ভাষা আন্দোলনকে নিছক জাতীয়তাবাদী মোচড়ে আমি দেখি না
ভাষা আন্দোলন কেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ততটা পরিবেশিত হয়নি এই প্রশ্নটা নানান সময়ে করা হয়েছে আমাকে। নানানজনেই করেছেন। মাস্টারি করি বলে, আর নিছক বইপত্র আর গবেষণা-ডেটার দুনিয়া মেপেই কথা বলি না বলে আমাকে এই প্রশ্ন করা অসঙ্গত নয়।
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছায়াছবিটা ছাড়া গুরুতরভাবে এই প্রসঙ্গ আসেনি ছায়াছবিতে। আবার ওই ছবিটাতে একেবারে আদি ফুটেজ আসার কারণে ছবিটাও প্রয়োজনের তুলনায় ভক্তিভরে গৃহীত হয়েছে। তবে বাস্তবে এই জিজ্ঞাসাটা আমাকে কখনো ভাবায়নি। এর কয়েকটা কারণ আবিষ্কার করা যায়।
সবচেয়ে গুরুতর কারণটা সম্ভবত এই যে, প্রাত্যহিক রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের মধ্যে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন কখনোই এতটুকু ফিকে ছিল না। এমনকি, বাংলাদেশের যে সময়টাতে মুক্তিযুদ্ধের বিবরণী নিয়ে মেলা রকম মোচড়ামুচড়ি হয়েছে শাসক তরফে, তখনো ভাষা আন্দোলন ছিল ‘দলমত-পথগঁৎ’ নির্বিশেষে জাতীয়তাবাদী গৌরবের ভয়ানক এক স্মারক।
এত এত স্মৃতি-বুদবুদের মধ্যে আমার কখনো এই প্রশ্ন মাথায় দেখা দেয়নি। তাছাড়া, আমার বুদ্ধি পাকতে শুরু করার পর থেকেই দেশের সিনেমা শিল্পকে ক্রমাগত সংকুচিত হতে দেখা লোক আমি। সেই ইন্ডাস্ট্রির কাছে আর্টের আবদার করার জন্য এমনিতেও আমি অনেক ফুরসত পাইনি। যারা পেয়েছেন তাদের সালাম জানিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করেছি এই প্রক্রিয়াটা। আমি বুঝে সারিনি, চলচ্চিত্র কারখানাটি আরও আরও দূর সরেছে। এখন পুরো নতুন এক বীজ ওটিটিতে গজাচ্ছে যখন, তখন আগের কারখানা প্রায় প্রত্নতাত্ত্বিক সমাধিস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে কোনো একটা বিষয়ে কেন ছবি বানায়নি এই প্রশ্ন উত্থাপন নির্মম তো বটেই, আহাম্মকিও লাগে আমার। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব চলচ্চিত্র (কিংবা সৃজনশীল সাহিত্য) রচিত হয়েছে সেসবের মোটের উপর যে হাল, তাতে আমার মনে হয় না যে গুরুতর কোনো ক্ষতি হয়েছে।
বরং, চলচ্চিত্রতেও যদি কিছু ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ হতো তাহলে আরও সব গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি হতো। জাতীয়তাবাদী গৌরবগাঁথা ছাড়া আর কিছু হতো বলে মনে হয় না। গৌরবগাঁথার সমস্যা হলো তাতে নানান টানাপড়েনের ডাইনামিকস হাওয়া হয়ে যায় (এখানে ডাইনামিকস না বলে দ্বন্দ্বও বলা যেত, তাতে মার্ক্সবাদীও থাকা চলতো আমার; আচ্ছা তবে দ্বন্দ্বই হলো)। বাস্তবে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর প্রতি গণ-প্রতিক্রিয়া গুরুতরভাবে শ্রেণিগত প্রতিক্রিয়াও ছিল। আর এই সারসত্যটা বুঝতে আপনার একদমই ভাষাপণ্ডিত বা মার্ক্স-বিশেষজ্ঞ হওয়ারও দরকার নেই।
ধরুন, আগামীকাল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ঘোষণা দিল যে, বাসাবাড়ির পলিস্টার-পরা ৮ হাজারী (বা ৬ হাজারী) বেতনের ৫০ কেজি ওজনের যে দারোয়ানবৃন্দ থাকেন, তাদের প্রমিত বাংলা বলতে হবে। তাহলে ওই অসম্ভবপ্রায় চাকরিটাও আর ওদের করার উপায় থাকবে না। এখন, বাংলাদেশে গরিবের আন্দোলন বিলুপ্তপ্রায় হলেও ওইসব দারোয়ানদের জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যাবে।
কারণটা হচ্ছে, এই বাংলায় তার আশু প্রশিক্ষণ সম্ভব নয়। উপরন্তু, এসব কাজে ব্যাকরণমাফিক বাংলা বলার আবশ্যকতাও নেই। তাহলে ৮ হাজারে জীবনধারণের এই দুরূহ কাজের মধ্যে নতুন অত্যাচারের কারণেই তিনি ‘আন্দোলন’ করতে পারেন।
১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তান রাষ্ট্রশাসক যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন নানাবিধ শ্রেণির প্রধান আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল তাদের কর্মক্ষেত্রে ‘যোগ্যতা’ প্রমাণের দুরূহতা। সেটা নিজ ভাষার প্রতি মায়া হতে পারে, কিন্তু নিজ জীবন ধারণের জন্য মরিয়া চেষ্টাও বটে।
