মণিকে রেখে চলে গেলেন মিন্টু
অনেকদিন ধরে দর্শকের চোখের আড়ালে টিভি নাটকের এক সময়ের পরিচিত মুখ জামালউদ্দিন হোসেন ও রওশন আরা হোসেন দম্পতি। তাদের ডাক নাম যথাক্রমে মিন্টু ও মণি। তিন সপ্তাহের বেশি সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর সম্প্রতি ৮১ বছর বয়সে মারা গেলেন জামালউদ্দিন হোসেন। এর মধ্য দিয়ে রওশন আরা হোসেনের সঙ্গে তার ৫৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটেছে।
বেশ কিছুদিন ধরে ভালো নেই রওশন আরা হোসেনও। তিনি পারকিনসনস রোগে ভুগছেন। ছেলে তাশফিন হোসেন বললেন, ‘বাবা মৃত্যুর সময় মা হাসপাতালেই ছিলেন। তার অবস্থাটা এখন এমন, এই মনে থাকে তো এই মনে থাকে না। তাকে নিয়ে তো আমাদের চিন্তার শেষ নেই। বাবা যেমন রোগে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন, মা–ও আসলে খুব কষ্ট পাচ্ছেন।’
তাশফিন হোসেন কানাডার ক্যালগ্যারি জানালেন, শুক্রবার (১১ অক্টোবর) এখানকার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টায় তার বাবা মারা যান। এই সময়ে তাদের সবার সঙ্গে মাও ছিলেন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ বাবার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন। কাঁদলেনও কিছুক্ষণ। বুঝতে পেরেছেন, আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের একসময়ের ব্যস্ত অভিনয়শিল্পী দম্পতি জামালউদ্দিন হোসেন ও রওশন আরা হোসেনের ছেলে–মেয়ে দুজনই কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বাস করার কারণে তারা দুজনও দুই দেশ মিলিয়ে থাকতেন।
অভিনয়শিল্পী দম্পতি রওশন আরা হোসেন ও জামালউদ্দিন হোসেন একসঙ্গে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন জামালউদ্দিন হোসেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এই সদস্য পরে টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রেও কাজ করেন।
সম্প্রতি এ অভিনয়শিল্পী দম্পতির প্রেম ও বিয়ের গল্প সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন বিটিভির সোনালিদিনের সংগ্রাহক কাজল রিপন। সেখান থেকে জানা যায়, দুজনের প্রেম ও পরিণয় ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর।
১৯৬৩ সালের কথা। মিন্টু তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়েন আর মণি ইডেন কলেজে। মিন্টু দেখতে সুদর্শন, লম্বা এবং যে কোন মেয়ের চোখে পড়ার মতো। আর মণি সম্পূর্ণ বিপরীত। আশকার ইবনে শাইখ পরিচালিত ‘প্রচ্ছদপট’ নাটকে অভিনয় করতে এসে দুজনার পরিচয়। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল পড়ুয়া ছেলেটি প্রেমের ফাটকে আটকে যান! প্রেমে হাবুডুবু খান টানা দু’বছর। অতঃপর বিয়ের প্রস্তুতি নেন দুজন। আর তখনই দুপরিবারের কানে যায় রোমান্সের খবর এবং নিরস অভিভাবকগণ বিয়ের ঘোর বিরোধী হয়ে ওঠেন।
উপায়ান্তর না দেখে, ছেলেকে বনবাস স্বরূপ চাচার বাড়ি আর মেয়েকে খালার বাড়িতে দ্বীপান্তর দেয়া হয়। বেরসিক অভিভাবকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান যেন দুজনার দেখা সাক্ষাৎ না হয়। চক্ষের আড়াল তো মনের আড়াল। তবে হিতে বিপরীত না হয়ে বিপরীতে হিত হয়ে যায়। প্রকৃতি পরিবেশ পরিস্থিতি চলে আসে প্রেমের পক্ষে। ঘটনাক্রমে সেই চাচা এবং খালার বাসা মুখোমুখি। মন্টু আর মণি দুজন দুজনকে দেখে চমকে ওঠেন!! প্রেম জমে ওঠে আবার।
বেগতিক দেখে চাচা এবং খালা মিলে মন্টু-মণির বিয়ের আয়োজন করেন। ওদের বাবা-মাকে দাওয়াত করেন। সিনেমার গল্পের মতো দুজনের শুভ পরিণয় ঘটে ১৯৬৫ সালে। বিয়ের পর চিটাগং স্টিল মিলে চাকরি নিয়ে সূদীর্ঘ হানিমুনে চলে যান নবদম্পতি। ১৯৭৫ এ ঢাকায় এসে দুজনেই যোগ দেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। অতপর দর্শকদের উপহার দেন ভালোকিছু মঞ্চনাটক এবং মনে রাখার মত টিভিনাটক।
