Select Page

‘বড় ছেলে’র জীবন দর্শন কী?

‘বড় ছেলে’র জীবন দর্শন কী?

বাংলাদেশে বিখ্যাত হওয়া নাটক ‘বড় ছেলে’ দেখলাম গত সপ্তাহে। বুঝার চেষ্টা করলাম বড় ছেলে কী কাহিনী বলেছিল যেটা এতো মানুষ পছন্দ করলেন। মানুষের পছন্দ দেখে তাদের বুঝা যায়।

‘বড় ছেলে’ নাটকে অপূর্ব-মেহজাবীন

বড় ছেলে একটা লাভ স্টোরি। একজন বড় ছেলে যিনি পরীক্ষায় ভালো পাশ দিয়ে এখন টিউশনি করে চলেন, তার গল্প। উনার পিতা ছিলেন একজন শিক্ষক, অবসর নিলেন। বড় ছেলের এখন একটা চাকরি অতি অবশ্যই দরকার, তা না হলে ফ্যামিলি চালানো যাবে না।

এইদিকে, বড় ছেলে ভালো ছাত্র হয়ে পাশ দিলেও হেল্প করার মত কোন নেটয়ার্ক নেই তার, কিন্তু একজন সুন্দর গার্লফ্রেন্ড আছে। এই গার্লফ্রেন্ড আবার সাক্ষাৎ বাংলা সিনেমার শাবানার প্রেতাত্মা থেকে উঠে আসা। মানে, যেসব ফিল্মে শাবানা সব দিক দিয়ে ভালো এমন অভিনয় করতেন, সেইরকম। এই গার্লফ্রেন্ড ধনী, সামান্য বাদাম ছাড়া তার কোন চাহিদা নেই, সে বড় ছেলের জন্য প্রায়ই খাবার তৈরি করে আনে। তার ধনী বাবা বিয়ে ঠিক করেছে। এবার বড় ছেলের জব লাগবেই।

কিন্তু বড় ছেলে চাকরি পান না। গার্লফ্রেন্ড পালাইয়া যাইতে বলে। বড় ছেলে রাজী হন না। কারণ তার পরিবার দেখতে হবে।

অতঃপর গার্লফ্রেন্ডকে তিনি স্যাক্রিফাইস করেন। তিনি বলেন, তুমি বিয়া বসে যাও। গার্লফ্রেন্ড কান্দেন, ও যেহেতু তিনি খুব ভালো গার্লফ্রেন্ড, তাই কথামতো চলে যান। তারপর তপুর মিথ্যে প্রেম গানের মত তারা আরও একদিন দেখা করেন ও কান্নাকাটি করেন। গার্লফ্রেন্ড বেশি কান্দেন, বড় ছেলে কম কান্দেন।

শেষে ব্যাকগ্রাউন্ডে বলেন নাট্যকার ও পরিচালক, বড় ছেলেরা পাবলিকলি কান্দে না। তারা লুকাইয়া কান্দে। কান্না মুছে বড় ছেলে ফেইক হাসি দিয়া পরিবারের কাছে যান।

নাটক শেষ হয়।

নাটকের কাহিনীর এই বর্ণনা দিলাম চরিত্রটির মানসিকতা বুঝার ভিত্তি তৈরি করতে। এখন একটু এনালিটিক্যালি দেখা যাক বড় ছেলে নামক ছেলেটির মানসিকতা সম্পর্কে, তার ওয়ার্ল্ডভিউ কী, ফিলোসফি কী।

বড় ছেলে একটা প্যাসিভ ক্যারেক্টার। সে ঘটনারে তার উপর ঘটতে দেয়। দিনরাত আশা করে ঘটনা অন্যভাবে ঘটবে। কিন্তু এর জন্য যে কাজ দরকার ওইটা সে করে না, এই সাহস তার নাই।

সে মনে করে নিজেকে একজন রিয়ালিস্ট। এইজন্য সে তার গার্লফ্রেন্ডকে বলে, আমার টাকা নাই জব নাই সমস্যা, তুমি অন্যত্র বিয়া বসে যাও। সে বুঝায় কেন এটি ভালো। এই জায়গায় তারে রিয়ালিস্ট মনে হতে পারে, সে নিজেও এটা বিশ্বাস করে।

