‘ভেজা চোখ’ দেখে চোখ ভেজেনি কার?
আশির দশকে আমাদের প্রধান দুটি বিনোদন মাধ্যম ছিল সিনেমা হল ও ছোটবাক্স সেই রেডিও। টিভি তখনো অনেকের আয়ত্তে আসেনি, বেশ ব্যয়বহুল মাধ্যমটি অনেকেরই তখন নাগালের বাইরে। সে হিসেবে সিনেমা আর রেডিওই ছিল আমাদের বিনোদনের প্রধান সঙ্গী।
বিশেষ করে রেডিওর সেই সব দশ মিনিটের সিনেমার বিজ্ঞাপন আমাদের জোঁকের মতো টেনে ধরতো, টুকরো টুকরো সব সংলাপ সঙ্গে আংশিক কিছু গান নিয়ে করা সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনে শুনে কোন এক জাদুর টানে ছুটে যেতাম সিনেমা ঘরে তা টেরই পেতাম না। কী যেন এক অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করতো যা লিখে বোঝানো সম্ভব না, শুধু অনুভবের ব্যাপার।
বাবার চাকরির সুবাদে বদলি হয়ে আমি তখন ঢাকা থেকে বগুড়াতে, সেটা ৮৭-র একেবারে প্রথম দিকে। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ নতুন স্কুল আর আমার আগ্রহের নতুন নতুন সিনেমা হল। সে সময় বগুড়া শহরতলিতে সম্ভবত তিন চারটি সিনেমা হল ছিল, এর মধ্যে বাম্বী-মাধু-মেরিনা এই তিনটি হলের কথাই মনে পড়ছে। যার একটিতেই দেখেছিলাম ‘ভেজা চোখ’ (২৫/০৩/১৯৮৮) নামের সিনেমাটি।
‘ভেজা চোখ’ এখনো বহু দর্শকের আফসোসের কারণ হয়ে আছে ছবিটি দেখতে না পারার কারণে, পরিচালক ছিলেন মরহুম শিবলী সাদিক সাহেব, চিত্রনাট্যও ছিল তার করা। এখানে একটু যোগ করি, এই ছবির মাত্র দুই মাস আগেই শিবলী সাদিক ‘নীতিবান’ (০৫/০২/১৯৮৮) নামের একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন যা দেখেও মুগ্ধ হয়েছিল আমার মতো আরও বহু সিনে দর্শক। তবে আর সবার মতো আমারও একদমই ধারণাই ছিল না এর মাত্র কদিন পরেই তিনি আমাদের এ রকম একটি কালজয়ী ছবি উপহার দেবেন।
মনে পড়ছে ৮৭-র পুরোটা সময় জুড়ে যখন আমরা প্রতিরোধ, প্রেম বিরহ, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, শিকল, সমর্পণ, হাতী আমার সাথী, সুপারস্টার, মর্যাদা, অত্যাচার, সারেন্ডার, লালু মাস্তান, সন্ধি, লোভ লালসা, জুলি, সহযাত্রী, হুমকি, স্বামী স্ত্রী, শাহী খান্দান, দায়ী কে?, আদিলের মতো ছবিগুলো দেখছিলাম তখন একজন শিবলী সাদিক আমাদের অজান্তে বানাচ্ছিলেন ‘ভেজা চোখ’-এর মতো একটি হৃদয় নিংড়ানো ছবি। যে ছবির মর্মান্তিক গল্পে চোখ ভিজে নাই এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যায় নাই। হঠাৎ ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত ‘জীবন’ নামের উচ্ছল এক প্রাণবন্ত যুবকের মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়ার হৃদয় বিদারক গল্পে কেঁদেছে পুরো হল ভর্তি দর্শক। বিশেষ করে ছবির শেষ দৃশ্যে আগ্রার তাজমহলের সামনে ইলিয়াস কাঞ্চনের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্যে অঝোরে কাঁদতে দেখা গেছে মহিলা দর্শকদের। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, যা না দেখলে কখনো বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কেউ শাড়ির আঁচল, কেউ ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বেরিয়েছে, যেন এই মাত্র চোখের সামনে জীবন নামের এক তরুণের করুণ মৃত্যু তারা দেখে এসেছে। ভাবুন একবার, কতটা বাস্তবিক হলে পুরো হল ভর্তি দর্শকদের মনে এমন প্রভাব পড়তে পারে। আর এভাবেই একজন গুণী পরিচালক শিবলী সাদিকের পরিচালনায় ইলিয়াস কাঞ্চন, চম্পা, মিঠুন, নিপা মোনালিসাদের দক্ষ অভিনয়ের গুনে একেবারে বাস্তবিকভাবে পর্দায় উঠে এসেছিল ‘ভেজা চোখ’। যা আজ থেকে প্রায় ৩২ বছর আগে সপরিবারে দেখেছিলাম বগুড়ার ‘বাম্বী’ সিনেমায়।
ছবিটির প্রধান ফোকাস ছিল জীবন চরিত্রে অভিনয় করা ইলিয়াস কাঞ্চনকে ঘিরে, যে খুব প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনায় ভরা এক যুবক। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রিয়া নামের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সারাক্ষণ রঙিন করে রাখতে চায় তার জীবন। কিন্তু হঠাৎ ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া জীবনের সবকিছু কেমন যেন সাদাকালো হয়ে যায়, সে জানতে পেরেছে তার আয়ু আর মাত্র ছয় মাস। তাইতো তার কাছের একমাত্র ডাক্তার বন্ধু (মিঠুন) যখন সব আগে জানতে পেরে জীবনকে কিছু না জানিয়ে বোম্বে (মুম্বাই) নিয়ে চিকিৎসা করানোর ছলে বলে, ‘তুই কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বোম্বে আসবি, তোকে নিয়ে একটি জায়গায় যাবো’। উত্তরে জীবন বলে ‘এত তাড়া কিসের বন্ধু’, ‘ছয় মাস কাটুক’ জীবনের কথায় চমকে উঠে মিঠুন।
জীবন বলে, ‘আমি সব জানি রে। আমার ব্লাড ক্যানসার হয়েছে, আর মাত্র ছয়টা মাস বাঁচবো আমি, এই শেষকটা দিন কেন আমাকে হাসপাতালে বন্দী করে রাখবি? বরং আমি চাই, এই শেষ ছয়টা মাস জীবনে যেখানে যেখানে যত আনন্দ আছে উত্তেজনা আছে উদ্দামতা আছে সবকিছুকে নিংড়ে নিতে। কথা দে আমার এই ক্যানসারের কথা কাউকে বলবি না। বাবা মা প্রিয়া কারো কাছে না, কথা দে!’
