী কী ভাষা প্রয়োগ করে বলছি.. আমাদের ভাষা তো ‘যা তা’ ’ফালতু’ ‘ভুয়া’ ‘অখাদ্য’ ব্লা ব্লা ব্লা…
আসলে, সাধারণ দর্শক বাদ দিলাম.. মিডিয়াতে যারা সকল সেক্টরে কাজ করে তাদের অন্তত সমালোচনা করার ভাষাটা শেখা উচিত.. এতে লজ্জার কিছু নেই.. বিজনেস সেক্টরে যেমন ‘consumer behaviour’ `attitudes’ `observational learning’ এই ধরনের কিছু বিষয় শিখে, ক্রিয়েটিভ সেক্টরেও শেখা উচিত..
কারণ.. Creative Sector-এর মানুষগুলোকে তো Create করার জন্য অর্থ প্রদান করা হয়, তাই “Creative people are paid to be creative” (Paul Arden)
দর্শক বাদ, আমরা যারা মিডিয়ার মানুষ তাদের কথা বলা বা চিন্তা বা সমালোচনাও ‘শৈল্পিক’ এবং ‘যুক্তিসঙ্গত’ হওয়া উচিত.. আর নিজের দেশের কাজকে একটু বেশি ভালবেসে গঠনমূলক আলোচনা করা উচিত…”
সম্প্রতি ‘মরীচিকা’ ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে প্রশংসিত এ অভিনেত্রীর পোস্টে অনেকেই সহমত জানিয়েছেন। যেমন; অভিনেতা ডোমিনিক গোমেজ লেখেন, “খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছিস। ভাল লাগলে। তবে…. ‘শিল্প সমালোচক’ – আলাদা একটা পেশা, যাঁরা সার্বিকভাবে অনেক মেধা সম্পন্ন হয়ে থাকে। আবার মেধা থাকলেই সবাই শিল্প সমালোচক হতে পারে না।হয়তো তোর লেখা তাঁদের উদ্দেশ্যে। অন্যদের কথা ধরতে নেই।”
‘দেশের কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনা করবেন না’— নিজের মন্তব্যে এমনটা উল্লেখ করেন সাংবাদিক মাহমুদ মানজুর।
তার মতে, “শৈল্পিক ও যৌক্তিক দুইটাই ফাঁকিবাজি শব্দ। এগুলা প্রতিটি মানুষের কাছে আলাদা বার্তা বহন করে।
বরং এটা বলা উত্তম- দেশের কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনা করবেন না প্লিজ।
হাসিন সাবজেক্ট হিসেবে ভালো, বাট কনটেন্ট হিসেবে মহা দুর্বল লেগেছে মোর কাছে।
শুভসকাল প্রিয়ে নাজনীন আপা।”
অন্য দিকে নিজের ফেসবুক ওয়ালে নাম উল্লেখ না করে সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান লেখেন, “প্রিয় অভিনেত্রী জানতে চেয়েছেন, কেন আমরা ‘হাসিন দিলরুবা’র ভুলগুলো নিয়ে কথা বলছি না, কেন দেশি কন্টেন্টের ভুল ধরছি। আমরা জানতে চাই, ‘হাসিন দিলরুবা’র ভুল ধরলে কি ওই ছবির নির্মাতা, পারফর্মার, প্রযোজকরা জানতে পারবেন? আমরা বিনোদনের জন্য ‘হাসিন দিলরুবা’র মতো ছবি দেখি, সমালোচনার মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাজের মান উন্নয়নের কথা ভাবি না। আর সত্যি কথা হচ্ছে, তাপসী পান্নু পর্দায় এলে আর গল্পের, চিত্রনাট্যের, নির্মাণের ভুলের কথা মাথায় থাকে না। আমাদের এমন অভিনেত্রী কই যাকে দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে, ছবির ভুল ধরার আর খেয়াল থাকে না!”