ভয় ভেঙে ‘মিস্টার বাংলাদেশ’!
নাম : মিস্টার বাংলাদেশ
ধরন : সোশ্যাল অ্যাকশন ড্রামা
পরিচালক : আবু আখতার উল ইমান
প্রযোজনা : কেএইচকে প্রডাকশনস
কাস্ট : খিজির হায়াত খান (ইব্রাহীম/সাফায়াত খান/মি. বাংলাদেশ), শানারেই দেবী শানু (কুমু), মারিওন পেলেগ্রিন (মারিওন), টাইগার রবি (কার্লোস), শাহরিয়ার মাহমুদ সজীব (মাহমুদ), শামীম হাসান সরকার (হাবিব), সোলায়মান সুখন (জুবায়ের), হামিদুর রহমান (এএসপি হামিদ) প্রমুখ।
পরিবেশনা : জাজ মাল্টিমিডিয়া
মুক্তি : ১৬ নভেম্বর, ২০১৮
নামকরণ : দেশে জঙ্গিবাদের গোড়া উপড়ে ফেলার জন্য এক অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তির জীবনযুদ্ধের গল্পই এছবিতে ফুটে উঠেছে। ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ ছদ্মনামের সেই ব্যক্তি খুঁজে খুঁজে নিঃশেষ করতে থাকে জঙ্গিবাদ সংঘটিত হওয়ার সকল পথকে। নামকরণ হিসেবে সেই মূল চরিত্রের নামটিই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ : দু বছর আগে ঢাকার গুলশানে ঘটে যাওয়া হলি আর্টিসান হামলার সূত্র ধরেই এ ছবির গল্প এগিয়েছে। এক প্রভাবশালী গণমাধ্যমের ক্রাইম রিপোর্টাররা চান দেশের মানুষের এই জঙ্গিবাদে জড়ানোর পেছনের গল্প জনগণের সামনে তুলে ধরতে; তাদের সচেতন করতে।
ক্রাইম রিপোর্টার হাবিবের এক আত্মৗয়ের ছেলে গত এক মাস ধরে নিঁখোজ; পুলিশেরা তদন্ত করে সেই ছেলের সাথে জঙ্গিদের সুসম্পর্কের আলামত খুজে পায়। হাবিব এই পুরো ঘটনাটি তার কলিগ ইব্রাহীমের সাথে শেয়ার করে; এরপর তারা এই ঘটনাটি নিয়ে আরো ঘাটাঘাটি করতে থাকে এবং চেষ্টা করতে থাকে কোনো সূত্র বের করার। বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একসময় কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোয়! খুজেঁ পাওয়া এক বিশাল মাষ্টারপ্ল্যানের!
রিপোর্টার ইব্রাহীম এই ঘটনার সূত্র ধরে এগোয় মোট দুইভাবে; একবার পথভ্রষ্ট জিহাদি ছদ্মবেশে ইব্রাহীমরূপে, আরেকবার আন্ডারকভার এজেন্ট সাফায়েত খান অরফে মিস্টার বাংলাদেশ রূপে। কারণ, দেশকে বাঁচানোর পাশাপাশি এক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত কষ্টও জড়িয়ে আছে।
যে থিম নিয়ে গল্প এগিয়েছে তাতে চমৎকার কিছু একটা হতে পারতো; কিন্তু সমস্ত আয়োজনে পানি ঢেলে দিয়েছে বেশ কিছু দূর্বলতা। প্রথমত, এর চিত্রনাট্য। প্রথম ২০/২৫ মিনিট ঠিকঠাকই গল্প এগোচ্ছিল; এরপরই যখন গল্প ফ্ল্যাশব্যাকে গেলো, পুরো জিনিসটাই কেমন যেনো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেলো; এই ম্যাড়ম্যাড়ে অবস্থা ছিল প্রথম হাফের শেষের দিকে হওয়া ফাইট সিনের আগ পর্যন্ত। এই সময়টায় গল্পের গতি রীতিমতো ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়!
