Select Page

‘ভুবন মাঝি’ দর্শন ও কিছু কথা

‘ভুবন মাঝি’ দর্শন ও কিছু কথা

প্রথমেই বলে নেই, আমি কোনো সিনেমাবোদ্ধা নই। নিতান্তই আমজনতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম শো দেখার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি।

অজ্ঞাতনামা, আয়নাবাজির পর ‘ভুবন মাঝি’ নিয়ে প্রত্যাশার পারদ ছিলো অনেক উঁচুতে। সিনেমার পোস্টার, টিজার, ট্রেলার, গান- সবকিছুই ছিলো মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানো। সে কারণেই শুক্রবারের অলস সকালে মধুমিতা সিনেমা হলের প্রথম শো’র টিকেট কেটে সিটে আরাম করে চেপে বসা। নির্দিষ্ট সময়ের আধঘন্টা পরে সিনেমা শুরু হলো। পুরো হলজুড়ে হাতে গুণে জনা পঞ্চাশেক মানুষ ছিল।

সিনেমার কাহিনী নিয়ে কিছু লিখব না। উইকিপিডিয়া আর প্রচারণার কারণে ওটুকু প্রায় সবাই জানেন। সিনেমা শুরু হওয়ার পর থেকে যে বিষয়টা শেষঅব্দি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে, সিনেমাটোগ্রাফি। দৃশ্যধারণ ছিল চমৎকার। পাকশী ব্রিজ আর রেললাইনের উপর নহির আর ফরিদার বসে থাকার দৃশ্য আজীবনের জন্য মনে দাগ কেটে ফেলেছে। ব্র্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর গানের পরিমিত ব্যাবহার ছিলো শ্রুতিমধুর। সংলাপও ছিলো যথেষ্ট ভালো। গড়াই নদীর তীরে বসে ফরিদাকে নহিরের বলা ‘মরতে খুব ভয় করে ফরিদা। যেখানে কিচ্ছু নেই, সেখানে যেতে আমার ইচ্ছে করে না’ কিংবা চিঠিতে লেখা ‘এই প্রথম মনে হলো বাংলা আমার দেশ। এই পতাকা আমার। যেমনটা তুমিও’ ধরনের সংলাপ এদেশের চলচ্চিত্রে খুব একটা দেখিনি আগে।

অভিনয় নিয়ে কিছু বলার ধৃষ্ঠতা না দেখানোই বোধহয় ভালো। পরমব্রতের অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নতুন করে মুগ্ধ হয়েছি, অপর্ণা ঘোষের অভিনয়ে। ‘সুতপার ঠিকানা’র পর এই সিনেমাতেও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। মামুনুর রশীদ,কাজী নওশাবা আহমেদ, মাজনুন মিজানসহ বাকিরাও নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন।

কাহিনী, মিউজিক, সংলাপ, অভিনয়- এতো কিছু ভালো হওয়া সত্ত্বেও সিনেমা দেখে আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি! এর প্রধান কারণ গল্পের গাঁথুনির অসামঞ্জস্যতা আর কিছু কারিগরি দুর্বলতা। একাত্তর থেকে দুই হাজার তেরো সময়টাকে তিনভাগে দেখাতে গিয়ে দৃশ্যগুলো অনেকক্ষেত্রেই খাপছাড়া লাগছিলো। যুদ্ধ, শপথ গ্রহণ, শরনার্থী শিবির, আন্দোলনের দৃশ্যগুলোর সাদামাটা আয়োজন ও দৃশ্যায়ন ওই সময়ের ব্যাপকতা বুঝাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যার্থ। এর জন্য প্রিয় নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন খানকে দায়ী করার চেয়ে অর্থের অপ্রতুলতাকেই বেশি দায়ী করব। বস্তাপচা সিনেমায় লাখ টাকা লগ্নি করলেও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় কেউ টাকা বিনিয়োগ করতে চায় না- এই বাস্তবতাটুকু বিবেচনা করে নির্মাতার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে, চমৎকার বাস্তব গল্পটির আরো ‘সিনেম্যাটিক’, ‘সাসপেন্স’ সমৃদ্ধ উপস্থাপন প্রত্যাশা করেছিলাম। প্রথমার্ধ গতিশীল থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধ ছিল শ্লথ। ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, শুধুমাত্র সত্তর-একাত্তরকালীন সময়টার বাস্তবসম্মত উপস্থাপন করলেই সিনেমাটা আরো বেশি উপভোগ্য হতো, প্রত্যাশা সংক্রান্ত অপ্রাপ্তিটুকু পদ্মানদীর নৌকায় চড়ে হুগলী নদীর তীরে ভেসে যেতো।

এই সিনেমার কোনো রেটিং দেবো না। যারা মুক্তিযুদ্ধকে, চির আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে অন্তরে লালন করেন তারা হলে গিয়ে দেখে আসুন। এরপর বিচার করুন নিজস্ব শৈল্পিকবোধ দিয়ে। এটুকু বলতে পারি, হলিউড-বলিউডের মারদাঙ্গা যুদ্ধের সিনেমার মতো ‘বীরত্ব, ‘সাসপেন্স’ দেখতে পাবেন না ‘ভুবন মাঝি’ সিনেমায়। মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে নহির বাউল, ফরিদা নামক দুজন অখ্যাত মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছিলো তা দেখতে পাবেন আর দেখতে পাবেন চিরসবুজ বাংলার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের শৈল্পিক উপস্থাপন।


Leave a reply