ভালো কাজ দেখতে চান, অথচ সেরকম কিছু আসলে প্রমোট করেন না
এই ঈদে যে নাটকে অন্যতম সেরা অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম, তার নাম দানব।অথচ এই নাটকের ইউটিউব ভিউ ১ লাখ ৯০ হাজারের মতো। আর একই লেবু বারবার কচলানো যমজ সিরিজের যমজ ১০ এ সেই মোশাররফ করিমের তিনটি রূপ থাকার কারণেই হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক- এর ভিউ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি, ৪২ লাখ ছাড়িয়ে।
কে কী দেখবেন বা না দেখবেন সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। সেখানে আমি বলার কেউ না। খুবই চটুল বা মানের দিক থেকে নিচে থাকা কোন নাটকের ভিউ যদি এত বেশি হয়, সেটাকে আমি আটকে রাখার কেউ না। চারপাশে এত যন্ত্রণার মাঝে মানুষ একটি হাসতে চায়, বিনোদিত হতে চায়। আর গত কয়েকবছরে মানুষের কাছে “বিনোদন” শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে “হাসি” ; তাও আবার মুচকি হাসি না, খিলখিল করে হাসি সম্ভবত। যদিও বিকেল বেলার পাখি বা বড় ছেলের পরে এই হাসির জায়গায় নিজের রাজত্ব কায়েম করেছে কান্না।
এই কান্নাতেও আমার সমস্যা নাই। আমার সমস্যা অন্য জায়গায়। আপনি ভালো কাজ দেখতে চান, ডিফারেন্ট কিছু দেখতে চান; অথচ সেরকম কিছু আসলেই যখন তৈরি হয় তখন সেটা দেখার পরে আপনি শেয়ার করেন না। এই ঈদের অন্যতম সেরা একটি নাটক হচ্ছে আমার নাম মানুষ। কয়েকদিন আগে ছাত্র আন্দোলনে যেসব বাচ্চাদের পেটানো হয়েছে, তাদেরকে এক কথায় ট্রিবিউট দেয়া হয়েছে এই নাটকে অথচ সেই নাটকে ভিউ দেখলে অবাক হই।অথচ এরকম একটা কাজ করতে সাহস লাগে, কলিজা লাগে।কুরবানি ঈদে সবাই গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে আনন্দ করি অথচ এই গরুর সাথে তার মালিকের সম্পর্ক যে কতটা নিবিড় আর সেটা নিয়েও যে কত ভাল নাটক হতে পারে তার উদাহরণ লালাই নাটকটি। লালাই এর পরিচালকের আরেকটি ভাল নির্মাণ হচ্ছে বেড সিন। নাম শুনলেই হয়ত মুচকি হাসি দিয়ে সার্চ বক্সে চলে গেছেন, অথচ নাটকটার থিম একদম আলাদা যা হয়ত আপনার মনের wild fantasy কে পূরণ করতে পারবে না। মাত্র একটা রুমে একটা বিছানা আর দুইজন আর্টিস্ট নিয়ে ডিরেক্টর নাটক শেষ করে দিয়েছেন। একটা রুমে এতগুলো ফ্রেম এই নাটকের ডিওপি কীভাবে ধরলেন, সেটাও একটা ব্যাপার! অথচ এই দুই নাটকের ভিউ তুলনামূলকভাবে কম।অথচ এই দুটো নাটকের পরিচালক মাবরুর রশিদ বান্নাহ যখন ক্লোজআপ কাছে আসার লুতুপুতু নাটক বানান, সেটার ভিউ হয় আকাশছোঁয়া।
বাসা থেকে নিজের বৃদ্ধ বাবা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পাতা ঝড়ার দিন, প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে সোনালি ডানার চিল, অপি করিমের দুর্দান্ত অভিনয়ের কানামাছি ভোঁ ভোঁ, নিশোর একদম অন্য রকমের মেকাপ আর গেটাপের কাজ আঙ্গুরবালা আর ডাকাতের বউ, বড় ছেলে নাটকের পরিচালক আরিয়ান প্রেমের জায়গা থেকে বেরিয়ে বানালেন ফেসবুক ছাড়ার ছয়টি উপায়।অথচ এগুলোর কথা শুধু ফেসবুকেই। ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা পাওয়া আয়েশা নাটকের ভিউ দেখলে অবাক হই! এত প্রশংসা কি তাহলে নাটকটি দেখে করা হচ্ছে নাকি না দেখেই? পরে বুঝতে পারি আসলে দেখেই প্রশংসা করা হচ্ছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লিংক শেয়ার করে দুই কলমের মতো দুই কীবোর্ড লিখতে আমাদের কষ্ট। এদিক থেকে মোশাররফ করিমের ফ্যানরা অনেক “লয়্যাল” বলা যায়। যমজ ১০ এর লিংক তারা সবাইকে পাঠায়, সমানে শেয়ার করে, এমনকি নাটকের স্পেশাল অংশ কেটে আলাদা করে আপলোড করে আর সেটা নিয়ে সারা বছর চলে আনন্দলাভ।শরীরে ট্যাটু ৩ লাগানো নিশোর নাটকের ভিউ ছাড়িয়ে যার ১০ লাখ, অথচ একই পরিচালকের তুলনামূলক ভাল কাজ সুখের লটারির চাকচমক নাই, তাই ভিউও নাই!