কিন্তু এর আগে একসময় তার জীবনদর্শনের একটা দেখা মিলে। যখন গার্লফ্রেন্ডরে ফোনে বুঝাচ্ছিল তখন সে একপর্যায়ে বলে, জীবনরে আমরা যেভাবে দেখি, জীবন আমাদের সেভাবে দেখে না।

এটাই বড় ছেলের ওয়ার্ল্ড ভিউ। এবং এই জায়গাতেই বুঝা যায় সে একজন ভাব কল্পনাবাদী লোক। সে মনে করে ‘জীবন’ নামে মানুষের মত একটা জিনিশ আছে, তার দিকে আপনি যেমনে তাকাবেন, সেও ঐভাবে তাকাবে, এমন যেন যথার্থ, এবং সে ডিজার্ভ করে। কিন্তু এইরকম কিছু নাই। দুনিয়ার কোন দায় নাই কাউরে কিছু দেয়ার।

পুরা কাহিনীতে বড় ছেলেরে একটিভলি কিছু করতে দেখা যায় না। সে হাঁটে একজন লুজারের মত, কথা বলে লুজারের মত, জীবনরে দেখে লুজারের মত, কিন্তু আশা করে জিতে যাবে।

ভালো ছাত্র হয়েও তার নেটওয়ার্ক ভালো না। তার পিতা একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন, তারও কোন নেটয়ার্ক নাই। একজন ছাত্রকে বলেছিলেন তার ছেলের জন্য জব ম্যানেজ করতে, ওই ছাত্র শুনেই নাই। অর্থাৎ বড় ছেলের পিতাও ব্যর্থ। তিনিও সম্ভবত এইরকম ‘বড় ছেলে’ ছিলেন।

‘গেম ওভার’ নাটকে অপূর্ব-মেহজাবীন

একই অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নিয়ে নির্মিত আরেকটি নাটক আছে ‘গেম ওভার’ নামে। ওইখানেও একজন বড় ছেলে থাকে। ওই ফ্যামিলিতে বড় একটা দুর্যোগ আসে। তখন বড় ছেলে অপূর্ব একটিভ ভূমিকা নেয়। সেইখানে বড় ছেলের জিত হয়।

যদিও দুইটা দুই ধরণের ড্রামা, কিন্তু ড্রামাই তো। একই অভিনেতা অভিনেত্রীরা থাকায় মনে পড়ল, আর একটিভতা ও প্যাসিভতা বুঝাইতে মনে হল ভালো উদাহরণ।

গেম ওভারে বড় ছেলে খুব সফল ছিল না, তারও চাকরি নাই অবস্থা। কিন্তু ফ্যামিলির বড় দূর্যোগে সে তার চেষ্টা করে, ঘটনারে তার উপর ঘটতে দেয় না খালি, নিয়ন্ত্রণ করতে যায়। এতে সে সফল হয়। ব্যর্থ হতেও পারত। কিন্তু ব্যর্থ হলে তার এই চেষ্টার মহত্ত্ব কমত না।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার নোটবুকে লিখে গেছিলেন, তিনি যত এচিভার দেখেছেন, এরা ঘটনারে তাদের উপর ঘটতে দেন না, বের হইয়া ঘটনারে নিয়ন্ত্রণ করেন। এইরকম চেষ্টা বড় ছেলে নাটকের বড় ছেলের কাছ থেকে দেখি না। ইভেন গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হবার সময়েও, সে ফেইক রিয়ালিস্ট সাজে, তার গার্লফ্রেন্ড, যে এতো ত্যাগ করল, খালি বাদাম খাইয়া ঘর করল, তার কথা ভাবে নাই।

বড় ছেলে জনপ্রিয় হবার কারণ এটা মানুষরে প্যাসিভ ও ভিক্টিম হিসাবে ভাবার সুখ দিতে পারছে, যেন তার কোন দোষ নাই। এমনকি নাটকের শেষ বার্তাও ডাবল প্যাসিভ। এক বার্তাটা প্যাসিভ, বড় ছেলে পাবলিকলি কানতেও পারবে না, দুই এটা বলা হইছে ভয়েজ ওভারে।


About The Author

লেখক ও বিশ্লেষক

Leave a reply