গত ১৫ বছর অভিনয়ে একেবারেই অনিয়মিত ছিলেন জামালউদ্দিন হোসেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন। মাঝেমধ্যে যখন দেশে আসতেন, টুকটাক অভিনয় করতেন। তবে সাত-আট বছর ধরে একেবারেই অভিনয়ে ছিলেন না। জামালউদ্দিন হোসেনের ছেলে তাশফিন হোসেন কানাডার মাউন্ট রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক। মেয়ে তার পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।
১৯৪৩ সালের ৮ অক্টোবর ভারতের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করে জামালউদ্দিন হোসেন। দেশভাগের সময় পরিবারের সবাই চট্টগ্রামে আসেন। ওখানেই বসবাস শুরু করেন। জামালউদ্দিন হোসেনের স্কুলে কেটেছে চট্টগ্রামের সেন্ট প্ল্যাসিড স্কুলে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসি শেষ করে তিনি বুয়েটে ভর্তি হন।
টিভি নাটক দিয়ে দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা পেলেও মঞ্চ ছিল তাঁর সবচেয়ে ভালোবাসার মাধ্যম। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন জামালউদ্দিন। পরে কাজ করেছেন চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকেও।
২০১৯ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই অভিনেতার কাছে মঞ্চে শেষ অভিনয়ের কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘নিউইর্য়ক সিটিতে থাকাকালীন সময়ে দেখেছি অনেকগুলো নাটকের দল সেখানে রয়েছে। তাদের সমন্বয়ে ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনাসম্বল’ নামে প্রতিবছর একটা করে নাটক করতাম। গত ১১ বছরে ১১টা নাটক করেছি। এ ছাড়াও ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও ‘মুক্তধারার’ বই মেলায় আমরা স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে ‘বেলাশেষে’ নাটক করেছি। মঞ্চে ২০১৫-১৬-তে নিউইয়ার্কে নাটক করেছি।’’
এই অভিনেতা বলেন, ‘এখনকার মঞ্চ নাটকের স্ক্রিপ্টগুলো আরও উন্নত হওয়া দরকার। অনেক ব্যবধান আমাদের সময় আর এখনকার সময়ের মঞ্চ নাটকে। অনেক ভালো লাগে মঞ্চ নাটক। ছোট ছোট গ্রুপগুলো অনেক ভালো করছে। যদিও তেমন মঞ্চ নাটক দেখা হয় না। অনেক নির্দেশকের বয়স হয়ে গেছে। অনেকেই ব্যস্ত প্যাকেজ নাটক নিয়ে। গ্রুপ থিয়েটারের সেই উৎসাহ উদ্দীপনা অনেক কমে গেছে। কিছু ভালো কাজ যে হচ্ছে না তা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘ভালো জিনিস যত কম হয়, ততই ভালো’।’
অভিনয়জীবনের শুরুতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যুক্ত ছিলেন জামালউদ্দিন। একসময় নাট্যদলটি ছেড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল’। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এই অভিনেতা।
কোনো আফসোস রয়েছে কিনা জানতে চাইলে জামালউদ্দিন বলেছিলেন, ‘জীবনে যা চেয়েছি মনে হয় তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। ধনী না হলেও সম্মান নিয়ে চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে ২১শে পদক পেয়েছি। আর কি থাকতে পারে? তবে পরজনমে কণ্ঠশিল্পী হতে চাই। আমার প্রচুর দুর্বলতা কণ্ঠশিল্পীদের প্রতি। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত।’
জামালউদ্দিন হোসেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি তার নিজের নাট্যগোষ্ঠী নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল শুরু করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জামালউদ্দিন হোসেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘রাজা রাণী’, ‘চাঁদ বণিকের পালা’, ‘আমি নই’, ‘বিবি সাহেব’, ‘যুগলবন্দী’সহ কয়েকটি আলোচিত মঞ্চ নাটক পরিচালনা করেছেন।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য জামালউদ্দিন হোসেনকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে তাকে একুশে পদক প্রদান করে।
সূত্র: প্রথম আলো, চ্যানেল আই অনলাইন ও কাজল রিপন