মিঠুন কথা দেয় কাউকে বলবে না, তবে তাকে একবার শেষ চেষ্টাও করাতে চায়, কাঞ্চনও কথা দেয়। ‘প্রিয়া (চম্পা)-র জন্য যখন ভালোবাসার তাজমহল বানাতে পারলাম না তখন বোম্বে, দিল্লি ঘুরে একবার প্রিয়াকে নিয়ে অন্যের বানানো তাজমহলে যেতে চাই।’
ওপরের এই অসাধারণ হৃদয় বিদারক দৃশ্যে কাঞ্চন ও মিঠুনের অভিনয়-অভিব্যক্তি মারাত্মকভাবে মনকে নাড়া দিয়ে যায়। ছবির আরেক দৃশ্যে যখন কাঞ্চন লুকিয়ে তার ক্যানসারের কথা জানতে পারে তখন তার চোখ আর মুখের অভিনয়ের ভাষা যেন বারবার বলতে থাকে ছবির এই ‘জীবন’ চরিত্রটি যেন একমাত্র তার জন্যই তৈরি হয়েছে। এ কথাটি ছবির শেষ দৃশ্যের জন্যও প্রযোজ্য, আগ্রার তাজমহলের আঙিনায় যখন জীবনের কাছে হেরে যাওয়া কাঞ্চন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে সেই অভিনয় কি কখনো ভোলা যেতে পারে? অভিনয়ের এত চমৎকার অভিব্যক্তি যা এখনো চোখে লেখে আছে, বিশেষ করে ছবির সংলাপ প্রক্ষেপণ এত টাচি ছিল যে মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর কেউ পেরেক মারছে।
‘ভেজা চোখ’ আসলেই একটি আফসোসের ছবির নাম, যারা দেখেননি তাদের জন্য। দেশে অনেক ভালো ভালো ছবি নির্মাণ হয়েছে, তবে ‘ভেজা চোখ’ যেন এখনো দর্শকদের মনে আলাদা একটি জায়গা তৈরি হয়ে আছে। একটি ছবি তখনই পরিপূর্ণতা পায় যখন তার সব দিকগুলো মানুষের মন ছুঁয়ে যায়, যা ‘ভেজা চোখ’-এর মধ্যে ছিল বিদ্যমান।
ছবিটির প্রযোজক ছিলেন জনাব ইকবাল সাহেব, এটি তার প্রথম প্রযোজিত ছবি, লাভ ইন্টারন্যাশনাল ছিল পরিবেশকও। কাহিনি চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন শিবলী সাদিক সাহেব, বলতে গেলে তার সেরা কাজ এটি। তাকে সহযোগিতা করেছেন শিষ্য সোহানুর রহমান সোহান, সংলাপ লিখেছিলেন কবি জিয়া আনসারী, ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন সদ্য প্রয়াত মাহফুজুর রহমান খান, সম্পাদনায় মজিবুর রহমান দুলু, গান লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর মনকাড়া সুরের কাজটি সেরেছেন আলম খান সাহেব। এই যখন একটি ছবির টেকনিক্যাল ডাটা তখন বুঝতে হবে ছবিটির মান কোন উঁচুতে বেঁধেছে বাসা। শুধু ছবিই না, মনে বাসা বেঁধেছিল এর সবকটি গানও। বিশেষ করে ছবির টাইটেল গান অ্যান্ড্রু কিশোরের দরদ ভরা গলায় ‘জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প’ যেন এখনো হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দেয়, এই একটি গান যেন পুরো ছবির ভাষা বলে যায়। বিশেষ করে ছবিটির মুক্তির আগে রেডিওর সেই বিজ্ঞাপনে গানটির মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশি, গানের কথার সঙ্গে সুর আর অ্যান্ড্রু দা’র দরদ মাখা কণ্ঠের আবেদনে এখনো গানটি সবার অন্তরে বসবাস করছে। অন্যান্য গানের মধ্যে ‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’, ‘পেয়েছি চাচি পেয়েছি ও চাচা’, ‘তুইতো কাল চলে যাবি আমাকে ছেড়ে’ গানগুলোও এখনো জনপ্রিয়।
গল্প অনুযায়ী একেবারে বাস্তবিক করে তুলতে ছবিটির শুটিং হয়েছিল মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল, দিল্লি, মাশহৌর, কলকাতা ও আগ্রার তাজমহলের সামনে। আর ‘ভেজা চোখ’ই আমাদের একমাত্র চলচ্চিত্র, যা তাজমহলের একেবারে সামনে থেকে শুটিং করা হয়েছিল।