তবে ছবির দ্বিতীয় অংশের চিত্রনাট্য প্রশংসা পাওয়ার মতো। মধ্যবিত্ত ছাত্রদের ব্রেইনওয়াশের বিভিন্ন ফর্মূলা, তাদের গোপন ক্যাম্প, তাদের ট্রেইনিং, এদের নিয়ে দেশের রাঘব বোয়ালদের কার্যকলাপসহ আরো অনেককিছু বেশ বড় পরিসরে দেখানো হয়েছে।
ছবির ডায়ালগ গুলো বেশ শক্তিশালী এবং ভারী ছিল, যেটা এমন ছবিতে খুবই দরকার! কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ সেনসিটিভও ছিল।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬০।
অভিনয় : অন্যান্যদের তুলনায় অভিনয়ে বেশি নজর কেড়েছেন ছবিতে গরিব/মধ্যবিত্ত যুবকদের ব্রেইনওয়াশ করা মাহমুদ, অর্থাৎ শাহরিয়ার মাহমুদ সজীব। তিনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ বেশ ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের সময় তার অভিনয় অনেক ভালো লেগেছে; যদিও তার ফ্রেশ লুক আমার পছন্দ হয়নি।
খিজির হায়াত খানের ফাইটিং স্কিল দূর্দান্ত, ছবি দেখার পর একথা স্বৗকার করতেই হবে। তবে তিনি অভিনয় এবং ফিটনেস দুইদিক থেকেই ঢের দূর্বল। আমি মনে করি মিস্টার বাংলাদেশ চরিত্রটির জন্য তার আরো শারীরিক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল; অভিনয়ে আরো সময় দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
খিজির হায়াত খানের কলিগ হিসেবে শামীম হাসান সরকার অভিনয়টা বেশ ভালো করেছেন। এটা তার প্রথম কাজ হলেও ইউটিউবের সুবাদে তার অভিনয় আগে দেখেছি; তাই তাকে নিয়ে আলাদা প্রত্যাশা ছিল। হতাশ হইনি।
নেগেটিভ চরিত্রে টাইগার রবি গতানুগতিক ছিলেন। তার ক্যারেক্টারে ভ্যারিয়েশন তেমন ছিল না। এছাড়া বাকি যারা ছিলেন ছবিতে সবার ব্যপ্তি কম ছিল। শানারেই দেবী শানু এবং কানাডিয়ান অভিনেত্রী মারিওন পেলেগ্রিন ছিলেন ছবির দুই অর্ধে; দুজনেই এভারেজ ছিলেন।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৩৫।
কারিগরি : ছবির আরেকটি হতাশাজনক দিক ছিল এটি। কিছু ড্রোন শট এবং মোটামুটি মানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া আর কোনোকিছুতে মন ভরেনি। হ্যাঁ, প্রথমার্ধের শেষে হওয়া ফাইট সিনের কোরিওগ্রাফি ভালো লেগেছে। ঐ একটি অংশের ফাইটই মন ভরিয়েছে।
ঐ ফাইট সিনটি বাদ দিলে পুরো ছবির ফাইট কোরিওগ্রাফি ছিল অত্যন্ত দূর্বল, সাথে দূর্বল ক্যামেরাওয়ার্ক তো ছিলই। আছে দূর্বল কার্টুন টাইপ ভিএফএক্স! এছাড়া শাহরিয়ার মাহমুদ সজীবের লুকেও বেশ সমস্যা ছিল। পুরো ছবিতেই তিনি ক্লিন সেভে ছিলেন। আমি এটা বলছি না, সব জঙ্গিদের দাড়ি-টুপি থাকে। কিন্তু একজন আল্লাহ ভক্ত নবীজীর সুন্নত পালন করবে না, এই বিষয়টি বেশ চোখে লেগেছে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ২৫।
বিনোদন : বিনোদনের তুলনায় এছবিতে সোশ্যাল মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা ছিল বেশি। এক্ষেত্রে আমি মনে করি ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ সফল। এর আগে কোনো বাংলাদেশি ছবিতে এতো বৃহৎ পরিসরে জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ দেখিনি। কয়েক মাস আগে মুক্তি পাওয়া মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘জান্নাত’ও ছিল জঙ্গিবাদ নিয়ে, তবে ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ জঙ্গিবাদ ইস্যুতে জান্নাতের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত, প্রসারিত।
ছবিতে গান রয়েছে ৫টি। অনেক দিন পর বড়পর্দায় কুমার বিশ্বজিতের গলা শুনলাম। তার গাওয়া গানটিই এছবির সেরা গান। এছাড়াও দৃক ব্যান্ডদলটির গাওয়া ছবির টাইটেল ট্র্যাকটি ভালো লেগেছে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।
ব্যক্তিগত : কোনো সাধারণ ছেলে টেরোরিজমের মতো অপকর্মে কীভাবে জড়ায় এছবির মাধ্যমে তার খুটিনাটি দেখতে পারা যায়। এটা ছিল ছবি থেকে একটি বড় পাওয়া। তবে ব্যর্থতার পাল্লাও বেশ ভারি। প্রথমার্ধে ছবি যদি অত্যধিক মাত্রার স্লো না হতো, লিড রোলের অভিনয় এবং ফিটনেস যদি ভালো হতো, ইব্রাহীম-কুমুর সম্পর্কের সিনগুলি আরো গতিশীল হলে, ক্যামেরাওয়ার্ক ও ভিএফএক্স ভালো হলে এবং ফাইট কোরিওগ্রাফি ভালো হলে এছবি দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো হতো।
রেটিং : ৪.৫/১০
ছবিটি কেন দেখবেন : দেশপ্রেম নিয়ে আমাদের দেশে এখন আর ছবি তেমন হয় না, বেশিরভাগই প্রেম-ভালোবাসা নির্ভর। আমি মনে করি কলেজ কিংবা ভার্সিটি পড়ুয়া সবার এই ছবিটি অন্তত একবার দেখা উচিত, এতে তারা জঙ্গিবাদ নামক গোলকধাঁধা থেকে দুরে থাকতে পারবে।