বাস্তবে, রাষ্ট্রভাষা ঘোষণাটি যে পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগণের জন্যও সমান মাত্রায় আঘাতকারী ছিল এই সত্যটা প্রায় বাংলাদেশের চেতনা থেকে অপসৃত। পাকিস্তানের সকল প্রদেশের মানুষজন, সকল স্থানীয় জাতিসমূহ (এথনিক গ্রুপ; রাষ্ট্রীয় দলিলে ‘ট্রাইব’) এই ঘোষণাতে মারাত্মক আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের হওয়ারই কথা।
বাস্তবে, বিভিন্ন প্রদেশে এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া গুরুতর মাত্রা ধারণ করেছিল। এসব জানা বা বোঝার জন্য আর্কাইভ ঘাঁটাঘাঁটি করা অবশ্যই কাজের। কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটি না করেও এসব জানা বোঝা অসম্ভব কোনো কাজ নয়। বেলুচিস্তান এবং সিন্ধুপ্রদেশের বিক্ষোভগুলো তো অন্তত তখনকার ‘বাঙালি’ রাজনৈতিক কর্মীদেরও জানার কথা।
উত্তর-সীমান্ত প্রদেশে তো শুরু থেকেই অসন্তোষ, কেবল ভাষা প্রশ্নে নয়। সেটাও জানার কথা। এবং তারা তা জেনেছিলেন। কিন্তু উত্তরকালে এসব রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বাংলাদেশের লোকদের সেগুলো বুঝতে দিতে যথেষ্ট যে তৎপর হয়েছেন তার প্রমাণ নেই। এটাই হলো জাতীয়তাবাদী জজবা।
তারপরও বাংলাদেশে, তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাত্রা স্বতন্ত্র হতে পারে। অন্তত দুটো কারণে পারে। আগের পাঁচ বছরেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনস্থ পূর্ব-পাকিস্তান একক ভাষার একটা ভৌত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল ছিল।
দ্বিতীয়ত, আগের পাঁচ বছরেই কেন্দ্রীয় পাকিস্তানি প্রশাসনের বড় সংখ্যার নানাবিধ ভাষাভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীকে শাসনের ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে হয়েছিল, যা এই ভূখণ্ডের বেলায় স্বতন্ত্র ছিল।
যতটা জানা যায়, তার থেকেও বেশি বোঝা যায়, পাঞ্জাব থেকেই সবচেয়ে কম প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সেটা উর্দুর সাথে পাঞ্জাবি ভাষার দোস্তির কারণে সম্ভবত নয়। বরং, পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালন এবং সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবের আধিপত্যের সাথে তা সম্পর্কিত। বাংলাদেশের জনভাষাতেও ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের মিলিটারি প্রায়শই ‘পাঞ্জাবি’ বলে অভিহিত হয়ে আসছে। এগুলো সহজ সব পর্যবেক্ষণ।
বস্তুত, বাংলা অঞ্চলের মানুষজনকে, স্বাধীনতার পর (বা আগে) কখনোই ভালো করে এই শিক্ষাটাও দেওয়া হয়নি যে, উর্দু আদতেই ভৌত পাকিস্তানের মানুষজনের ভাষা নয়। কখনোই ছিল না। উর্দু ভৌগোলিকভাবে বর্তমান ভারত থেকে রাজনৈতিক অভিবাসীদের আমদানি করা ভাষা।
এই রাজনৈতিক অভিবাসীবৃন্দ পৃথিবীর অনেক রাজনৈতিক অভিবাসীদের মতো কেবল প্রান্তিক হতদরিদ্র ছিলেন না, উল্টো তাদের বড় অংশই ছিলেন উচ্চাভিলাষী। এই অঞ্চলে কখনো এই শিক্ষাটাই ঠিকমতো দেওয়া হয়নি, আগামীতেও দেওয়া হবে না যে ১৯৪৭-এর দুই রাষ্ট্র নীতিমালাতে পাকিস্তানের অভ্যুত্থানের কারণ যাই হোক, ফলাফল হলো সিন্ধিদের সর্বাত্মক উৎপাটন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিবরণীতে যে দোজখনামা বাঙালি জাতি হাজির করেন, সেই দোজখের সূত্রপাত ঘটে সিন্ধু প্রদেশে। এবং আরও মর্মান্তিকভাবে। নেই, কোথাও এসব বিবরণী নেই।
ভাষা-জিজ্ঞাসাকে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব কি না সেটা নিশ্চয়ই জটিল রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রশ্ন। কিন্তু এই উপলব্ধির পাটাতন তৈরি হতে হবে নানাবিধ ভাষা-উৎপীড়নের মানুষজনকে চেনার মধ্য দিয়েই। মোহাজির সম্প্রদায়ের নতুন রাষ্ট্র-আকাঙ্ক্ষার আশু দাম দিতে হলো যে জাতিকে, সেই জাতির দুর্ভোগ-যন্ত্রণা-বঞ্চনার ইতিহাসের প্রতি যদি আপনার সহৃদয় দৃকপাত না থাকে, কী ভরসায় আমরা নিশ্চিত হতে পারি, আপনি নিজ অঞ্চলের দুর্ভোগ-পীড়িত লোকদের বুঝতে পারেন?
