বিরল প্রতিভা সুভাষ দত্ত
সিনেমার এমন শাখা কমই আছে, যে দায়িত্ব পালন করেননি সুভাষ দত্ত। শুরু করেছিলেন পোস্টার-ব্যানার দিয়ে, পরে একাধারে অভিনেতা, পরিচালক-প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও শিল্পনির্দেশক হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রতিভা চেনার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, তার হাত ধরেই এসেছে অনেক সুপারস্টার।
বাংলাদেশের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম সুভাষ দত্ত। গল্পনির্ভর সামাজিক ছবি নির্মাণে তিনি ছিলেন সমাদৃত ও প্রশংসিত।
সুভাষ দত্তের জন্ম ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায় মামা বাড়িতে। তবে পৈতৃক বাসস্থান ছিল বগুড়া জেলার চকরতি গ্রামে। ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকায় মারা যান তিনি।
ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি তার আগ্রহ। তাই নির্মাণ কৌশল শিখতে ভারতের বোম্বেতে গিয়ে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে একটি পাবলিসিটির স্টুডিওতে কাজ শুরু করেন সুভাষ দত্ত। ১৯৫৩ সালে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে এসে যোগ দেন প্রচার সংস্থা এভারগ্রিনে।
১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ দেশের প্রথম বাংলা সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর স্লাইড ও বুকলেট ডিজাইনের কাজ করেছেন সুভাষ দত্ত।
এর তিন বছর পর প্রথমবার পর্দায় তার মুখ দেখা যায়। ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন সুভাষ দত্ত।
১৯৬৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সুভাষ দত্ত। এই ছবিতে নায়ক হিসেবে তিনি নিজে অভিনয় করেন এবং নায়িকা হিসেবে সুযোগ দেন কবরীকে।
সুভাষ দত্তকে বলা হয় তারকাশিল্পী গড়ার কারিগর। কবরী ছাড়াও তার হাত ধরে এসেছেন অনেকেই, যাদের বেশিরভাগই চলচ্চিত্রে পেয়েছেন স্থায়ী আসন। এ তালিকায় আছেন সুচন্দা, শর্মিলী আহমেদ, উজ্জল, ইলিয়াস কাঞ্চন, খান জয়নুল ও বেবী জামান। এ ছাড়া তার সাথে কাজ করেছেন, এমন অনেকেই পরবর্তীতে হয়েছে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক। তার হাত ধরে পর্দায় আসা কবরী, সুচন্দা ও ইলিয়াস কাঞ্চন এক সময় পরিচালনাও করেছেন।
সুভাষ দত্ত নির্মিত চলচ্চিত্র হলো— সুতরাং, আবির্ভাব, কাগজের নৌকা, আয়না ও অবশিষ্ট, পালাবদল, আলিঙ্গন, বিনিময়, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আকাঙ্ক্ষা, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, সকাল সন্ধ্যা, বলাকা মন, সোহাগ মিলন, নাজমা, সবুজসাথী, আগমন, ফুলশয্যা, সহধর্মিণী, আবদার, স্বামী-স্ত্রী এবং ও আমার ছেলে।
অভিনেতা হিসেবেও সুভাষ দত্ত ছিলেন বেশ জনপ্রিয় ও প্রশংসিত। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হলো— এ দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, সুতরাং, আবির্ভাব, ক্যায়সে কুহু, পয়সে, কলকাতা’৭১ (ভারতীয় বাংলা), নয়া মিছিল, কাগজের নৌকা, রূপবান, আখেরী স্টেশন, আয়না ও অবশিষ্ট, ফির মিলেঙ্গে হামদোনো, ভাইয়া, চল মান গায়ে, নতুন সুর, সূর্যস্নান, চান্দা, তালাশ, দুই দিগন্ত, সাগর, মিলন, কাজল, কার বউ, পিঞ্জর, নদী ও নারী, পালাবদল, বাল্যশিক্ষা, বিনিময়, আলিঙ্গন, চাষীর মেয়ে, ফুলশয্যা, আকাঙ্ক্ষা, আয়না এবং বাবা আমার বাবা।
চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। তবে কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেও বেশ প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন সুভাষ দত্ত। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি প্রচুর মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন।
চলচ্চিত্রশিল্পে তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন, নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।
১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন সুভাষ দত্ত।
এ ছাড়া মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯) ও নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৬৮) পুরস্কৃত হয়েছে তার পরিচালিত চলচ্চিত্র।
১৯৭৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কাবে তার পরিচালিত ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করে।
১৯৯৯ সালে তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
২০০৩ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয় তাকে। এছড়াও সুভাষ দত্ত দেশি-বিদেশি অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন।
ব্যক্তিজীবনে সীমা দত্তের সাথে সুভাষ দত্ত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলে শিবাজী দত্ত ও রানাজী দত্ত, মেয়ে শিল্পী দত্ত ও শতাব্দী দত্ত।
/তথ্য আজাদ আবুল কাশেম ও ছবি ফিরোজ এম হাসান