বীরাঙ্গনার শিল্পিত উপস্থাপন
২০১৯ সালের শেষ ছবি ‘মায়া : দ্য লস্ট মাদার‘ মানসম্মত ও শিল্পসম্মত হলো এটা এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো ঘটনা। তারও চেয়ে আনন্দের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্রকর্ম ‘ওমেন’ এবং কবি কামাল চৌধুরী’-র কবিতা ‘যুদ্ধশিশু’ অবলম্বনে ছবিটি নির্মিত হয়েছে মাসুদ পথিকের পরিচালনায়। চিত্রশিল্পী ও কবিতার সমন্বিত রূপ এ ছবি।
পরিচালক মাসুদ পথিক নিজে প্রথমত একজন লেখক তারপর নির্মাতা। তাঁর লেখকসত্তা আর নির্মাতাসত্তার মধ্যে আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য তিনি দেখাতে পেরেছেন। এর আগে তাঁর নির্মিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে।
‘আমি কি তবে মানুষ!
কেবলই মাটিকে ডেকেছি ‘মা, মা’ বলে
আর প্রকৃতি আমার বাবা আবহমান’
কবিতা আর স্টিল লাইফের দৃশ্য দিয়ে ছবি শুরু হয়েছে। শুরুটা ছিল কাব্যিক উপস্থাপনে বাংলাদেশের গ্রামীণ সৌন্দর্যকে দেখা। এরপরেই ছবির গল্পে ধীরে ধীরে প্রবেশ করানো হয়েছে দর্শককে।
প্যারালাল তিনটি গল্পকে একসাথে উপস্থাপন করে একটা সেন্টার পয়েন্টে রেখে ছবির মূল স্টোরি টেলিং সাজানো হয়েছে। বীরাঙ্গনার গল্প বলাটা যে কোনো একটি চরিত্র দিয়েই শুধু দেখাতে হবে ছবিটি তা করেনি, করেছে ত্রিভুজ উপস্থাপনা। এর ফলে তিন ধরণের তিনটি আবহ ফুটে উঠেছে ছবিতে। এক বীরাঙ্গনা, যুদ্ধশিশু, আরেকজন আত্মপরিচয়সন্ধানকারী নারী। তিনজনেরই কেন্দ্রবিন্দু বীরাঙ্গনার গল্প। প্লট সাজানোর কাজটাতে দক্ষতা ছিল। তাদের তিনজনের মধ্যেও তিনটি গল্প লুকানো আছে এবং দর্শককে ছবি দেখে বুঝে নিতে হবে। ‘মায়া’ যে চরিত্র শুধু তাকে ঘিরেই ছবিটি করা যেত কিন্তু পরিচালক একাধিক গল্পকে এক গল্পে এনেছেন সম্পর্ক রেখে।
– সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দিয়েছে
– আমি ইন্টারনেটে পড়েছি
– কিন্তু কেন যেন মনে হলো দেরিতে দেয়া হয়েছে। অনেক বীরাঙ্গনা তো মারাই গেছে।
– থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে সবকিছুই একটু দেরিতে হয়। দেশে পলেটিক্যাল ইমব্যালেন্স থাকলে এসব হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এ সংলাপ বিনিময়কে সাহসী বলতেই হয়। দেশের সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেয় কিন্তু বীরাঙ্গনার মুখ থেকে সংলাপ আসে-‘তাতে আমাদের কি লাভ!’ মূলত বাস্তবতা এটাই। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় ভাঙিয়ে সুবিধা নেয় অন্য কোনো গোষ্ঠী সেই দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা বীরাঙ্গনার বাস্তবতা এটাই হচ্ছে। সরাসরি জাতীয় এ সমস্যা তুলে ধরাটা অবশ্যই নির্মাতা মাসুদ পথিকের সাহসী বক্তব্য।
– কিসের কথা কয় ওরা?
– যুদ্ধের কথা
– তোরে না কতবার কইছি এগুলা ভুইলা যাইতে। তোর যে খারাপ একটা অতীত আছে এইটা ভুইলা গেছস?
মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের পরিচয় তুলে ধরাতে তারা নিজেরাও সামাজিক সমস্যায় পড়ে। ছবির গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল এটা। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বর্ণনা দেয়া এবং তাদের ঔরসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি উত্তরাধিকার তৈরি করার যে ঘৃণ্য প্রয়াস ছিল তার শিকার হয়ে সেটাকে দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের যে মর্যাদা বীরাঙ্গনারা করেছিল তাকে প্রকাশ করতে ভয় পায় তারা। ‘sleeping with enemy’ বা ‘শত্রুর সাথে শোয়া’-র বিষয়টা তাদের কাছে প্রশ্ন হয়ে আসে। তাদের সন্তান হবার বাস্তবতা সত্যিই কঠিন। এমন অনেক বাবা আছে যাদের নির্যাতিত মেয়েদের অ্যাবরশন করিয়ে বাচ্চা ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ভারত থেকে আসা আত্মপরিচয়সন্ধানকারী মুমতাজ সরকার গবেষণা কাজে নিজেই এ বাস্তবতা ফেস করে। সরেজমিনে দেখার যে অভিজ্ঞতা তার চরিত্রটিতে আছে এর ভিত্তিতে কেস স্টাডি বলা যেতে পারে সামাজিক এ সমস্যাটিকে চিহ্নিত করা। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণটিও গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ ছবির।
ছবিটিকে ‘র রিয়ালিজম’ বলা হয়েছে। একদম খালি চোখে দেখা দৃশ্যকল্প তৈরির একটা দারুণ কাজের ছাপ রয়েছে পুরো ছবিতে। যেখানে যেভাবে থাকলে প্রকৃতি, মানুষ, প্রাণি আর স্বাভাবিক জীবনযাপনকে তুলে ধরা যায় সেভাবেই দেখানো হয়েছে। ছবির প্রথম শটে কচ্ছপের নদীর দিকে ছুটে চলছে, নদীর শান্ত রূপ, উঠোনে মুরগি তার বাচ্চাদের দেখে রাখছে , গরু ‘হাম্বা’ ডাকছে, পাখির ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, ধানক্ষেতের ফিঙেপাখি বসে আছে, চপ্পলের মধ্যে মুরগির বাচ্চার পানিতে অসহায়ভাবে ভেসে যাচ্ছে, কুকুর-ছাগলকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে দেখানো হচ্ছে এগুলো ছিল সাদা চোখের জীবনযাত্রা। প্রকৃতিকে এভাবে দেখানোর সাথে মানুষের জীবনটাকেও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছে ছবিটি। তার সাথে ইতিহাসকে কানেক্ট করতে স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রাসঙ্গিক উপস্থাপন তো আছেই।
দুই বাংলার একটা বাস্তবতাকেও ছবির গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আনা হয়েছে। ‘একই ভাষা, একই মূল্যবোধ অথচ কাঁটাতার! সয়েল, সারফেসের প্রশ্ন’ এই সংলাপটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ছবিতে সংলাপ খুব ভালো ছিল। প্রাণ রায়ের মুখের এ সংলাপটি অসাধারণ-‘কাদার মধ্যে শুয়ে থাকলে মনে হয় আমি আমার মায়ের কোলে শুয়ে আছি।’ ইঙ্গিতে বোঝানো কথোপকথনের দুটি সংলাপ দারুণ :
-এই টিকটিকিটা এত উপরে এলো কি করে?’
– আমি যেভাবে এসেছি
মুমতাজ সরকারের মুখে আরেকটি সেরা সংলাপ-‘কারোর কি কেউ থাকে! সবশেষে আমাকে এই মাটির সাথেই মিশে যেতে হবে।’
গান, সিনেমাটোগ্রাফি দুটোই অসাধারণ এ ছবির। ‘ডালিম গাছ, মায়া’ গান দুটি টাচি বাকি গানগুলোর পরিধি কম থাকলেও সুন্দর বাণীর। ছবিতে দেখানো গ্রামটিতে দর্শক যেতে চাইতেই পারেন এত মনোরম।
চর্যাপদের একটা কবিতা ‘উচা উচা পাবত’-গানে গানে ব্যবহৃত হয়েছে।
অভিনয়ে জ্যোতিকা জ্যোতি, প্রাণ রায় আর মুমতাজ সরকার তিনটি প্রধান চরিত্রেই অনবদ্য ছিল। জ্যোতি-র অতীতের কাজগুলোর সাথে এটাকে আলাদা করা যায়। প্রাণ রায়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করাটা পরিচালকের ক্রেডিট। ভারতীয় অভিনেত্রী মুমতাজ সরকার ইতোমধ্যে নিজের ইমেজ তৈরি করেছে তাই এ ছবিতেও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্রটিকে প্লে করেছে ন্যাচারালি। নিশ্চয়ই এ ধরণের প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হওয়াটা তার জন্য সম্মানের। মুমতাজ সরকারের বিপরীতের অভিনেতা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রাজাকার বাবার সাথে তার আদর্শিক দ্বন্দ্বে চরিত্রটি শক্তিশালী হয়েছে এবং এ চরিত্রের সীমাবদ্ধতাও দেখবে দর্শক । সৈয়দ হাসান ইমাম অল্প ভূমিকাতেও দারুণ। কবি কামাল চৌধুরী নিজে অভিনয়ও করেছেন এবং ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের ‘পাঠক সমাবেশ’-এর স্টলটিকেও ছবিতে ডকুমেন্ট করা হলো।
নেগেটিভ দিক ছবিতে সেভাবে নেই। ইনডোর শটগুলোতে লাইটিং যথেষ্ট ছিল না তাই চোখে লেগেছে। ন্যারেটিভে ডিটেইল হয়তো আরো আনা যেত চরিত্রগুলোকে আরো রহস্যজনক করতে তবে এটা সমস্যা করেনি ছবিতে।
চিত্রকর্ম ও কবিতার সমন্বিত রূপ ‘মায়া : দ্য লস্ট মাদার’ ছবি। মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি তুলে না ধরে শুধু প্রেক্ষাপট দিয়ে বীরাঙ্গনার মতো সেনসেটিভ বিষয়কে চলচ্চিত্রে শিল্পিতভাবে উপস্থাপন করা অনেক বড় কাজ। চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা বিষয়ক যত ছবি আগামীতে হবে এ ছবিটি রেফারেন্স হয়ে থাকবে।
রেটিং – ৭.৫/১০