আসলে, এগুলো রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর মাত্র। ইতিহাস বইয়ে সোনালি ফ্রেমে ছবি বাঁধানো মাত্র। জাতির অতিকায় একটা দৃশ্য রচনার স্বপ্ন মাত্র। এসবে আমার আগ্রহ নেই। একপক্ষের মিনার বানানো প্রায়শই অন্যপক্ষের সমাধি রচনা। স্বজাতির বিকট বিজয় যদি অন্য জাতির নিগ্রহের কারণ হয়, আমার তাতে আগ্রহ নেই। আশা করি, আমাদের মনে আছে যে, আমাদের রাষ্ট্র্রেও ৫০টি জাতি বসবাস করে।
তাহলে আমার কী নিয়ে আগ্রহ আছে? বিষয়টা কেবল চলচ্চিত্রের নয়, সৃজনশীল সাহিত্যের নয়, সঙ্গীত কারখানার নয়। এগুলো সবই অভিপ্রকাশ মাত্র, এক্সপ্রেশনস। এগুলোর সংগঠক সবই চৈতন্যের উপাদান। ফলে চৈতন্য গঠিত হয়েছে কীভাবে সেটার উপর নির্ভর করবে কী বা কীভাবে প্রকাশ করতে পারবেন আমাদের সাথিরা।
মনে পড়ে গেল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই রাখাইন জাতির প্রোটাগনিস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ছায়াছবি হয়েছিল – ‘মেঘের অনেক রং’। হোক সেটা বাংলা ছবি, কিন্তু অন্য জাতির পাশাপাশি অস্তিত্বের জন্য এই কালচারাল প্রোডাক্টটির গুরুত্ব অসীম। বিশেষত, তখন এই উপলব্ধি আরও গুরুতর, যখন আপনিও বোঝেন এরকম আরেকটা ছবির বাস্তবতা নেই বাংলাদেশে। মনে পড়ে গেল, বাংলাদেশের প্রথম ‘অন্য ভাষার’ ছায়াছবি নিষিদ্ধ হয়েছে—অং রাখাইনের ‘মর থেংগারি’। কী কারণে নিষিদ্ধ হয়েছে তা যদি আপনার মনে পড়ে (এবং অবশ্যই নিরাপত্তার কারণে চুপ থাকেন) তাহলেও খুব বিষাদময় হবে সেই স্মৃতিচারণ।
মনে পড়ে গেল, যা ও যেভাবেই হোক না কেন, দু’দশক আগেও অমুসলিম প্রোটাগনিস্টের কিছু ছায়াছবি বানানো হতো এদেশে। হয়তো শরৎচন্দ্রের উছিলাতেই; কিন্তু হতো তো! এখন মনে হয় না যে সবচেয়ে আশাবাদী লোকটাও ভাবেন সেটা সম্ভব। চলচ্চিত্রের সমাধির পর ওটিটিতে হয়তো হবে। কিন্তু সেখানে যে গল্পধারা, যে ভোগপ্রণালী, হয়তো একই অর্থ তা বহন করবে না।
ভাষা আন্দোলন ভাষাকে আর অভিব্যক্তিকে স্থাপনের প্রশ্ন, উৎপাটনের তো নয়!
/লেখাটা ঢাকা পোস্টে প্রথম প্রকাশিত