যে জিনিসটা আমি বুঝাতে পারি না, বা আপনারা বুঝেন না বা বুঝেও চুপ থাকেন, সেটা হচ্ছে- আপনি ভাল কাজ শেয়ার না করলে বা অন্য মানুষদের না দেখালে ভাল কাজ আর তৈরি হবে না বা ভাল কাজের স্পৃহাটা কমে যাবে। কম বাজেটে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের পরিচালক আর আর্টিস্টদের কাজ করতে হয়। ঈদের সময় কিছুটা হয়ত বাজেট বাড়ে আর সেখানে তখন হয়ত নিজের মতো কিছু একটু বানানো যায়। সেটাতেও যদি আপনি উৎসাহ না দেন, তাহলে এসব ডিরেক্টর যারা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা বা সাহস করছেন, ঈদ শেষে তারা আগের মতই একই জিনিস ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বানাতে থাকবেন। অথচ তার যোগ্যতা ছিল আরও ভাল কিছু বানানোর কিন্তু আপনার ছোট্ট একটা ভাল মন্তব্য বা উৎসাহ তার কাছে ব্যাপক আকারে যায়নি, ফলে ভিউ বাড়েনি আর সেই ফলে চ্যানেলের মালিক তখন মনে করবেন- কি দরকার এসব এক্সপেরিমেন্ট করার? কান্না আর প্রেম ঢুকায় একটা ঘুঁটা দিয়ে কিছু বানায় ফেলান!
ঈদের সময় দেশী নাটক আর সিনেমা দেখি বলে পরিচিত মানুষদের কাছে আমার কদর কিছুটা বেড়ে যায়। সবাই ভাল নাটকের জন্য আমাকে নক করতে থাকেন। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, আমি একটুও বিরক্ত হই না। বরং আমার মৃত্যুশয্যায় থাকলেও সম্ভবত কেউ আমার কাছে ভাল নাটক বা সিনেমার লিংক থাকলে আমি তাকে হেল্প করে এরপরে দেহ ত্যাগ করব। এই ভাল কাজের লিংক দেয়ার পর আমি কোনদিন কাউকে বলি নাই আমাকে থ্যাংকস দিতে। বারবার বলেছি কাজটা ভাল লাগলে দুটো লাইন লিখে জাস্ট লিংক শেয়ার কইরেন। অথচ মানুষজন সেটা করে না।
কিন্তু যেটা তারা করে সেটা হচ্ছে, মেরিন শপিং মেগা কমপ্লেক্সের জঘন্য একটা বিজ্ঞাপন বারবার শেয়ার। তখন তাদের কোন কষ্ট হয় না। সেটা নিয়ে সমানে ট্রল, মিম এমনকি ডাবসম্যাশ পর্যন্ত চলে! তখন মানুষের এনার্জি দেখে অবাক হই!
আপনি দর্শক, আপনার দায়িত্ববোধ অনেক।আপনি কি শেয়ার করছেন, তার উপরে নির্ভর করছে ভবিষ্যতে আপনি কি পেতে চাচ্ছেন। আপনি মেরিন মেগা শপিং কমপ্লেক্স প্রমোট করলে সামনে এই ধরনের কাজ আরও হবে। শেষমেশ কিছু মানুষকে বাধ্য হয়ে এসব জিনিস বানাতে হবে, কারণ চাহিদা তৈরি হলে যোগান তো দিতেই হবে অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী! হয়ত এই কারণেই অনিমেষ আইচের মতো ডিরেক্টর যিনি ছোট পর্দায় দুর্দান্ত সব কাজ করেছেন, তাকে দেখি যমজ সিরিজের জন্য ক্যামেরার পেছনে থাকতে। অথচ গতবছরেও মায়াবতী নামের চমৎকার একটি কাজ করেছিলেন তিনি!
সমালোচনা যেমন দরকার তেমনি ভাল কাজে উৎসাহ দেয়াটাও খুব দরকার।ফেসবুকে লেখার কারণেই কিন্তু প্রথম আলোর মতো পত্রিকা দর্শকদের নাটক নিয়ে রিভিউ ছাপিয়েছে এবার, যেটা অবশ্যই আশাব্যাঞ্জক একটা ঘটনা। আপনাকে রচনা লিখতে বলছি না, জাস্ট পিঠে আলতো করে চাপড়ে দেয়ার মতো একটু লেখা হলেই চলবে। মেরিন সিটির বিজ্ঞাপন দেখা উচিত সেখানকার এক ক্যারেক্টারের ডায়লগের মতো “লুকিয়ে লুকিয়ে”, আর প্রকাশ্যে আনা উচিত ‘ভাল’ কাজগুলোকে।